You are currently viewing আ মরি বাংলা ভাষা/ বিচিত্রা সেন

আ মরি বাংলা ভাষা/ বিচিত্রা সেন

আ মরি বাংলা ভাষা

বিচিত্রা সেন

কটেজ থেকে নামতে নামতেই সকাল আটটা বেজে গেলো। রাস্তায় নেমে চারপাশে তাকালাম। আশেপাশে কোনো ভালো রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ছে না। সুমিত আমার দিকে তাকালো। ওর চোখে জিজ্ঞাসা,কী করবো এখন? ছেলেমেয়ে দুটোও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হাসি পেলো আমার। ওদের চোখের নীরব ভাষা আমার কাছে জানতে চাইছে এখন কী করণীয়। আরে বাবা! আমি কী বলবো! আমি কি এখানকার কিছু চিনি? তবুও সুমিতের দিকে তাকিয়ে বললাম,

-চলো, সামনে হাঁটি। সামনে হয়তো কোনো রেস্টুরেন্ট পেয়ে যাবো।

আমরা সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। গতকাল রাতে আমরা গয়ায় এসে পৌঁছেছি। স্টেশনে নেমেই রাস্তার ওপাশে আবাসিক কটেজ দেখে আর কোনোদিকে তাকাইনি। সোজা কটেজটাতে ঢুকে পড়েছিলাম। রিসেপশনে তামিল এক ভদ্রলোককে দেখে নিজেকে নিরাপদ মনে হয়েছিল। এর আগে কখনো গয়ায় আসিনি, কিন্তু চেন্নাই গিয়েছি ছয়বার। ছেলের চিকিৎসার জন্য যেতে হয়েছিল। ওখানে তামিলদের সাথে মিশতে মিশতে ওদেরকে খুব আপন মনে হয়। কোথায় যেন ওদের সাথে আমাদের মিল আছে। ওরা ভারতের দক্ষিণের অধিবাসী। আমরাও বাংলাদেশের দক্ষিণের অধিবাসী। ও আচ্ছা, এতক্ষণ তো বলাই হয়নি। আমরা এসেছি চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। যা বলছিলাম, তামিলদের সাথে কোথায় যেন একটা আত্মীয়তা অনুভব করি। সেটা হয়তো হতে পারে চেন্নাইয়ে ছয়বার যাবার কারণে। এখন এমন হয়েছে, চেন্নাই গেলে আমার আর মনেই হয় না যে দেশের বাইরে এসেছি। এবার গয়ায় এসেছি শ্বশুরের পিণ্ডদানের জন্য।

কাল রাতে সুমিত আর ছেলে সায়ন বের হয়ে অনেক খুঁজে টুজে ভাত আর সবজি নিয়ে এসেছিল। যদিও খাওয়ার মান ভালো ছিল না, তবুও ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত ছিলাম বলে তা খেয়েই রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ সকালে উঠে স্নান  সেরে আমরা চারজনই একসাথে বেরিয়েছি ভরপেট খেতে। কিন্তু ভালো কোনো রেস্টুরেন্টই চোখে পড়ছে না এ এলাকাটাতে। হঠাৎ বামপাশে চোখ পড়লো ছোট্ট একটি দোকানের দিকে। অনেকটা টংঘরের মতো দোকানটা। ওখানে লুচি আর আলুর দম বিক্রি হচ্ছে। সামনে বেঞ্চ পেতে রাখা হয়েছে। ওখানেও অনেকে বসেছে। আমি সুমিতকে বললাম,

-চলো, এখানেই খেয়ে ফেলি। লুচি আর আলুর দম। ভরপেট খাওয়া হবে।

সুমিত উসখুস করে বললো,

-দোকানটাতো তেমন সুবিধার না। এ খাওয়া হজম হবে তো?

