You are currently viewing ‘আমি ঘৃণা করি স্বাভাবিক জীবনাবস্থা’/ ওমর কায়সার

‘আমি ঘৃণা করি স্বাভাবিক জীবনাবস্থা’/ ওমর কায়সার

‘আমি ঘৃণা করি স্বাভাবিক জীবনাবস্থা’

ওমর কায়সার

১৯৮৪ সালের একটা দিন। নন্দন কাননের বোস ব্রাদার্সে আমি আর শাহিদ আনোয়ার বসে আছি। সামনের টেবিলে দুই কাপ ধুমায়িত চা। তবে আমাদের নজর কাচের দেয়ালের বাইরে। দুজনে দেখছি কাটাপাহাড়ের ঢালু, রাইফেল ক্লাবের চড়াই বেয়ে, বৌদ্ধ মন্দির সড়ক আর  টেলিগ্রাফ, টেলিফোন অফিসের দিকে রিকশা ট্যাক্সি আসা যাওয়া করছে।  লুঙ্গি পরা, প্যান্ট পরা মানুষ আসছে আর যাচ্ছে স্বাভাবিকভাবে নিয়মে। এই স্বাভাবিকতাকে আমরা দুজন কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।কিন্তু কেন?

আমাদের স্বপ্ন ছিল অন্যরকম। আমরা ভেবেছিলাম অনেকদিন থেকে দেখা গতানুগতিক একগেঁয়ে জীবনের  ইতি হবে। যা দেখে অভ্যস্ত আমাদের চোখ, তা থেকে ভিন্ন একটা কিছু দেখব। মনে করেছিলাম জোর করে ক্ষমতায় আসা স্বৈরশাসকের ওপর একটা আঘাত আসবে। কিন্তু তা হয়নি। টানা আটচল্লিশ ঘণ্টা হরতালের পর পত্রিকার পাতায় খবর এসেছে – ফিরে আসছে স্বাভাবিক জীবনাবস্থা। এতে আমরা খুব হতাশ। ভেতরে ভেতরে রাগও হচ্ছে খুব। সারা দেশে সফল ৪৮ ঘণ্টা হরতাল হলো। কিন্তু তাতে কিছু এসে গেল না যেন কারও। শাহিদ আমাকে বলল, চল আমরা একটা কিছু করি। আমারও খুব একটা কিছু করতে ইচ্ছে করছিল — জানতে চাইলাম, কী করা যায়। আমরা দুজনেই জানতাম — আসলে আমাদের কিছুই করার ছিল না। কিন্তু ব্যাপারটি মেনে নিতে পারছিল না সে। আমার চাইতে শাহিদের আবেগ বেশি, তেমনি কোনো কিছুতে অতিপ্রতিক্রিয়া ঘটত তার মধ্যে। স্বপ্নও দেখত খুব সহজে, আর তা ভেঙে গেলে কষ্ট পেত খুব। রেগে গিয়ে সে আমাকে বলল — আই হেট দিস সো কলড স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।

বললাম, চল আমরা আপাতত আমাদের আবেগগুলো লিখে ফেলি। ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা আমরা শেষ করে দুই মিনিটে বোস ব্রাদার্সের কাছে আমার বাসায় চলে এসেছিলাম। শাহিদ আমার কাছ থেকে কাগজ নিয়ে লিখতে শুরু করল তার ঘৃণা, ক্ষোভ আর দ্রোহের কথা  এবং তা কবিতায়। একটানে অনেক দূর লিখে ফেলল —

পায়ে পায়ে ফিরে আসছে স্বাভাবিক জীবনাবস্থা

এ টেবিল সে টেবিল সমস্ত টেবিল ফাঁকা

আমি একা এখনো আসেনি কেউ

এক কাপ চা খাচ্ছি স্বাভাবিক জীবনের অংশ হিসেব

অতএব

পায়ে পায়ে ফিরে আসছে স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।

……….

আই হেইট

এই রক্ত পুঁজময়, কালো ফোসকাবৃত

ব্যথায় কঁকিয়ে কাতর এই স্বাভাবিক জীবনাবসথা

রজঃস্রাবের মতো, থুতু ও কফের মতো

ব্যথা–ভারাতুর জোড়া নীলাভ চোখের মতো

এই বাতিল জীবন

আমরা চাইনি ফেরৎ পেতে

চাইনা ফেরত পেতে।  (আটচল্লিশ ঘণ্টা একটানা হরতালের পর ফিরে পাওয়া স্বাভাবিক জীবন)

