You are currently viewing আমার কবিতা  ও কবিতা ভাবনা>  মেহনাজ মুস্তারিন

আমার কবিতা  ও কবিতা ভাবনা> মেহনাজ মুস্তারিন

আমার কবিতা  ও কবিতা ভাবনা

মেহনাজ মুস্তারিন

ঠিক কখন কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম আর প্রথম কবিতাই বা কোনটা, মনে করার চেষ্টা করছি ক’দিন ধরে, হন্নে হয়ে খুঁজছি পুরোনো স্মৃতি। এ ডায়েরি ও ডায়েরি খুঁজে চলেছি।  খুব মনে পড়ে ডায়েরি লেখার নেশা পেয়ে বসেছিল ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়। আমার একমাত্র ভাই বর্ণ। তার কথা এর আগে অনেক  লেখায় উল্লেখ করেছি। অখন্ড অগোছালো এক মানুষ। তাকে ঠিকঠাক করতেই বিধাতা বোধহয় তার ছোটবোন করে আমাকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই সুযোগটা সে নিয়ে গেছে ষোলআনা। ১৯৮৫/৮৬ সালের কোন এক বিকাল। বর্ণর এলোমেলো করে ফেলে রাখা একগাদা বই খাতা গুছাচ্ছিলাম। দেখি, বেশ পুরনো একটা ডায়েরি। কয়েকটা পৃষ্ঠায় হিজিবিজি কীসব লেখা, নীতিবাক্য, দু’চারলাইনের কবিতা কাটাকুটি এইসব। ডায়েরিটা নিজের মনে করে চুপ করে নিয়ে বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখলাম। কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে করলো। কী লেখা যায়, মনে মনে সেটাই ভাবছিলাম, দেখি, একটা বাবুই পাখি ঠোঁটে করে ঘাস-খড় এনে আমাদের টিনের বারান্দার এক কোনায় বাসা বানাচ্ছে। ডায়েরিতে আমি সেই পাখির সাথে কথা বলতে শুরু করে দিলাম। লিখলাম,

একটা বাবুই পাখিকে দেখছি ক’দিন ধরে বাসা বানাচ্ছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই পাখি, আমি তোর বাসা বেঁধে দেব? পাখি আমাকে পাত্তাই দিল না। তাতে কি? আমি কিছু খড়কুটো এনে সে যেখানে বাসা বানাচ্ছে তার তলায় রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম, সেগুলো সব নিয়ে গেছে পাখিটা। খুব মজা পেলাম।

তখন সবে বড় হয়ে উঠছি। কত স্বপ্ন কত কল্পনা মাথাজুড়ে। কত প্রজাপতি পাখা মেলছে। কত রকমের নায়ক মাথায় ঘুরঘুর করছে!  বৃষ্টি হলেই উদাস হতাম, পাখির সুরে সুরে সুর মেলাতাম। গ্রীষ্মে দুপুরের নির্জনতা বড় কাছে টানতো। দেখতাম পাখিরা একটু আরাম পেতে কাছের ডালপালার ফাঁকে তাদের গা এলিয়ে দিয়েছে। বড্ড অবুঝ সময়। কতকিছুই যে ভালো লাগতো, আর কত বোকামি যে এসে ভীড় করতো চিন্তায়, এখন ভাবলে অবাক হই। তবে, একটা কথা বলতেই হয়, আমার ম্যাচুরিটি একটু তাড়াতাড়ি এসেছিল। ইদানীং কালের বাচ্চাদের দেখে আমার সেটাই মনে হয়। কেনই-বা হবে না? যথেষ্ট কারণ ছিল যে! অল্প বয়সে এতসব ধাক্কা সামলাতে হয়েছিল যে এখন চিন্তা করলে অবাক লাগে। অভাব অনটন শিরদাঁড়ায় লেগে ছিল।  যেন জোর করেই গিলিয়ে ফেললো  সবকিছু। সেসময় কোন কিছু দেখবার ভাববার জন্য আলাদা চোখের জন্ম হয়েছিল তা টের পেয়েছিলাম। যে কারো চোখ দেখলেই অনেকটা পড়ে ফেলতে পারতাম তাঁকে।  তো সেই ডায়েরির সাথে শুরু হলো আমার নিত্য কথা বলা। নিত্য চরাচর। প্রতিদিন যখন কেও বাসায় থাকতো না চুপিচুপি লিখতাম। যা মনে চাইতো তাই লিখতাম। সারাদিন কে কী বললো, আমি কী কী করলাম, কোথায় কী কী ঘটলো সবকিছু। সেই সাথে ছন্দ মিলিয়ে দু’এক লাইন কবিতাও লিখে ফেলতাম। এমনকী শামসুর রাহমান, সুনিল, নির্মুলেন্দু গুন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলদের যে কবিতাগুলো আমার ভালো লাগতো, সেগুলো লিখে রাখতাম। তখন মনে হতো, আমার ভালোলাগার ব্যাপার স্যাপার চুপিচুপি লুকিয়ে করতে হবে। লিখা শেষ হতেই চোখের আড়ালে রেখে দিতাম খুব যত্ন করে। কাওকে জানতে দেয়া যাবে না। ওরে বাবা! কেউ জানলে পায়ের তলায় মাটিই থাকবে না, এমন অবস্থা।

তো, একদিন হলো কী, সেটাই বলি। রাতের পড়া শেষে চুপচাপ সারাদিনের জমানো কথা লিখছি। এমন সময় বর্ণর চোখ গেল আমার দিকে। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পাকিয়ে তার জিজ্ঞাসা, ”এই কী লিখছিস? দেখি!”