বাচ্চারা খিদেয় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ওরা বললো,

-হবে, হবে। চলো তো ওখানে।

আমরা দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওরা খুব আন্তরিকতার সাথে আমাদের বসতে বললো বেঞ্চে। আমার বাচ্চারা বসলো, জায়গা না পাওয়ায় আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। খেয়াল করলাম, বিহারীরা খুব এঁটো মানে। খাওয়ার পর বাসনগুলো একটা টেবিলের ওপর রাখা হচ্ছে। ওখান থেকে একজন চ্যাংড়া মতো ছেলে বাসনগুলো সরিয়ে নিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে। আমাদের চারজনকে চারটি স্টিলের থালায় সাজিয়ে লুচি ও আলুর দম দিলো। আমি লুচি ছিঁড়ে আলুর দম মিশিয়ে মুখে দিতে যাবো, দেখলাম দোকানের ভেতর থেকে একজন মহিলা আমার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। খাওয়ার সময় কেউ এভাবে তাকিয়ে থাকলে বিব্রত লাগে। আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে খেতে লাগলাম। যদিও আমার চোখ লুচির দিকে, কিন্তু আমি ঠিকই টের পাচ্ছিলাম আমাকে দুটি চোখ বিদ্ধ করছে। আমি আড়চোখে ওদিকে তাকালাম। দেখলাম, মহিলা আকুল হয়ে আমাকে দেখছে, অপলক তাঁর দৃষ্টি। মহিলার বয়স পঁয়ষট্টি থেকে সত্তর হতে পারে। কী দেখছেন তিনি অমন আকুল হয়ে আমার মধ্যে। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল আমার। কোনোরকমে খাওয়া শেষ করে অভ্যাসবশত আমি থালাটি দোকানদারের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। উনি ছিটকে সরে গেলেন, হিন্দীতে বললেন বাসন রাখার টেবিলটাতে রাখতে। বুঝলাম এঁটো হাতে উনাকে ছুঁতে চাওয়াতেই উনি ওভাবে ছিটকে সরে গেছেন। আমাদের দেশে ওসবের বালাই নেই। আমি হাতটা ধুয়ে ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করতেই হঠাৎ দেখলাম ওই মহিলা দোকানঘর থেকে বেরিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারপর আমি কিছু বোঝার আগেই আমার হাত দুটো আলতো করে ধরে আমার চোখের দিকে আকুলভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-তুমি কি বাঙালি?

গতকাল ট্রেনে ওঠার পর থেকে আমরা চারজন ছাড়া কারো মুখে বাংলা ভাষা শুনিনি। হঠাৎ এ বিহার অঞ্চলে চারপাশে হিন্দীভাষী মানুষের মাঝখানে অপরিচিতা এক বিহারী বৃদ্ধার মুখে বাংলা ভাষা শুনে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। সুমিত এবং আমার বাচ্চারাও চমকে বৃদ্ধার দিকে তাকালো। সাজসজ্জায় বিহারী, কিন্তু মুখে পরিষ্কার বাংলা। আমি বিস্ময়াভিভূত চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম,

-হ্যাঁ, আমি বাঙালি। আপনি কি বাঙালি?

বৃদ্ধা আমাকে জাপটে ধরলেন। বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

-হাঁ হাঁ, আমি বাঙালি।

তারপর দোকানের ভেতরে বসা বৃদ্ধ লোকটা এবং দুই যুবকের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– কিন্তু ওরা কেউ বাঙালি না। ওরা বিহারী। ওরা আমার স্বামী এবং ছেলে। কতদিন আমি বাঙালি দেখি না! কতদিন আমি বাংলায় কথা বলি না। আমার খুব বাংলা বলতে ইচ্ছে করে। আমার খুব বাবার দেশে যেতে ইচ্ছে করে।

বলেই বৃদ্ধা হাঁউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। তাঁর স্বামী বিরক্তি নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলে দুটো হাসছে। তারপর বড়জন হিন্দীতে বললো,

-তুমি এ দিদির সাথে তোমার বাবার বাড়িতে চলে যাও। ওখানে গিয়ে ইচ্ছেমতো বাঙালি দেখো আর বাংলায় কথা বলো।

বৃদ্ধা মুখ ঝামটা দিয়ে বাংলাতেই বললেন,

-যাবোই তো, একদিন তোদের সবাইকে ছেড়ে ঠিক আমার বাংলা মুলুকে চলে যাবো।

আমার মনটা হু হু করে উঠলো। একজন বাঙালির বাংলার জন্য এত হাহাকার! বাংলাদেশ এক ভাষা, এক জাতির রাষ্ট্র। তাই নিজের ভাষায় কথা বলার জন্য কখনো এমন করে হাহাকার জাগেনি। এ মহিলার বৃদ্ধ বয়সে নিজের জাতির লোককে পেয়ে এ কান্না আমাকে বিহ্বল করে দিলো। তিনি তখনো আমায় বুকে জড়িয়ে আছেন। আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরে জানতে চাইলাম,

-আপনি বাপের বাড়ি যান না? পশ্চিমবঙ্গে কোথায় থাকেন তাঁরা?