 জীবনের কষ্টদায়ক যাপন থেকে, চারপাশের ঘটনা থেকে, পরিবেশ প্রতিবেশ থেকে এই ভাবে একের পর এক কবিতা উঠে আসছে শাহিদের কলমে। আশির দশকের কবিতার কোলাহলের ভেতর হঠাৎ যেন বঙ্গোপসাগরের তীর থেকে অন্যরকম একটা সুর বেজে উঠল। আর আমরা তার বিমুগ্ধ শ্রোতা। প্রতিটি সুরের জন্মযন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করেছি, দেখেছি, শুনেছি তার প্রথম কান্না। হয়তো সারারাত জেগে শাহিদ কবিতা লিখেছে তার ফিরিঙ্গি বাজারে কবিরাজ ভবনে। ভোরে উঠে মুখে একটু পানি দিয়ে চলে এসেছে আমার নন্দনকাননের বাসায় কবিতাটি শোনাবে বলে। রাতজাগা হাতের লেখাগুলো দেখলে আমার মনে হয় যেন প্রাচীন কোনো পাণ্ডুলিপি আমাকে উদ্ধার করতে দিয়েছে। হাতের লেখার জন্য তাকে কতবার বকা দিয়েছি। এমন হাতের লেখায় এই ছেলে এসএসসিতে মানবিক বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে সারা বোর্ডে প্রথম, এইচ এস সিতে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়েছে কেমন করে? এসব কথায় শহীদ লজ্জায় লাল হয়ে যেত। বলত —  কবিতা ঘোরের মধ্যে লিখি, পরীক্ষার খাতা লেখার সময় সচেতন ভাবে লিখতাম, এত বিশ্রী হতো না। বলেই হো হো করে হাসত, আর আমার কাছ থেকে কাগজটি নিয়ে পড়তে শুরু করত কবিতা

আমি বখে যাওয়া ছেলে, আমি ঢিল ছুঁড়ে মারি

মাছি ভন ভন এই রোঁয়া ওঠা জেনারেল যদি নাড়ে ল্যাজ

সেলিনা আখতার তুমি প্রস্তুত রেখো, দেখো ভুলো না আবার

প্রিয় নীল শাড়িটির নীল আঁচলের কাটা নীল কিছু ব্যাণ্ডেজ। (আকাশের দিকে ওড়ে লাল মাফলার )

সেলিনা আখতার প্রস্তুত ছিল, বখে যাওয়া ছেলেটির সঙ্গে জীবনের বন্ধনে জড়িয়ে গেছে। সেই বন্ধনের গল্প আরেকদিন হয়তো পাঠককে শোনাব। কারণ এই গল্পের সঙ্গে আমিও জড়িত। শাহিদের জীবনের প্রায় প্রতিটি বাঁকে আমার উপস্থিতি ছিল আশ্চর্য নিয়তির মতো। বন্ধুতা আসলে এরকমই হয়। গাড়ির চাকার মতো, একসঙ্গে সবগুলো চলে। আবার একটা অচল হলে অন্যসবও অচল হয়ে যায। আমরা এমনই ছিলাম একজন আরেকজনকে ছাড়া চলতে পারতাম না। আমাদের একটা দিনও যেত না যদি কাউকে না দেখি। বিশেষ করে বিশু (বিশ্বজিৎ চৌধুরী) শাহিদ, অজয় (অজয় দাশ গুপ্ত) আর মুসার (আবু মুসা চৌধুরী ) সঙ্গে দেখা হতেই হতো। আমাদের আড্ডার কেন্দ্র বোস ব্রাদার্স থেকে একশ দেড়শ গজ দূরে আমার বাসা। তাই ওখানে কেউ না থাকলে সবাই আমার বাসায় আসত। বোস ব্রাদার্সের দিনগুলো পেরিয়ে আমরা এখন অনেক দূর চলে এসেছি। আমার বন্ধু শাহিদ আনোয়ারকে আমি এখন গত প্রায় একবছর ধরে দেখি না।  করোনার সংঘনিরোধকাল আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। সে হাসপাতালে শুয়ে থাকে দিনরাত। হাঁটাচলা দূরে থাক, নড়াচড়াও করতে পারে না।

শাহিদ স্বপ্ন দেখত — একদিন এই পৃথিবীতে সাম্যবাদের বিপ্লব এসে পুঁজিবাদের সকল ষড়যন্ত্র, কৌশলকে নস্যাৎ করে দেবে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার যুক্তি তার মুখ থেকে উচ্চারিত হতো প্রিয় সব কবিতার মতো, সে মানুষ এখন নির্বাক। হাসপাতালের শয্যায় তার পাশে গিয়ে দাড়িয়েছিলাম, তার চোখ বলছে সে আমাকে চেনে।  তার চোখ বলছে —  আমি তোকে ভালোবাসি কায়সার।  কিন্তু সে তা উচ্চারণ করতে পারছে না। আমি আর বেশিক্ষণ ওখানে দাঁড়াতে পারি না, দাঁড়ালে বন্ধুকে শ্রুশ্রষা দিতে না পারা আর সুস্থ করে তুলতে না পারার অক্ষমতা আমাকে চাবুক দিয়ে মারে। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। আমি দৌড়ে বেরিয়ে আসি। আমাদের সকল ব্যাকুলতা, আগ্রহ, অনীহা, কৌতুহল, ইচ্ছা অনিচ্ছা, জীবন যাপন, সমাজ, রাজনীতি, কুটনীতি, মানুষের কপটতার কথা যার কবিতায় অভিনব ভাষায় উঠে আসত, সেই কবির হাত এখন অচল।  বাংলার সমাজ আর কবিতার একসঙ্গে পালাবদল ঘটানোর এক অকল্পনীয় ভাবনা কাজ করত শাহিদের ভেতরে।

