You are currently viewing ইমতিয়ার শামীমের ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ উপন্যাসের পাঠ-মূল্যায়ন> মেহনাজ মুস্তারিন

ইমতিয়ার শামীমের ‘আমরা হেঁটেছি যারা’ উপন্যাসের পাঠ-মূল্যায়ন> মেহনাজ মুস্তারিন

ইমতিয়ার শামীমেরআমরা হেঁটেছি যারা’ উপন্যাসের পাঠ-মূল্যায়ন

মেহনাজ মুস্তারিন

হয় পরম সমর্পন, না হয় পরম একাকিত্ব—এ যদি অর্জন করতে না পারো, তবে তুমি কালজয়ী দিক নির্দেশক হতে পারবে না। এমনই একাগ্রতার দিক-নির্দেশনা-সমৃদ্ধ এক লেখা, যা পড়তে গিয়ে যতই গভীরে যাওয়া যায়, ততই যেন তা চিত্তকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে চলে। বলছি, ইমতিয়ার শামীমের লেখা “আমরা হেঁটেছি যারা” উপন্যাস নিয়ে; চুম্বক যার উত্তর বা দক্ষিণ মেরুতে না, বরং, পুরো গল্পের বিস্তৃত জমিনে এমনভাবে মিশানো, সেই চুম্বকের টানে যেকোন পাঠক সেই জমিনে আটকে থাকবে অনেকক্ষণ। থাকতে বাধ্য হবে, কারণ, বোদ্ধা পাঠক দূরের কথা, সাধারণ পাঠকেরও মনে হবে, নিজেকে যে কোন সফলতায় এগিয়ে নিতে একাগ্রতার প্রয়োজন অনস্বীকার্য! অনেকদিন পরে বই শেষ করার একটা তাগিদ অনুভব করলাম। উপন্যাসটি স্বাধীনতা পরবর্তী দুই দশকের রাজনৈতিক আলেখ্য, বিশেষকরে, সেই সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ক্যাডার বাহিনী, এবং তাদের নিপীড়ন সহ্য করা আপামর মানুষদের নিয়ে। সাধারণ মানুষদের গল্পের কেন্দ্রে চলে আসার যে দাবি আধুনিক সাহিত্যের, তার দায় অনেকদিন থেকেই মিটিয়ে চলেছে আমাদের লেখকগণ, নিঃসন্দেহে এই উপন্যাস তাতে নতুন সংযোজন।

স্বাধীনতা অবশ্যই এদেশের মানুষের সমাজ বদলের স্বপ্নকে তীব্র করেছিল। ভূ-রাজনীতি আমাদের সেই লালিত স্বপ্ন নিয়ে খেলছিল, যেমনটা আজও খেলে যাচ্ছে; বুঝে হোক কি না বুঝে, আমরা সেই খেলার অংশ হয়ে উঠি। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ ছিল নানা কারণে অস্থির। বলা বাহুল্য, বৃহৎ ও আঞ্চলিক নানা শক্তির পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। সেই সময় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বা গদি দখলের লড়াইয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে পেশিশক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল, কীভাবে তথাকথিত ক্যাডারদের ব্যবহার করেছিল, তারই আলেখ্য এই উপন্যাসের সবটুকু জুড়ে। ক্যাডারদের নানা সংকট ও তাদেরকে ঘিরে বিস্তৃত নানা তথ্য ও মিথ উপন্যাসের পরতে পরতে ঠাসা। ছোট্ট একটা পরিবারের জীবনসংগ্রামকে কেন্দ্র করে একটা দেশের  রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিকশিত হওয়ার মতো জটিল বিষয়কে গল্পের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপনের যে চেষ্টা তিনি করেছেন, তাতে কতটা সফল সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, নিঃসন্দেহে উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের কেবল না, সময় বিবেচনায় লেখকের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্নে সাহসিকতারও পরিচয় বহন করে।

গল্পের অন্যতম চরিত্র তথাগত নানারকম দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে বাবার আদর্শে বড় হতে হতে অনেক বড় হয়ে যায়। তবে বাবার কোন আদর্শ তাকে সাহসি করে তুললো সেটা খুঁজে পেতে বেশ কষ্ট করতে হবে। একইভাবে, আলোচ্য উপন্যাসে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দ্রুত সংগঠিত রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের উপস্থিতি তীব্রভাবে অনুভূত হলেও দলটির আদর্শ বা কর্ম পরিকল্পনার বিষয়টি অনুক্ত থেকেছে পুরো বইজুড়ে। উল্লেখ্য, দলটির ঘোষিত লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্র; যা বাংলাদেশের জাতীয় সংবিধানের অন্যতম মূলনীতিও বটে। অনুমান করতে অসুবিধে হয় না, লেখক হয়তো সমাজতন্ত্রের প্রতি জাসদের প্রতীজ্ঞায় আস্থাশীল না, যেমনটি মার্কসবাদে বিশ্বাসী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের এক সাধারণ বৈশিষ্ট। কিন্তু, সাহিত্যের লেখককে তো নির্দিষ্ট কোন আদর্শের অনুগামী হলে চলবে না, তাকে হতে হবে নির্মোহ। তো, শ্রেণিশক্তি বিবেচনায় স্বাধীনতা-পরবর্তী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা পঁচাত্তর পরবর্তীকালে জেনারেলদের হাতে প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর সাথে জাসদের ফারাকটা কোথায় তা স্পষ্ট করতে পারলে গল্পটা কেবল যে স্পর্শকাতর হতে পারতো তা না, একইসাথে তা ইতিহাসের দায় মেটাতেও সক্ষম হতো। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সাহিত্যে স্বাধীনতাপূর্ব বিশেষকরে ব্রিটিশ-পর্বে শ্রেণিসংগ্রাম যতটা দেখা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সাহিত্যে বিষয়টি ঠিক ততটাই অনুপস্থিত। অথচ, নানাজনের নানা গদ্যে বিষয়টি কম আলোচিত হয়নি। তাহলে উপন্যাস কেন পারছে না? বইটি পড়তে গিয়ে যখন চীন এবং কমরেডদের কথা এল, মনে হলো, যাক এবার তাহলে তেমন একটা উপন্যাস পাওয়া গেল। না, এখানে লেখক হতাশই করেছেন। বাংলাদেশ শেষবিচারে অন্যদেশ, বিশেষকরে ভারত ও চীনের জাতীয় পুঁজিবিকাশের যে পরীক্ষাগার হয়ে থাকল, গল্পে সেটিও স্পষ্ট হয়নি। এটা রাজনৈতিক-অর্থনীতির মতো জটিল বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখার প্রধানতম অসঙ্গতি।

