You are currently viewing আলেক্সান্দর পুশকিন: আধুনিক রুশ সাহিত্যের রূপকার>  শিল্পী নাজনীন

আলেক্সান্দর পুশকিন: আধুনিক রুশ সাহিত্যের রূপকার> শিল্পী নাজনীন

আলেক্সান্দর পুশকিন: আধুনিক রুশ সাহিত্যের রূপকার

শিল্পী নাজনীন

তার পুরো নাম আলেক্সান্দর সের্গেয়েভিচ পুশকিন। যাকে আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক এবং রাশিয়ার জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়। বর্তমান পৃথিবী তাকে চেনে প্রেমের কবি হিসেবে। তার একটি বিখ্যাত প্রেমের কবিতা `I LOVED YOU AND I PROBABLI STILL DO’ রোমান্টিক রুশ কবিতার একটি অসামান্য উদাহরণ। Genia Gurarie পুশকিনের এই কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেন:
`I loved you, and I probably still do,

And for a while the feeling may remain…

But let my love no longer trouble you,

I do not wish to cause you any pain.

I loved you; and the hopelessness I knew,
The jealousy, the shyness – though in vain –
Made up a love so tender and so true
As may God grant you to be loved again.’

বর্তমানে পুশকিন শুধু রুশ সাহিত্যে নয় বিশ্বসাহিত্যেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি হিসেবে সমাদৃত। ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপিয়র, জার্মান সাহিত্যে গ্যেটে এবং বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের যে অবস্থান, রুশ সাহিত্যেও পুশকিনের অবস্থান তেমনই। পুশকিন সম্পর্কে রুশ কথাসাহিত্যিক ও সমালোচক ভ্লাদিমির নাবোকভের উক্তিটিই রুশ সাহিত্যে পুশকিনের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। নাবোকভ বলেন, ‘সবকটি রুশ সম্রাটের রাজত্বকাল মিলেও পুশকিনের কবিতার একটি পঙক্তিরও যোগ্য হবে না’।

বিশ্বসাহিত্যে পুশকিনের দখল ছিল ঈর্ষনীয়। রুশ সাহিত্যকে তিনিই প্রথম বিশ্বসাহিত্যের উপযোগী করে তোলেন। মূলত কবি হলেও রুশ সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও ক্ষণজন্মা  পুশকিনের অবদান অনস্বীকার্য।   তিনি নাটক, গল্প, মহাকাব্য, এবং উপন্যাসে নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন দারুণভাবে। সাহিত্যের যে শাখাতেই হাত দিয়েছেন পুশকিন, সেখানেই সোনা ফলেছে। রুশ ভাষা ও সাহিত্যে তাকে আধুনিক কাব্যভাষা, রিয়েলিজম, গদ্যকাহিনি, ট্রাজেডি, কাব্যনাট্য প্রভৃতির জনক হিসেবে স্বীকার করা হয়।