সমাজকে পাল্টাতে পারেনি, কিন্তু বাংলা কবিতার পুরোনো আবরণে সে যুক্ত করেছে নতুন নকশা, নতুন রঙ। সেই কবি এখন কী শুধু বেঁচে আছে কেবল নিঃশ্বাস নিতে ? এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই।

সমাজ, রাজনীতি, মানুষের অচল অবস্থা শাহিদকে বিচলিত করত, ব্যথিত করত, এসবের বিরুদ্ধে কথা বলত, কলম ধরত। আজ সে নিজেই অচল হয়ে আছে। হাসপাতালের শয্যা ছেড়ে সে কী আর হাসপাতাল নিয়ে কবিতা লিখবে না? এর আগেও তাকে একবার হাসপাতালে যেতে হয়েছে, ফিরে এসে লিখেছিল বুক বিদীর্ণকরা পংক্তিসব

সিরিঞ্জভরা দুঃখ দিলে হাসপাতালের শুভ্র নার্স

দুঃখ দেওয়ার ভঙ্গিমা তোর

ভুলতে তবু পারবো না

………………………

………………………

বাঁচতে চাওয়ার প্রার্থনাকে উপড়ে নিলে শুভ্র নার্স

উপড়ে নেওয়ার ভঙ্গিমা তোর

ভুলতে তবু পারবো না। (নার্স )

একটা পর্যায়ে এসে শাহিদ তার কবিতা আর জীবনকে সমার্থক করে ফেলেছে। ভাবনার প্রতিটি মুহূর্ত, জীবনের সব ঘটনা তার কবিতায় প্রতিফলিত হতে থাকল। বিশেষ করে কুকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভের প্রায় সব কবিতা হয়ে উঠেছে তারই জীবনের এক শৈল্পিক ধারাবর্ণনা।

শাহিদ থাকত ফিরিঙ্গিবাজারের কবিরাজ ভবনে। অধুনা বিলুপ্ত এই ঐতিহ্যবাহী এই ভবনটির তখন শেষ অবস্থা। এর চুনচুরকি, পলেস্তারা খসে পড়ছিল। ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যের এই অনুপম নিদর্শনটি আমরা রক্ষা করতে পারিনি। এর ধ্বংসস্তুপের ভেতর উঠে গেছে নতুন বাণিজ্যিক ভবন। কিন্তু ফিরিঙ্গিবাজারের কবিরাজ ভবন বাংলা কবিতার ঐতিহ্য হয়ে ফিরে এসেছে শাহিদ আনোয়ারের কলমে।

খসে পড়ে পুরোনো পাথর চুন, লোহিত মরিচা

রান্নাঘরে জাগ, থালাবাটি পুরোনো কড়াই

এবড়ো খেবড়ো হয়

স্থুল ভোঁতা কিছু পাথরের পতন শব্দ শুনে জেগে উঠি শেষ রাত্তিরে

কোন অভাগার মস্তক ফেটে ফের রক্ত গড়ালো

ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে শুই। (শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন ১ )

কবিতার পুরোটা জুড়ে জীর্ণ কবিরাজ ভবনের ছবি। চলচ্চিত্রের মতো এমন অনুপুঙ্খ বর্ণনা অনেক গদ্যের মধ্যেও সচরাচর দেখতে পাই না।

নির্লিপ্ত নিরপেক্ষ বর্ণনা পড়তে পড়তে পুরোনো ভবনটির জন্য আমাদের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে।

 দেয়ালে বাঁধুনি নেই, গাঁথুনির চুন আর সুরকিরা কবে গেছে ম’রে

পুরোনো ইটের সাথে মৃত ইট আজো আছে দাঁড়িয়ে কী–করে

–এক বিষ্ময়

শুধু ভাঙা–চোরা নিষিদ্ধ ছাদে

’টি নির্বাক ঘৃতকাঞ্চন

রোদ খায়, ঝড়–বৃষ্টি খায়।  (শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন ১ )