এই ব্যতিক্রম বাদ দিলে, একটা পূর্নাঙ্গ উপন্যাস হয়ে ওঠার বা পুরো গল্পে ভালোলাগার অনেক উপকরণ খুঁজে পাওয়া যাবে। বাড়ন্ত বয়সে শারীরিক পরিবর্তনের খেয়াল সম্পর্কের সামাজিক সীমানা বা বাঁধা অতিক্রমের ঝোঁককে যে প্রবল করতে সক্ষম, তার সুস্পষ্ট উপস্থাপনটি ছিল দারুণ! চমক ছিল সেখানে।পড়তে গিয়ে বার বার মনে হচ্ছিল, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের এক এলিগরিকাল আখ্যান বুঝি রচিত হতে যাচ্ছে। বলা নিষ্প্রয়োজন, আমাদের সাহিত্যে সিরিয়াস আখ্যান যতটা দেখা যায়, কৌতুক, হাস্যরস বা রূপকের আড়ালে এলিগরিকাল সাহিত্য তেমনটা দেখা যায় না। অথচ, সামরিক শাসন বলি কি রাজনৈতিক শাসন, সম্ভাব্য বিপদের আশংকায় সাহিত্যের স্বাভাবিক প্রকাশ যখন রুদ্ধ, তখন এলিগরি হতে পারে বিকল্প উপায়, যেখানে মেটাফর বা রূপকের আড়ালে মূল গল্পকে পাঠকের দরবারে হাজির করা সম্ভব। দুঃখজনক হলেও সত্য, যুদ্ধ পরবর্তী সময়কালকে ধারাবাহিকভাবে স্পষ্ট করার কাজটিতে লেখককে সেভাবে সাহসি হতে দেখা যায় নি। এখানেই এলিগরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলাম হাড়ে হাড়ে। সেটার প্রয়োগ ঘটিয়ে হোক কি না হোক, যুদ্ধপরবর্তী সময় নিয়ে লেখক যদি আরেকটু সাহসী হতেন, তবে বলা যায় আগামী প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের একটা শক্ত দলিল হতে পারতো বইটি। কেন জানি মনে হয়েছে, যাদের হাত ধরে স্বাধীনতার পথ পরিক্রমায় আমরা হাঁটছি, কোন এক সংকটে লেখক তাদের সমালোচনা খানিক এড়িয়ে গেছেন।

এরপরও তথাগতকে ভালো লেগেছে। অনেক বেশি মন ছুয়ে গেছে মনিষার চরিত্রটি। ভাইবোনের সম্পর্কের মধ্যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার, ব্যক্তিত্বের এবং নির্ভরতার জায়গাগুলো ছুঁয়ে গেছে। মনিষার প্রবল উপস্থিতির পাশে শ্রভ্রা মারিয়া চরিত্রগুলো বেশ দূর্বল মনে হয়েছে। তাদের অবস্থান আরেকটু স্পষ্ট করলে মনিষার অন্তর্গত খেয়ালগুলো আরও স্পষ্ট হতো পাঠকের কাছে।

পুঁজিবাদের বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক বিপন্নতা এবং রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক লালিত-পালিত বিভিন্ন বাহিনীর তান্ডব ছোট্ট একটা পরিবারের গল্পের মধ্যে দিয়ে একটা সময়কে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন ইমতিয়ার শামীম। এটাই আগামীর জন্য আশার বাণী। এটাই অন্ধকার পথ মাড়িয়ে আলোর পথে হেঁটে চলা। গদ্যে পাঠক ধরে রাখার বাস্তবিক রুচিশীল ঢং চমৎকার; যা তাঁর লেখনিকে নিঃসন্দেহে অনেকের চেয়ে আলাদা করে দেখবার সুযোগ করে দিয়েছে। গল্পের শেষাংশে অজানা অনেক কিছুর উন্মোচন ঘটে। সেই জানা আর বোঝার মধ্য দিয়ে নতুন উপলদ্ধির জন্ম হয়। সত্যই তো! মানুষ এক জীবনে কতটুকুই-বা জানতে পারে? নিজেকেই তো জানা হয় না। জগতের কথা না হয় নাই ভাবলাম, ভবিষ্যত সে তো আরও দূরে! লেখায় কিছু সীমাবদ্ধতা থাকবে, তবু্ও যা তিনি তুলে ধরেছেন তাই যেন চমৎকার ভাবে পাঠক প্রিয় হবার দাবি রাখে।

‘আমারা হেঁটেছি যারা’ বইটি ইতিকথা পাবলিকেশন থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। আবারও ধন্যবাদ ইমতিয়ার শামীম, কলমের সৃজনে প্রদীপ্ত ঢং আপনাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।

========================

মেহনাজ মুস্তারিন: কবি ও লেখক

========================