ও আসলে ভেবেছিল আমি হয়তো কোন প্রেমপত্র লিখতে ব্যস্ত আছি। প্রথমে মনে হলো ওকে দেখাবো না, পরক্ষণেই মনে হলো, আরে এ আমি কী ভাবছি। তো ডায়েরিটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “এই দেখ! প্রেমপত্র!”

বর্ণ খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ল। যখন দেখলো প্রেমপত্র-টত্র না, একেবারে নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা লিখে যাচ্ছি, তখন বললো, ”আচ্ছা, সামনেবার কোথাও থেকে ডায়েরি পেলে তোকে দেব।”

সেই শুরু। এই ফাঁকে একটা সত্যি কথা বলি। আমার এই ভাইটার মতো এত বোনপাগল ভাই আমি দুনিয়ায় দেখি নাই। কোথাও কিছু পেলে ওর প্রথমেই মনে হতো আমার কথা। যাহোক, ও হয়তো এটা ভাবেনি যে, আমি সেসময় থেকেই নানা বিষয়ে খুব গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছি। হয়তো ভাবতো, পিচ্চি একটা মেয়ে, তার আবার ভাবনাজগত!

শুধু যে নিত্যদিনের ঘটনা লিখে রাখা তা তো না, আমার পছন্দের গানও লিখে রাখতাম ডায়েরিতে। তখন রেডিওতে কয়েকটা জনপ্রিয় গানের অনুষ্ঠান ছিল, সন্ধ্যার সময় তেমন একটা অনুষ্ঠানের নাম ছিল ’দূর্বার’; সাড়ে সাতটা বাজলেই ইথারে ভেসে আসতো সুন্দর সুন্দর সব গান। রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, নিলুফার ইয়াসমিন, মাহমুদন্নবী, আব্বুল জব্বার সহ আর কত নামকরা সব শিল্পির গান। রুনার একটা গান খুব মনে ধরেছিল, ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম:

অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে

যেন এক মুঠো রোদ্দুর আমার দুচোখ ভরিয়ে তুমি এলে (২)

কত বেদনার বিষন্ন মেঘে ভেসে ভেসে

এলে তুমি অবশেষে (২)

তাই বাতায়নে

ময়ূরেরও ঝিলিমিলি ঝিলিমিলি

আজ সারাদিন ধরে

আমার দুচোখ ভরিয়ে

তুমি এলে…

আমাদের একতলা টিনের ছাদের বাসার সাথে এই গানটা এত মানিয়ে যেতো যে, মনে হতো রুনা লায়লা বুঝি আমার কথা ভেবেই গানটি গাইছে। তো, কেবল গান লিখে রাখা তো না, সেই সাথে সেগুলো মুখস্ত করা এবং গাওয়ার চেষ্টাও করতাম। গলা মন্দ ছিল না, সেটা হলফ করে বলতে পারি। যেকোন গান তুলে ফেলতে পারতাম। কষ্টের কথা কী বলব? আমাদের ভাঙা ঘরে সৃষ্টিকর্তা দু হাত ভরে দিয়েছিলেন। কিন্তু দিলে কী হবে, সবকিছু ধরে রাখার ক্ষমতা তো থাকতে হবে! তাই হাত বেয়ে পড়ে গেছে অনেক কিছু। পারিনি আঁকড়ে ধরতে। হয়নি তাদের মেলে দেয়া। এখন, আমাদের বাসায় দু’দুটো হারমোনিয়াম। দুটোই আমার মেয়ে মর্মিতার জন্য। একটা এখন ঢাকায়, আরেকটা এখানে রাজশাহীতে। ওর বাবার বড় চেষ্টা মেয়ে ভালো গাইবে। ছায়ানটের ছাত্রী হবার পর্যায়ে যখন গেছে তখন স্বপ্ন থাকাই ছিল স্বাভাবিক।  কিন্তু আমার বেলায় জীবনের পাঠটা অন্য রকম। আমি আমার বাবাকে হারিয়েছিলাম সেই শিশু কালে, তখন আমার বয়স সবে সাত। সেজন্য জীবনের অপূর্ণতাগুলো সবই বাবার কাছে গচ্ছিত আছে। হায়! একটা হারমোনিয়ামের কত সাধ ছিল, কত স্বপ্ন বুনতাম তখন। অন্যের বাসায় রেওয়াজ করতে যেতাম। উহ! সেই যন্ত্রণার দিনগুলো বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে আজও!