আলেক্সান্দর সের্গেয়েভিচ পুশকিন ১৭৯৯ সালে ২৬মে জার শাসিত রাশিয়ার মস্কোতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সের্গেই লভোভিচ পুশকিন ছিলেন ছয়শ বছরের প্রাচীন ও অভিজাত এক রুশ পরিবারের সন্তান এবং মা নাদেজদা ওসিপোভনা গ্যানিবাল ছিলেন পিটার দ্য গ্রেট হিসেবে পরিচিত পিওৎর ভেলিকির ঘনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য রাজন্য আব্রাহম গ্যানিবালের দৌহিত্রী। সেকালের অভিজাত পরিবারের নিয়মানুসারে বাড়িতে পুশকিনের জন্য ফরাসি গভর্নেস ছিল, ছিল জার্মান চাকর, ইংরেজ পরিচারিকাও। আর ছিলেন আরিনা নামের ধাত্রীমা। যার মুখের ঘুমপাড়ানি গান, ছড়া, গল্প আর রূপকথা শুনে বেড়ে উঠেছিলেন শিশু পুশকিন, রুশ জনজীবন ও ভাষা সম্পর্কে হয়ে উঠেছিলেন সচেতন। ফলে একথা বলা যায় যে, ফরাসি এবং রুশ এ দুটি ভাষাই পুশকিন শিখেছিলেন মাতৃভাষার মত করে। ফরাসি ভাষা জানা না থাকলে পুশকিন কতটা আজকের পুশকিন হয়ে উঠতেন, সে নিয়ে সংশয় আছে বিস্তর। মূলত ফরাসি সাহিত্যের মাধ্যমেই ইউরোপীয় এনলাইটমেন্ট সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন পুশকিন এবং ভলতেয়ার ও দিদারো দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। পুশকিন নিজেও সে কথা স্বীকার করেছেন বহুবার দ্ব্যর্থহীনভাবে। পুশকিন মূলত কারামজিন স্টাইলের গদ্যের সাথে ভলতেয়ার স্টাইলের গদ্যের সংমিশ্রন ঘটাতে চেয়েছিলেন। এরফলে যে গদ্যরীতিটির জন্ম দিয়েছিলেন পুশকিন, সেটি ছিল অনেকটা নতুন ধাঁচের ফরাসি গদ্যরীতি, যা রুশদের কাছে ছিল চমকপ্রদ এবং অভিনব। সম্ভবত এ কারণেই রুশরা পুশকিনের এই গদ্যরীতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এবং এখন পর্যন্ত এই গদ্যরীতিই রুশ সাহিত্যের প্রাণ। ছাত্রাবস্থায় কান্টের লিবারাল ইন্ডিভিজুয়ালিজমও প্রভাবিত করেছিল পুশকিনকে, পুশকিনের বহু রচনায় তার প্রমাণ মেলে।

পুশকিন জার্মান, ইতালিয় এবং ইংরেজি ভাষা থেকে অনুবাদ করতে পারতেন অনায়াসে। এছাড়া গ্রীক, লাতিন ধ্রুপদী সাহিত্যেও দারুণ দখল ছিল তার। সেইসাথে সমকালীন ইউরোপীয় এবং মার্কিন কবি-সাহিত্যিকদের রচনা সম্পর্কেও সম্যক ধারণা রাখতেন পুশকিন।

কৈশোরেই পুশকিনের কবি প্রতিভার ঝলক পরিলক্ষিত হয়। প্রথম কবিতা যখন প্রকাশিত হয়, তখন পুশকিনের বয়স মাত্র পনেরো। ১৮২০ সালে কাহিনিকাব্য ‘রুসসান ও রুদমিলা’ প্রকাশিত হলে রাশিয়ার অগ্রজ কবিগণ পুশকিনের কাব্যপ্রতিভায় চমকিত হয়ে তাকে ‘উদীয়মান যুগান্তকারী কবি’ আখ্যা দেন। পরবর্তী দশ বছর পুশকিন সাহিত্যের নানান শাখায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উদ্ভাবনায় ব্যস্ত রাখেন নিজেকে। এরও পরে তিনি মনোযোগ দেন গদ্য রচনায়। পুশকিনের প্রায় প্রতিটি রচনারই ইংরেজি অনুবাদ করা হয়েছে। তাছাড়া বিশ্বে প্রচলিত প্রধানতম ভাষাগুলোর প্রায় প্রত্যেকটি ভাষায়ই পুশকিনের রচনার অনুবাদ পাওয়া যায়। পুশকিনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ইয়েভজেনি ওনেজিন’কে রুশ সাহিত্যের মাইলস্টোন গণ্য করা হয়। এই উপন্যাসে তিনিই প্রথম রিয়েলিজমের সার্থক প্রয়োগ ঘটান এবং বাস্তব কাহিনিভিত্তিক উপন্যাস রচনার পথনির্দেশ করেন। এ কারণেই পুশকিনকে আধুনিক রুশ সাহিত্যের জনক বলা হয়।  পুশকিন দ্বারা প্রভাবিত হননি এমন লেখক রুশ সাহিত্যে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ‘ম্যাসেঞ্জার অব ইউরোপ’ এবং ‘রাশিয়ান অ্যান্ড লুইডম্যান’ তার উল্লেখযোগ্য দুটি কাব্যগ্রন্থ। বিশ্বসাহিত্যে অগাধ জ্ঞান থাকায় পুশকিন অনায়াসেই রুশ কবিতাকে বিশ্বের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। পুশকিনের সময়কে বলা হয় রুশ কবিতার স্বর্ণসময়। তার অসংখ্য কবিতা রুশ তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল, এখনও বিশ্বসাহিত্যের তরুণ পাঠকদের কাছে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।

