You are currently viewing আহমেদ মমতাজঃ একনিষ্ঠ এক ঝিনুক সন্ধানী

আহমেদ মমতাজঃ একনিষ্ঠ এক ঝিনুক সন্ধানী

আহমেদ মমতাজ। আমার দীর্ঘ সময়ের সুহৃদ। চট্টগ্রামর পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাসিরাবাদস্থ বাছা মিয়া রোডের যে বাসায় মমতাজ তার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছিলো, সেই সময়ে আমি প্রায়শঃ আড্ডা দিতাম সেখানে। ওর বাসাটা পেরিয়ে একটু গেলেই আমার আপাদের বাড়ী। এই পথে পাহাড়তলী বাজার যাওয়া-আসা করতাম, সরাইপাড়ায় আমার খালার বাড়ী যেতাম।  আমাদের তখন এলভিস প্রিসলী যুগ চলছে। বেলবটম আর এলভিস স্টাইলে চুল রাখা আর হীলঅলা জুতো পড়া এবং চওড়া বেল্ট পরা ছিলো আমাদের ফ্যাশান। মমতাজের সাদা রঙের প্রতি আকর্ষণ ছিলো খুুব। আর ভালোবাসতো  নানা রকমের পারফিউম। তার ঢেউ খেলানো চুলের খুবই যত্ন করতো।

পরবর্তীতে আমার রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া, রাতভর পোস্টার লাগিয়ে, চিকা মেরে, কখনো পুলিশ-মিলিটারির তাড়া খেয়ে ওর বাসায় ঠাঁই নিতাম। ১৯৮৫-৮৬ সালে সে মীরসরাই চলে গেলে যোগাযোগ কমে যায়। পরে ব্যাংকে চাকরী নিয়ে সে আমান বাজার এলাকায় চলে যায়। আমিও রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রাম, চাকরী, বিয়ের পেন্ডুলামে যারপরনাই গতানুগতিক হয়ে পড়ি। ১৯৯১ সালে আমার চট্টগ্রাম ত্যাগ আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আমেরিকা প্রবাসী হবার পর স্মৃতিতে ধুলোর আস্তরণ পুরু হতে থাকে।

২০১৫ সালের দিকে হঠাৎ একদিন মমতাজকে ফেসবুকে পেয়ে যাই। চেনার জো নেই। সময় আপনমনে নানা বর্ণিল আলপনা এঁকে দিয়েছে আমাদের অবয়বের ক্যানভাসে। যেটা কেড়ে নিতে পারেনি, সেটা উচ্ছ্বাস। দুই বন্ধু পুরনো মৌতাতে ভার্চুয়াল আড্ডায় মেতে উঠি। সে বাংলা একাডেমীর গবেষণা বিভাগে কাজ করছে শুনে খুব খুশি হলাম। ২০১৭ সালের অক্টোবরে দেশে যাই এবং দীর্ঘদিন পরে মমতাজকে দেখে আবেগ আপ্লুত হয় পড়ি। ঘন্টা কয়েক ছিলাম। নাসরিন আমাকে না খাইয়ে ছাড়ে নি সেদিন। আবার দেখা হবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমেরিকায় ফিরে আসি এবং দিন কয়েক পরে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। শোনার পর মমতাজ বড়োই অস্থির হয়ে পড়েছিলো। ঘন ঘন খবর নিতে লাগলো। সুস্থ হলাম কিন্তু হৃদয়ঘটিত ব্যাপার স্যাপার বিধায় নিস্তার পেলাম না। অষুধ নির্ভর হয়ে গেলো জীবন।

২০১৯ সালের শেষদিকে পাঞ্জেরী প্রকাশনী আমার গল্পগ্রন্থ ‘অন্ধশিকার’ প্রকাশের জন্য মনোনীত করে এবং দেশে আমার প্রতিনিধি হিসেবে আমি মমতাজকেই মনোনীত করি। আমার হয়ে মমতাজ যথাযথ ভুমিকা পালন করে। বইটি আমি মমতাজকে উৎসর্গ করি। মমতাজ বই হাতে পেয়ে আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে আমাকে কল করে। কথা ছিলো গতবছর দেশে যাবো, কিন্তু করোনা মহামারী রুখে দিলো এবং ঘাতক করোনা গত ৯ই মে ভোরে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় আমার প্রিয়তম বন্ধুকে।

মমতাজ ছিলো ঝিনুক সন্ধানী। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের জীবনালেখ্য খুঁজে খুঁজে বের করে আনার অদম্য নেশায় মশগুল ছিলো  মমতাজ। ক্লান্তিহীন। সে বাংলা একাডেমির সহ-পরিচালক এবং ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সাহিত্য বিষয়ক ষান্মাসিক পত্রিকা ‘চট্টগ্রাম পরিক্রমা’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। তিনি ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি, চট্টগ্রামস্থ মীরসরাই এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম কলেজ প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলো। সে বিপুল পরিমাণ প্রবন্ধ, গবেষণাকর্ম বেশকিছু ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য ও গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেছে, তম্মধ্যে ‘মীরসরাই’র ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতি’, শমশের গাজী, মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস-চট্টগ্রাম জেলা, চট্টল মনীষা উল্লেখ্যযোগ্য। এছাড়াও সহধর্মিনী রাইয়ান নাসরিনের সাথে যৌথভাবে ‘বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী’, বাংলাদেশে কমনওয়েলথ যুদ্ধসমাধি, মুক্তিযুদ্ধের বীরগাথাসহ বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেছে।

আজ ভগ্নহৃদয়ে বারবার তাকে স্মরণ করি। এই নশ্বর পৃথিবীতে মমতাজের মতো হৃদয়বান বন্ধু খুব কমই পাওয়া যায়।

আমি তার নতুন অজানা পথের অন্তহীন অভিযাত্রার সাফল্য কামনা করি।

 

আলী সিদ্দিকী