উনি আবারও হু হু করে কেঁদে উঠলেন,তারপর বললেন,

-জানি না রে, কিচ্ছু জানি না। ১৯৭০ সালে আমার বিয়ে দিয়েছিল বাবা। আমরা তখন আসানসোলে থাকতাম। ছেলে বিহারী হলেও সরকারি চাকরির লোভে আমার বাবা এ সম্বন্ধ করেছিল। আমার স্বামী রেলে ছোটখাটো চাকরি করতো। বিয়ের পরই আমাকে নিয়ে চলে গেলো দিল্লী। তারপর নানান জায়গা ঘুরে বিহারেই স্থায়ী হলাম। বিয়ের পর পাঁচ বছর পর্যন্ত বাপের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়নি। আমার শ্বশুর শাশুড়ি যেতে দেয়নি। বাঙালি মেয়ে বিয়ে করায় ওরা ছেলের ওপর রাগ করেছিল। এরপর যখন আসানসোল গেলাম তখন কাউকে আর পেলাম না। আমার বাবারা নাকি ওখান থেকে চলে গেছে। অথচ আমাকে একটু জানায়ওনি। হয়তো চিঠি লিখেছিল, সে চিঠি এসে পৌঁছায়নি। আসলে আমার বাবার আট মেয়ে ছিল তো, তাই একটা হারিয়ে গেলেও বাবা মায়ের কিছু এসে যায়নি। জানিস মা, বিয়ের পর থেকে আমি আর কখনো বাপের বাড়ির কাউকে দেখিনি। কিন্তু আমার মন খুব কাঁদে রে মা, খুব কাঁদে। আমি এখনো বিহারী হতে পারলাম না। বাঙালিই রয়ে গেলাম।

বলে তিনি আবার হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে লাগলেন। নিজেরই অজান্তে আমার দুচোখ ভেসে যাচ্ছিল। বৃদ্ধার জায়গায় আমি যেন নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। বৃদ্ধার স্বামী ধমক দিয়ে বৃদ্ধাকে ভেতরে যেতে বললেন। ছোট ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে হিন্দীতে বললো,

-কিছু মনে করবেন না দিদি। আমার মা একটু পাগল টাইপের। বাঙালি কাউকে দেখতে পেলেই কাঁদে। এত বছর গয়াতে থেকেও, বিহারী ছেলে মেয়ের মা হয়েও, নিজে বিহারী হতে পারলো না।

বৃদ্ধার বাঙালির জন্য এত আবেগ দেখে, বাংলায় কথা বলার জন্য এত আকুলতা দেখে আমার বুকটা ভেঙেচুরে যাচ্ছিল। মনে হলো কী অসহায় এ নারী! বিয়ের পরে চিরজন্মের মতো হারিয়ে গেছে তার নিজের পরিচয়। দরিদ্র বাবা মা বিয়ে দিয়েই ঘাড়ের বোঝা নামিয়েছে। অথচ সেই মেয়েটি অর্ধ শতাব্দী অন্য প্রদেশে, অন্য পরিবেশে যাপিত জীবন পার করেও আত্মপরিচয়ের সন্ধানে আজ এ বয়সে এসেও আকুল হয়েছে। মনে পড়লো আমাদের দেশের বায়ান্নের ভাষাশহিদদের কথা। যাঁদের আত্মত্যাগের কারণেই আজ আমরা বুক চিতিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি। তাঁদের মতো এ বৃদ্ধারও বাংলা এবং বাঙালির প্রতি কী গভীর মমতা! পরম শ্রদ্ধায় বৃদ্ধার প্রতি আমার মাথাটা নত হয়ে এলো। আমি তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বললাম,

-আপনি এমন করে কাঁদবেন না মাসীমা। আমি ওয়েস্টবেঙ্গল এর বাসিন্দা নই, তাই ওয়েস্টবেঙ্গলে যেতে বলতে পারছি না। তবে বাংলাদেশে আসুন, আমার কার্ড আপনাকে দিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে এসে শুধু আমাকে একটা ফোন করবেন। আপনি আমার বাড়িতে যতদিন খুশি থাকতে পারবেন। একবার আসুন আমাদের দেশে। দেখবেন, আপনার খুব ভালো লাগবে।

বৃদ্ধা উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি ব্যাগ থেকে বের করে তাঁর হাতে একটা  কার্ড দিলাম। সুমিত তাড়া লাগালো,

-চলো চলো, আমাদের অনেক কাজ বাকি আছে।

ইচ্ছে করছিল বৃদ্ধার সাথে আরও অনেক গল্প করতে। কিন্তু আমাদের হাতে অনেক কাজ বাকি। অগত্যা পা বাড়ালাম সামনের দিকে। পেছনে পড়ে রইলো সেই বাঙালি মেয়েটি যে পঞ্চাশ বছর আগে বিয়ে নামক এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে চিরদিনের মতো বাংলা ছেড়েছিল অথচ অন্তরে যে গভীর মমতায় আজও লালন করছে তার প্রাণপ্রিয় বাংলাকে।