পুশকিনের সময়ে রাশিয়ায় রাজতন্ত্র প্রচলিত ছিল।  কিন্তু পুশকিন এই রাজতন্ত্রকে ভালো চোখে দেখেননি। তিনি এর বিরুদ্ধে কলম তুলে নেন। রাশিয়ার রাজতন্ত্রে জারের রাজনৈতিক পুলিশের কঠোর নজরদারিতে যখন প্রকাশনা কঠিন ছিল, ঠিক তখনই পুশকিন নিজের জনপ্রিয়তম নাটক ‘বরিস গদুনভ’ রচনা করেন। পুশকিন তখন রাশিয়ায় এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে তাকে সম্রাট প্রকাশ্যে কিছু না বলে আমৃত্যু তার পেছনে গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছিলেন, এমন-কি তার ব্যক্তিগত চিঠিপত্রও গোপনে খুলে পড়া হত। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে তাকে সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে বন্দী করে দক্ষিণ রাশিয়ার একটি দুর্গম অঞ্চলে নির্বাসনে পর্যন্ত পাঠানো হয় কিছুকালের জন্য।

রুশ সাহিত্যে নাট্যকার হিসেবেও শক্তিশালী একটি অবস্থান আছে পুশকিনের। যদিও নাট্যকার হিসেবে অ্যান্তন চেখভের অবস্থান রুশ সাহিত্যে সবার ওপরে, তবু পুশকিনের নাটকও সেখানে অত্যন্ত সমাদৃত। পুশকিন সাহিত্য বিষয়ক সাংবাদিকতার সাথেও জড়িত ছিলেন, রুশ ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রে তিনি সাহিত্য সম্পাদনাও করেছেন।

পুশকিন ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অসুখি, অস্থির। তারুণ্যে তার বোহেমিয়ান জীবনাচরণ, পানাসক্তি ও বহুগামিতার কথা সর্বজনবিদিত ছিল। কিন্তু নাতালিয়া ইভানভনা গনচারভা নামের অসাধারণ এক সুন্দরী নারীকে বিয়ের পর তিনি সংসারী ও সুখি হতে চেয়েছিলেন। নাতালিয়াকে ভালোবেসেছিলেন মন-প্রাণ উজাড় করে। কিন্তু নাতালিয়া অন্য পুরুষে অনুরক্ত ছিলেন, ছিলেন উচ্চাভিলাষী ও বিলাসপ্রিয়। ফলে পুশকিন দারিদ্র্যে নিপতিত হন এবং পারিবারিক অশান্তিতে ভুগতে থাকেন। একসময় তিনি জর্জ দঁত্যা নামের জনৈক ফরাসি কবিকে নাতালিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্য ডুয়েলে আহ্বান করেন। এভাবে একে একে ২৯টি ডুয়েল লড়েন পুশকিন তার মাত্র ৩৮ বছরের জীবনে। ১৮৩৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পুশকিন শেষ দ্বন্দযুদ্ধে লড়েন স্ত্রী নাতালিয়াকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে ফরাসি সামরিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিক জর্জ চার্লস ডি হেপোরেনের সঙ্গে। এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে তিনি মারাত্বকভাবে আহত হন এবং দুদিন পর নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। প্রেম যে মানুষকে অন্ধ করে তোলে, পুশকিনের মত একটি প্রতিভার এই করুণ পরিণতি সে কথা আরেকবার বিশ্ববাসীর কাছে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

***********************************

শিল্পী নাজনীন: কবি ও গদ্যলেখক

===========================