You are currently viewing একগুচ্ছ কবিতা/ বেনজির শিকদার

একগুচ্ছ কবিতা/ বেনজির শিকদার

একগুচ্ছ কবিতা/ বেনজির শিকদার

 

অঙ্কনবিদ্যা

বরং তুমি দূরেই থাকো।
শেষচিঠি, শেষ প্রেম শেষ ভালোবাসা—
শেষকথা না-বলা ব্যথা আমি সয়ে যাই।
হাহাকারী বুক, আঁধারি অসুখ, বাঁধভাঙা সেতু, কান্নার হেতু;
ভুল কলগীতি, কল্লোল-প্রীতি, ভুল মায়াস্নানে, অনুভব প্রাণে;
নগরকোটাল হয়ে আমি বয়ে যাই!
শেষচিঠি, শেষ প্রেম শেষ ভালোবাসা—
শেষকথা না-বলা ব্যথা আমি সয়ে যাই।

বরং তুমি দূরেই থাকো।
শেষদেখা, মিছে ভালোবাসায় শেষ কাছে আসা—
ক্ষণিকের সুখ, না-বলা অসুখ, আমি মেপে যাই।
সময়ের ক্ষয়, অনুতাপ লয়, ক্ষণিক হেসে, ভুল সংশ্লেষে—
হৃদয়ের ভুল, বিরহ-ব্যাকুল, ভুল কিছু ভ্রম, অনুভব-শ্রম;
ভুল আয়োজনে আমি করে যাই।
শেষদেখা, মিছে ভালোবাসায় শেষ কাছে আসা—
ক্ষণিকের সুখ না-বলা অসুখ আমি মেপে যাই।

তুমি বরং দূরেই থাকো।
শেষস্মৃতি, না-বলা প্রীতি ভুলে যাওয়া ভাষা—
মিছেমিছি আশা, ভাব-ভালোবাসা, আমি বয়ে যাই।
প্রেম-গৌরব, ভুল-সৌরভ, ভুল কিছু আশা, তুমুল হতাশা;
ভেবেভেবে মন, শুধু অকারণ, ভুল আয়োজনে, ভুলের ভুবনে
সাজিয়ে বাসর আমি জেগে যাই।
শেষস্মৃতি, না-বলা প্রীতি ভুলে যাওয়া ভাষা—
মিছেমিছি আশা, ভাব-ভালোবাসা আমি বয়ে যাই।

তুমি বরং দূরেই থাকো।
শেষ মেলামেশা নেশাতুর ভাষা—
ক্ষীণ দুরাশা, আকুল তিয়াশা; আমি রোপে যাই।
তৃষিত আঁখি, কেমনে ঢাকি? হিয়ার মাঝে, যে গান বাজে;
বেদনাবিধুর কোন সে সুর? বাজুক প্রাণে না-হোক মানে
মহেঞ্জোদারোর মতো আমি ক্ষয়ে যাই!
শেষ মেলামেশা নেশাতুর ভাষা—
ক্ষীণ দুরাশা, আকুল তিয়াশা; আমি রোপে যাই।

বরং তুমি দূরেই থাকো দূরবনের নীরব পাখি;
আমি নিজ মনে কাছঘেঁষা রঙে তোমাকেই আঁকি!

 

উত্তাপ

কিছু কিছু মুহূর্ত বড় ব্যক্তিগত।
একাকী। নির্জন।

তুমি। তোমার হতে বিচ্ছিন্নতাও ঠিক তাই।
ব্যক্তিগত। বড় একাকী। নির্জন।

অন্তঃসলিলা নদীর মতোই—
নীরবকে পেয়েছি আজ।

ফেলে আসা হাহাকারেও তাপ দিয়ে যায় বড় আলগোছে।

 

আদি-বণিক

বিগত যৌবনের মতো আমি গত হয়েছি জেনে,
তুমি হাফ ছেড়ে বাঁচবে—
সে আমি আগেই জানতাম।

অজুহাতের বাহানায়
যে ঘড়িটা সঠিক সময় দিলো না,
যে বুঝতে চাইলো না
পেশাদারিত্বের সুষম নিয়মানুবর্তিতা।
বারবেলার হিস্যায় তাকে আগলে রেখে
আর কি লাভ বলো?

বরং নিলামে তোল
আদি-বণিক হয়ে সওদা করবো আমি।

 

বিমূঢ়

বহু জন্মান্তর
হাতের তালুতে থুতনি গুঁজে শুয়ে আছি!

আমাকে ঘিরে আছে
একটি সময়খেকো গৃহগোধিকার বেঢপ মুখ;
শুনি বেহাগের আর্তনাদ, অদূরে কফিনের দুখ।

ভাঙছে ফণীমনসার বন,
তৈজসের ঘ্রাণে উড়ছে একজোড়া অন্ধ মধুমক্ষিকা।
মৃত কবিতাদের মাতমে কাঁদছে এক-টব ঘন পর্তুলিকা।

ছুঁয়ে দিতে অধরপল্লব
দিলরুবা-প্রেমে মাঝে মাঝে উঁকি দেয়
একফালি আগুনরঙা ময়ূখমালী ঠোঁট।

হতে চেয়ে বৃষ্টি, এ দৃষ্টি মেঘ হয়ে যায়;
হরণ করে ইচ্ছের দীপাবলি গালিবের মতো
শংকরপ্রবাহে আকণ্ঠ তৃষ্ণা করে পান।

নির্ঘুমরাতে জখমি স্বপ্নগুলো—
ধবল-শশকের মতো ধীরপায়ে হাঁটে
অসিতবর্ণ চোখ দু’খানি যেন এক দুঃখভেজা নর্তকী।