শুধু এই কবিরাজ ভবন নয়, এই ভবনের মানুষগুলোও কবিতায় জায়গা করে নিয়েছে। যে কয়টি বাংলা কবিতা আমার খুব প্রিয় তার মধ্যে শাহিদের প্রতিবেশিনীর জন্য এলিজি কবিতাটি অন্যতম।

যখন বাসায় গেলাম

তুমি হাসপাতালে

যখন সমস্ত কেবিন খুঁজে কর্তব্যরত ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি

তুমি পরলোকে

ফের বাসায় গেলাম

তুমি চিতায়

এবং যখন চিতায় গেলাম

তুমি পুড়তে পুড়তে অঙ্গার

শুধু দুটি পোড়া পায়ের পাতা

দেখতে পেয়েছি

পরক্ষণে

তুমি পা গুটিয়ে নিয়েছ। (প্রতিবেশিনীর জন্য এলিজি)

শ্মশানের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছেন শাহিদের প্রতিবেশি আঁখি দাশগুপ্ত। কিন্তু তিনি বাংলা কবিতায় বেঁচে থাকলেন একজন  প্রতিবেশী কবির কল্যাণে। আঁখির সঙ্গে শাহিদ আনোয়ারের কী সম্পর্ক ছিল? সেটার উত্তর আসলে সে নিজেও জানত না।

ভালোবাসা বলতে যা বোঝেন বিজ্ঞ লোকেরা

ওরকম কিছুই ছিলো না

তবে

কি যে ছিলো

দাঁড়াও আঁখি

আজকের মেঘলা রাতের সাথে

পরামর্শ করি! (প্রতিবেশিনীর জন্য এলিজি)

 আমাদের চেনা পৃথিবীটা,  মনের সাধারণ ভাবনাগুলো অসাধারণ কবিতার পংক্তি হয়ে তার কবিতায় ঠাঁই পেত। হাসপাতালে শুয়ে থাকা নির্বাক শাহিদ আনোয়ারকে নিয়ে যখন লিখতে বসলাম তখন আমি কিছুটা খাপছাড়া। এত স্মৃতি এত কথা, এত দিন এত রাত আমার মধ্যে ভিড় করছে, আমি কোনটা রেখে কোনটাকে ধরে রাখি, কোনটার বিবরণ দেব বুঝতে পারছি না। আমি শুধু তার কয়েকটি কবিতার পটভূমি, যেগুলোর সঙ্গে আমার স্মৃতি আছে তা ধরিয়ে দিচ্ছি আজ।

একদিন আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে ফিরছি ট্রেনে করে। আমাদের সময় প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা কোনো স্টেশন ছিল না। আমাদের দুজনের মুখোমুখি সামনের সিটে বসেছে একজন সুন্দর এক শিক্ষার্থী। শাহিদ একবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমার  কানে কানে বলল — যাক জার্নিটা সুন্দর হয়ে গেল।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, সামনাসামনি বসলেই কি জার্নি  সুন্দর হয়ে যায়!  সাহস থাকলে কথা বলে দেখা।

সে সরাসরি বলল, সে সাহস আমার নেই।

সেই সুন্দরী আমাদের সামনে এতটাই দ্যুতি ছড়ালো যে আমরা দুজনেই কেমন জানি বাকহারা হয়ে গিয়েছিলাম। দুজনের বেশি কথা তেমন বলিনি। কিছুক্ষণ পর শাহিদ আমাকে বলল — দোস্ত একটা সংযোগ তৈরি হয়েছে। আমি জানালা দিয়ে তাকাচ্ছি, সেও তাকাচ্ছে, আমি গাছপালা, প্রকৃতি দেখছি, সেও দেখছে।

আমি শাহিদের বোকামি, পাগলামি দেখে হাসছি। তখন জানতাম না এই পাগলামিটাই আসলে কবিতার এক অনবদ্য রসায়ন। পরের দিন বোস ব্রাদার্সের আড্ডায় চলে এল তার কবিতা

আমার সমুখে এক রূপবতী তরুণীর মুখ

রেলওয়ের কল্যাণে হয়ে আছি অদ্ভুত সমুখ

একই জানালা পথে করে আছি দৃষ্টি পাচার

বাইরের নদী পাখি দূরগামী টেলিগ্রাফ তার

মেঘের সোনালি বাহু, আকাশের নীল দরিয়ায়

আমি তো রয়েছি চেয়ে, সেও বুঝি তাহাদেরই চায়। (স্বর্গীয় রেল )

দ্রোহ এবং প্রেম, বিপ্লব এবং ভালোবাস এদুটো বিপরীতমুখী বিষয়ের আশ্চর্য সহঅবস্থান আমরা লক্ষ্য করি শাহিদ আনোয়ারের কবিতায়।

একই সময়ে সে উচ্চারণ করছে —

আন্দোলনের ঐরাবতে কপালে লাল সিঁদুর পরাও, মাহুত হে

জমাট হাড়ের ওই পাহাড়ের মর্মমূলে হঠাৎ যাতে ধস নাবে

নষ্ট ভিটির কষ্টখানি সারিয়ে তোলো নম্র হাতের ছাপ বিছায়ে মাহুত হে

আঁকতে হবে, টকটকে লাল সিঁদুর ফোটা, ইতিহাসের রাঙা মেঘের প্রস্তাবে। (আকাশের দিকে ওড়ে লাল মাফলার )

একদিকে স্বৈরাচারের পাহাড় সমান ভিতের ধস নামাতে আন্দোলনের ঐরাবতের কপালে লাল সিঁদুর পরানোর আহ্বান কবির, অন্যদিকে আরেক কবিতায় দেখি  আশ্চর্য এক ঘোরের ভেতর সে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এক মায়াময় জাদুর জগতে।

একটানা

       অন্ধকারে

                সটান

                       সিঁড়িপথে            

                                  কখনো

                                            মধ্যরাতে

ব্যাকুল মিনতি ঝরে, টুপটাপ শিশিরের মতো

ঘুমের বাষ্প ফুঁড়ে ঠিকরোয় লাল লণ্ঠন

উদ্বিগ্ন রমণীর চোখে চোখ

রক্ত মাখানো ধাপে ম্লান হাসে বিষণ্ণ মাতাল।  (শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবন ২ )

যৌবনের আবেগ, প্রেমিকের কাতরতা, বিপ্লবীর সমাজ বদলের স্বপ্ন, দ্রোহীর ক্ষোভ, সুফির ধ্যান সবকিছু মিলিয়ে শাহিদ আনোয়ারের কবিতা। কিছু কিছু কবিতায় নিজেকে নিজের থেকে আলাদা করে ফেলেন শাহিদ আনোয়ার। নিজেকে নিজেই সে বলে

যুবক– আলোড়িত হও, তবে প্লাবিত হয়ো না

কিংবা প্লাবিত হও, তবে ধস নামতে দিও না

কিংবা ধস নামুক, তবে যেন চিহ্ন না থাকে

অথবা নিশ্চিহ্ন হও তবু তার দৃষ্টি অপলক

কোরো না প্রত্যাখ্যান

(যখন তাকিয়ে থাকো অপলক)

বিপ্লবী শাহিদ আনোয়ার এবং কবি শাহিদ আনোয়ার দুজনের মধ্যে একটা বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। বিপ্লবের যে স্বপ্ন সে দেখত তার বাস্তবায়ন একার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়, তার জন্য সাংগঠনিক কাঠামোর অধীনে এসে একটা মানুষকে কর্মী হয়ে কাজ করতে হয়। সেটা করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু তার জন্য জীবনের যে শৃঙ্খলা দরকার, দলের যে শৃঙ্খল গলায় পরতে হয়, তা সে পারেনি তার কবিসত্তার কারণে। আবার প্রথাগত সমাজের নিয়মকানুনের প্রতিও তার তেমন শ্রদ্ধা যৌবনকালে ছিল না। প্রচলিত ধ্যান ধারণা, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা থেকে শুরু করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সবকিছুর প্রতি ক্রমশ সে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। এ কারণে পুরো শিক্ষা বোর্ডে মেধাতালিকায় শীর্ষে অবস্থান করেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্যারিয়ারের প্রতি মনযোগ দেয়নি। ছাত্র হিসেবে সে কেমন মেধাবী ছিল সেটা পাঠক অনায়াসে বুঝতে পারবে একটা ঘটনার কথা বললে। আমরা তখন চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছি। আমাদের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমি আর শাহিদ ছিলাম এফ সেকশনে। দুজনের বিষয়ও এক ছিল। পরীক্ষার পর পর ইসলামের ইতিহাস পরীক্ষার রেজাল্ট বলবে স্যার। উনি আগে থেকে ঘোষণা দিয়েছেন, প্রত্যেকের খাতা নিয়ে আলোচনা করবেন। স্যার এসে আমাদের সবার উত্তরপত্রের সাধারণ ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা করলেন। কীভাবে ইতিহাসের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, তার কিছু কৌশল বাতলে দিলেন। সব শেষে স্যার বললেন, শহীদুল ইসলাম (শাহিদ আনোয়ার) কে? শাহিদ সেদিন ক্লাসে ছিল না। আমি তো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। না জানি শাহিদ ফেল করল কিনা। স্যার বললেন, ওকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো। তোমরা সবাই বাংলায় উত্তরপত্র লিখেছে, এই ছেলেটি লিখেছে ইংরেজিতে। আমি অনেকদিন ইতিহাসে এমন সুন্দর উত্তরপত্র পাইনি। প্রথম বর্ষে সতর্ক থাকার জন্য আমরা কম নম্বর দিই।তারপরও তাকে আমি ৭২ নম্বর দিয়েছি। ইতিহাসে সত্তরের উপরে নম্বর পাওয়া আমাদের সময় তখন অকল্পনীয় ব্যাপার।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সসহ এম এ পাশ করেছে, সাংবাদিকতা করেছে, অধ্যাপনা করেছে ঠিকই। কিন্তু শাহিদ আনোয়ার মনে করত নতুন শতাব্দীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় বিপ্লব হবে। সমাজতন্ত্র কায়েম হবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে। কিন্তু  তার আগে ৮০ দশকের শেষের দিকে আমরা পেরেস্ত্রইকার কথা শুনতে শুরু করি। ৯০ দশকের শুরুর দিকে ১৯৯১ সালে গর্বাচেভ, ইয়েলসিনদের হাত ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়। এই ভেঙে পড়াটা আমাদের অনেকের মনকে ভেঙে দিয়েছে। বেশি ভেঙে পড়েছিল বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা কবি শাহিদ আনোয়ার।