নারীর প্রণয় নয়—
সন্ধ্যার আহ্নিকে ভাসে বিধুর সংলাপ;
ফিরে যায় বেনামি চিঠি, গাঢ় কুয়াশায় ডোবে ডাগর শশধর।

এরপর আরও কিছু দুঃখ মাপতে—
হিজলের হাহাকারে বাটখারা সাজে;
অমিত্রাক্ষরে বাড়ে বেলা, হৃদয়ে নাটমন্দিরের উৎসব।

আমি কেবল—
হাতের তালুতে থুতনি গুঁজে শুয়ে আছি।

 

নিষিদ্ধপুরী

এখানে দুঃখগুলো
মাখনের মতো জমে আছে নিঃশ্বাসের ভাঁজে;
বুকে ধরে কলঙ্কবিষ, উথলি তরঙ্গশাঁখ
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তিরতির কাঁপে রাঙা রাতুল ঠোঁট।

বুলবুলি কথা নয়—
ঘন ডামাডোলে রোপিত হয় খিস্তিখেউড়ের চাষ;
নামে অবিন্যস্ত জোছনায় মোহিনী মুদ্রার ঢল
খড় বিচালির মতো দাউদাউ পোড়ে জীবন্ত পাণ্ডুলিপি।

ভুলে গিয়ে ত্রিপাক্ষিক ক্ষত, নির্মম ব্যগ্রতায়
এখানে তামস-উদ্দেশ্যহীন বসে থাকার তোলপাড়।
মুছে ফেলে স্খলিত বীর্যদাগ
রূপসি বসন্ত নামে অহরহ, সাজে পদ্মরাগমণি।

ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো নিলামি দেনায়
আকণ্ঠ অন্ধকার করে পান, জলজোছনা হয়ে
এখানে বনেদি ইচ্ছেগুলো আছড়ে পড়ে যত্রতত্র;
মদির-লালসায় কংক্রিটের শরীরে নামে বৈতালি সম্পর্ক।

কচ্ছপের মতো হামাগুড়ি দিয়ে
প্রায়শই কার্ফুজারি হয়;
দিনান্তে বাদুড়ের মতো ঝুলে থাকে চোখের জল
কেবল বাড়িগুলো বাড়ি হয় না, নারীগুলো হয় না নারী।

নোনতা মায়ায় বেঁধে হৃদয়ের পাড়
আধপাকা শনের মতো দুলিয়ে সুশোভিত দর্পণ
কলঙ্কের পরিভাষা মাপতে, কোন সে সুদূর(!)
বিবর্ণ অন্ধকারে হবে কলতানের পৌষালি এসরাজ।

 

বিধুর বসন্ত

আজ বিকেলটা এমন ছিল—
ঠিক বুকের বাঁ-পাশটায় চিনচিনে ব্যথা হবার মতো।

যেভাবে বাউল কবির মন আনচান করে!
দিকে দিকে ডাকে ওই দখিন হাওয়ার গুঞ্জরণ;
চাইলে রাংতাকাগজে লিখে দেওয়া যায়
সাক্ষীবিহীন একটা আস্ত নিজেকে।

অনাদিকালের উচ্ছ্বাসে খোঁপার ভাঁজে ভাঁজে ছিল
হলদে সাদায় গুঁজে দেওয়া গাঁদা আর বেলি;
আলতারাঙা পা, বাসন্তীরঙা চুড়ি, ছিল
হাতের তালুতে বৃত্তবন্দি মেহেদিরঙা টুকরো টুকরো সুখ!

কোকিলের কুহুতানে জেগেছিল কৃষ্ণচূড়া, নাগলিঙ্কন
অলৌকিক স্পর্শে কী অম্ল-মধুর সে বারোয়ারি মিলন!

তন্তুজালে তর্কের অনুষঙ্গ নয়—
চতুঃসীমায় আম্রমুকুলের মদির আলিঙ্গনে
ঠিক যেন পৃথিবী এক সম্প্রীতির আরোগ্যশালা!

সীতানাথের আদর্শলিপির ভাষায়
আবেগের জোয়ারে নেমেছিল বাঁধভাঙা তারুণ্য!
এমন বিকেলে ভীষণ অসুখ হয় বুকের ভেতর!
চৈত্রের হাহাকারে ওঠে একলা একা ন্যালাখ্যাপা ঢেউ।

শাল, শিমুল আর রুদ্রপলাশ
দেবার ছিল কুরচি ফুলের প্রেম!
ইউক্যালিপ্টাস, রক্তকাঞ্চন, হেসেছিল মুচকুন্দ
নাগেশ্বর আর ক্যামেলিয়ার খানিক দূরেই বাস!

আজ বিকেলটা এমন ছিল—
সব লোক ঘরে ফেরার পরও আদিসিদ্ধ সঙ্গীময়তায়
হাতের পরে হাতটি রেখে আনমনে আরও খানিক হাঁটি।

ছুঁয়ে তনুমন, এ বাহুডোরে; হই মাতাল!
দুজন মিলে অমরত্বে;
ঘনপ্রেমে হই, নব নব নব, নব-আখ্যান।

 

পরিচিতি:

বেনজির শিকদার এর জন্ম টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুরে। ছোটোবেলা থেকেই কবিতার সাথে সখ্য। শৈশব কেটেছে যমুনা, ধলেশ্বরী, কালিগঙ্গা বেষ্টিত নির্জন প্রকৃতির কোলে। তিনি জীবন খুঁজে বেড়ান- বই প্রকৃতি সংগীত ও সাহিত্য-সংস্কৃতির মাঝে। বর্তমানে বেনজির শিকদার স্বপরিবারে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন।

প্রকাশিত গ্রন্থ:
নাকফুল (২০১৮)
অনুভূতির মিছিলে ভালোবাসার জীবাশ্ম (২০১৯)

********************************