বৈশ্বিক, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক হতাশাগুলো নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এরকম এক হতাশার সময়ে শাহিদ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখি তার অসুস্থতা শরীরে নয়, মনের রোগেই তাকে বেশি কাবু করেছে। আমি তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম এই বন্ধুকে ফেরাতে হবে। যেভাবেই হোক তাকে একটা সুখবর দিতে হবে এই মুহূর্তে। আর আমি জানি সামান্য পাওয়াতেই সে কত খুশি হয়ে যায়। আমি তাকে বললাম, কীরে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকলে হবে? তোর তো অনেক কাজ। তোর কবিতার বই বের করব আমি। কবিতার কাগজ মধ্যাহ্ন কবিতার বই বের করবে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আয়। পাণ্ডুলিপি তৈরি কর। দারুণ কাজ দিয়েছে আমার এই কথাগুলো। শাহিদ সত্যি সত্যিই হাসপাতাল থেকে ফিরে বিপুল উৎসাহ নিয়ে পাণ্ডুলিপি তৈরি করে। আমার সম্পাদিত কবিতার কাগজ মধ্যাহ্নর পক্ষ থেকে একটিই বই বের হয়, সেটি শাহিদ আনোয়ারের ‘কুকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে’। আর এটি প্রকাশ করতে পারার প্রশান্তি আজও আমার ভেতরে পুলক জাগায়।

শাহিদের কবিতার বই চারটি। শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে, কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে, দাঁড়াও আমার ক্ষতি এবং বৈদেহী এক ওষ্ঠ পোড়ে।

শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে পড়ার পর মনে হয় একটি দীর্ঘ স্বরবৃত্তে লেখা একটি সুদীর্ঘ কবিতা শেষ করলাম। এখানে শিরোনামহীন প্রায় ৫০টি পদ্য আছে। প্রত্যেকটি পদ্যের শুরু ‘শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে’ দিয়ে। স্বরবৃত্তে নৃত্যরত ছন্দের লাগাম ধরতে গভীর ভাববাহী ভারী শব্দের ব্যবহার কবিতাগুলোকে নিয়ে গেছে আমাদের এক অপার্থিব জগতে। সেখানে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা যুবকটি নেই। এ যেন আরেক জন,  শুঁড়িখানার নেশার ভেতর প্রেমমগ্ন এক মানুষ।

শুড়িখানার নুড়ির মধ্যে

একটি গোলাপ ফোটে

একটি রেণু গর্ভে আমার

একটি রেণু ঠোঁটে।

একটি রেণু যাচ্ছে উড়ে

কালের বাড়ি পার

পানপাত্রে বাচ্চা বিয়োয়

মাতাল অন্ধকার। (শুড়িখানার নুড়ির মধ্যে)

একই ছন্দে, একই কথায় শুরু প্রতিটি পদ্যের শেষে দারুণ একটা ধাক্কা পাঠক অনুভব করেন এই কাব্যটিতে।

জোছনা জাগায় মদ্য তাজা

নেশার কাব্য ঘোর

রাতের শরীর দাফন করে

আকুল হলো ভোর।

শাহিদ আনোয়ার পুরোপুরো পাল্টে গেল ‘দাড়াও আমার ক্ষতি’ তে এসে। তার চিন্তা, দর্শনগুলো কাব্যরূপ পেয়েছে। এই বইয়ে কখনো পার্থিব আবার কখনো অতিন্দ্রীয় চেতনায় আমাদের নিয়ে যায় অলৌকিক জগতে। বাস্তবতা আর অবাস্তবতার সীমারেখা মুছে দিয়ে অন্যএক মায়ার জগতে তার বিচরণ।

এক ঐশী, ক্লান্তিকর, অভ্রের অনুভূতি

আমার দু’চোখে মেলেছে ডানা–

ঈশ্বর

আমার এই পঙ্গু, নুলো, নশ্বর হাতের মুঠোয়

তোমার ঠিকানা

( এক ঐশী)

 

পিপাসা মেলেছে ডানা

অস্পষ্ট স্বরে

অচেনা বালিকা ফুল

ফোটে থরে থরে

এ কেমন মনোভাব

জাগালে ঈশ্বর

অযুত সংসার গড়ি

মনের ভিতর। (পিপাসা মেলেছে ডানা)

এই বইতে এসে দেখি কবি অনেক সংহত, দ্বিধাহীন, যে কোনো বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত স্থির এবং পরিণত। কবি আবেগহীন এবং দৃঢ় কণ্ঠে তার মতামতের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। কবি বলছে

পৃথিবী নামের নীল গ্রহটায় স্বর্গের চেয়ে

কয়েকটি স্বাদ বেশি

এখানে মায়ামমতার শেকড়, কাণ্ড, ডালপালা

লতা, বৃক্ষরাজি, বন উপবন, বনস্থলীর আঁকশি জন্মায়

আমার শিশুপুত্র এখন বড় হচ্ছে পৃথিবীতে

( স্বর্গকাতর নই আমি)

নিজে নিজে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলো কবি। এরকম বহু বিষয়ে তার বিবেকের, চিন্তার একটা অবস্থান কবি এখানে ঘোষণা করে। অবশ্যই সেটি কবিতার নান্দনিকতার সকল শর্তকে মেনেই। ছন্দের বন্ধনের ভেতর থেকে তার সীমাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার দারুণ ক্ষমতা তার কবিত্বে। সব রকমের ছন্দের ছকে শব্দ নিয়ে খেলেছে তুখোড় শাহিদ আনোয়ার। আর পদে পদে অন্ত্যমিলের চমক সে সবসময় দিয়েছে। আবার গদ্যেও কবিতাকে নিয়ে গেছে সাবলীলভাবে। কখনো কখনো ছন্দকে ভাঙার সাহসও করেছে। তার ভাবনার সঙ্গে কেউ একমত হোক না হোক, কিন্তু কবিতা হিসেবে সেগুলো শৈল্পিক উৎকর্ষতার শীর্ষে উঠে পাঠক অন্যরকম এক অনুভূতির অভিজ্ঞতা পায়। ‘কুকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভের কবি এখানে অনেক শান্ত। ক্ষোভ নেই, দ্র্রোহ নেই, আছে যুক্তি আর দর্শন। আর জগতের অনেক বিষয় নিয়ে তার চিন্তার প্রতিফলন। ব্যক্তিগতভাবে শাহিদ তখন সংসারী। আরেক কবি সেলিনা শেলীর সঙ্গে তার ঘরকন্না শুরু হয়ে গেছে। শাহিদের বিয়ের অনুঘটক ছিলাম আমি। শাহিদ আর সেলিনা দুজনেই আমার বন্ধু। দুজনের পরিণয়ের ব্যাপারটি ঘটিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে ঘটকের কাজ করতে হয়েছে। সেখানে অনেক নাটকীয় ঘটনার স্মৃতি আমাদের তিনজনের মধ্যে আছে। সেলিনা শেলীকে নিয়ে যদি কোনোদিন লিখতে বসি তখন সেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলব। আমরা বরং শাহিদের কবিতা বিষয়ে ফিরে যাই। বলেছিলাম নিজের ব্যক্তি জীবন আর চিন্তাগুলো সবসময় প্রতিধ্বনি হয়েছে শাহিদের কবিতায়। সে যা বিশ্বাস করে, যা চিন্তা করে, যা ভাবে তাই তার কবিতা। শাহিদের কবিতা পাহাড়ের বুক চিড়ে অনায়াসে বেরিয়ে আসা স্বতস্ফুর্ত ঝরনার মতো। কারও আদেশে, পরামর্শে, অনুরোধে সে বানিয়ে কবিতা লিখিনি। অকৃত্রিমতা, মৌলিকত্ব তার কবিতার প্রধানতম গুন। দাঁড়াও আমার ক্ষতিতে আমরা দেখি ব্যক্তি শাহিদ আনোয়ার যে পিতা হয়ে উঠেছে তার অপূর্ব বর্ণনা।

স্যালাং ট্যানেলের নিকষ অন্ধকারে তাকিয়ে আছি

আমি ও আমার বউ

আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে

ট্যাংকে চড়ে আমাদের শিশু

গুচ্ছ গুচ্ছ কৃষ্ণচূড়া আমার চারপাশে

উড়ে বেড়াচ্ছে একদল প্রজাপতি ও ঈশ্বরের দূত

তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে আমাদের শিশু

( আত্মজ)

কবি শাহিদ আনোয়ারকে নিয়ে লিখতে গিয়ে ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ বার বার ফিরে ফিরে আসছে। এর কারণ পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। ব্যক্তি শাহিদ আনোয়ারকে এড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। একই চিন্তাভূমি থেকে আমাদের উঠে আসা। একসঙ্গে থাকা, দিনকাটানো, পড়ালেখা। সেই ১৯৭৫ সাল থেকে। এত দীর্ঘবছর একটা মানুষের সঙ্গে সখ্যতা। আমাদের স্মৃতিটাও তো দীর্ঘ হবে। সেই হাজার দিনের স্মৃতির সামান্যমাত্র এখানে তুলে ধরলাম। আর তার কবিতার কথা বলতে গিয়ে আমি উদ্ধৃতি বেশি ব্যবহার করেছি। আমি চেয়েছি এই লেখার পাঠের ভেতর দিয়ে পাঠক শাহিদের কবিতার ভুবনে প্রবেশ করুক। তা ছাড়া বিশ্লেষণ, আলোচনা, ব্যবচ্ছেদ করে কি সত্যিই পাঠককে মূল কবিতাটির স্বাদ দেওয়া যায়? তার চেয়ে বরং কবিতাটিই পড়ে নিলে হয়। পাঠক পড়ে বুঝুক শাহিদ আনোয়ার আসলে এরকম।

শাহিদের সব কবিতার বইয়ের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে। এই বইয়ের কবিতাগুলোর বেশির ভাগ আশির দশকে। প্রায় সবকটি কবিতার পটভূমির সঙ্গে বন্ধুতার কারণে আমাদের মানসিক সংযোগ ছিল। এই বইয়ের শ্রেষ্ঠ কবিতাটির শিরোনাম ধাত্রী। শুধু এই বইয়ের নয়, আশি দশকে রচিত সেরা বাংলা কবিতাগুলোর একটি। এই কবিতায় জন্মের আকাঙ্ক্ষায় আকুল এক অজাত শিশুর প্রার্থনা শুনতে পাই, যে কিনা শুনেছিল সূর্য, রাত্রি, বিশ্ব দারুণ সুন্দর। সেই সুন্দর পৃথিবীর আলো সে দেখতে চায়, উৎস থেকে উঠে আসতে চায়, মিথ্যা থেকে উঠে আসতে চায়। মানুষের বেঁচে থাকার যে শাশ্বত আবেদন, মুক্তির যে অনাবিল আনন্দ তা এই কবিতা পড়ে অনুভব করি আমরা। মানুষের জীবন যে কত প্রেরণার, পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই যে কত সুখের তা কবিতাই এক মানুষের জন্ম নেওয়ার কাতরতা থেকেই আমরা বুঝতে পারি। জীবনকে মাতৃগর্ভ থেকে প্রত্যক্ষ করার এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা শাহিদ আনোয়ার বাংলা কবিতার পাঠকদের দিয়েছে। আসুন আবার সেই অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করি।

কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে

ধাত্রী আমার মুক্ত কখন করবে?

 শুনেছিলাম সূর্য দারুণ সুন্দর

শুনেছিলাম রাত্রি দারুণ সুন্দর

শুনেছিলাম তোমার ওমুখ সুন্দর

বন্ধ চোখের রন্ধ্রে আলো ঝরবে

ধাত্রী আমায় মুক্ত কখন করবে?

 জড়িয়ে আছি গর্ভে ফুলে ফুলে

মনোটোনাস রাত্রি ওঠে দুলে

উৎস থেকে আমায় লহো তুলে

স্বপ্ন ছিঁড়ে দোলনা কাছে আনো

ধাত্রী আমার দুহাত ধরে টানো। (ধাত্রী)

 জীবনকে জন্ম নেওয়ার আগে থেকে দেখার এই অপূর্ব কৌশলের কারণে শাহিদ আনোয়ারের কবিতা হয়ে উঠেছে অনন্য। বিষয়ের অভিনবত্ব, ছন্দ, অন্ত্যমিল, শব্দের যথার্থ ও অবিকল্প উচ্চারণ এই কবিতা শাহিদ আনোয়ারকে সমসাময়িক অন্য কবিদের তুলনায় অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।

শাহিদ আনোয়ার আর কবিতা লিখছে না, হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে আছে। চলাচলরহিত বাকরুদ্ধ কবির এরকম অবস্থা মোটেও স্বাভাবিক নয়। এটা আমরা মেনে নিতে পারছি না। আর যারা বয়সের দোহাই দিয়ে, নিয়তির দোহাই দিয়ে বলছেন — এটা স্বাভাবিক, এটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর উপায় কী। আমি তাদের উদ্দেশ্যে শাহিদ আনোয়ারের ভাষায় বলব

আমি ঘৃণা করি … করি… করি এই

স্বাভাবিক জীবনাবস্থা।