তো যা বলছিলাম, সেই ডায়েরির কথা। এরপর যতই বড় হতে থাকলাম, তত বেশি করে এই বোধের জন্ম হল যে, ডায়েরি বা আমার ভালো লাগার বিষয়গুলো লুকিয়ে করার কিছু নাই। প্রতিবছর নতুন ডায়েরি জোগাড় করে নিতাম। আর লিখে ফেলতাম মনের যত কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পড়ার সময় বাবুকে পেলাম সঙ্গী হিসেবে। বিয়ের আগে থেকেই বাবু জানতো আমি টুকটাক লিখি। সেসময় ওকে যে চিঠিগুলো লিখতাম, ক’দিন আগে হঠাৎ করে সেগুলো খুঁজে পেলাম। চিঠিগুলো পড়তে গিয়ে লক্ষ করলাম, একেকটা চিঠি যেন একেকটা গল্প। সেখানে ছন্দ মিলিয়ে কবিতাও লিখেছি। বাবু ঠিক ডিসেম্বরের শেষ দিনে ডায়েরি গিফট করত। এটা ছিল অনেক প্রত্যাশিত এক উপহার, যা জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। তো সেই উপহার পাওয়াটা অনেকদিন অব্যাহত ছিল। ২০০৪ সাল পর্যন্ত আমি নিয়মিত লিখে গেছি। সেসব ডায়েরি, বাবু এবং অন্যান্য বন্ধুদের কাছে লেখা চিঠিগুলো এখনো চমৎকারভাবে সংরক্ষিত আছে। বেশ কয়েকদিন হলো সেগুলো নাড়াচাড়া করছি। যতই দেখছি অদ্ভুত লাগছে, অন্য এক অনুভবে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে  আবারও। ভালো লাগায় ভরে উঠছে মন। চঞ্চল হচ্ছে চিত্ত।

এরপরে লম্বা সময়ের আর কোন খোঁজ নাই। কোথায় হারিয়ে ছিলাম পরের দুই দশক? অবসরে সেটা খোঁজার চেষ্টা করিছি। শুধু মনে হয়, সব ধরনের সামাজিক সম্পর্কের দায়িত্বগুলো যথাযথ পালন করেছি, আর সেই ব্যস্ততার তলায় আমি আমার নিজস্ব সত্ত্বাকে অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছি। এরপরে যখন নিজেকে খুঁজে পেলাম, মনে হলো অনেকগুলো বছর আমি কোথাও নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম। এরমধ্যে চলে গেছে লম্বা কিছু সময়, ঘটে গেছে অনেক কিছু, ভাবতে গিয়ে দেখি মনের কোন কোনায় জং ধরে গেছে অনেক। ভাবছি সময়টাকে যদি কাজে লাগাতাম, যদি সময়ের কোন ডাক আমার কানের কাছে এসে বলতো, ”নিরব কেন তুমি? কিছু তো বলো, কিছু তো লিখো যা তুমি বলতে চাও নিজের মত করে!”

আমার এক কবি বন্ধু এই ডাকের নাম দিয়েছে অভিজ্ঞান। কী কঠিন কথারে বাবা! ব্যাখ্যা চাইতেই উগড়ে দিল সহজ জ্ঞান– অভিজ্ঞতার সাহিত্যিক রূপান্তর হল অভিজ্ঞান। পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি মনে হওয়াটা অভিজ্ঞতা না, সেটা অভিজ্ঞান। কিছু বুঝলাম কিনা তাই তো বুঝলাম না। তা যে নামেই ডাকুক, কান পাতলে আমি এখন সেই অভিজ্ঞানের ডাক শুনতে পাই। নিজের মন নিজেকে সুধায়, ”আর কত সময়ক্ষেপন?”

তারপরেই যেন কবিতার জালে আটকে পড়লাম। শুধু কবিতা তো না, ঠিক যেভাবে একসময় ডায়েরি লিখতাম, সেই একই ছন্দে দেখি গদ্যও এসে হানা দিতে থাকলো। তার দাবিও কম না। কানের কাছে মুখ এনে বলে, “শুরুতে আমরাই ছিলাম, এখন বেছে বেছে কবিতার দিকে পক্ষপাত, মানবো না বলে দিলাম!”

”তোর কি অভিজ্ঞান আছে গাধা?” গদ্যকে শান্ত করতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম।

ওমা দেখি, সে বিন্দুমাত্র দমবার পাত্র না। আমাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ”সাহিত্য লিখবে, নাকি সংবাদপত্রের রিপোর্ট?”

বললাম, “সাহিত্য!”

বলেই বুঝলাম, তার পাতানো ফাঁদে পা দিয়েছি। দেখি সে মোনালিসার ছবির মতো মুচকি মুচকি হাসছে। মোনালিসা হাসে না ভাব মারে সেই ধন্দে দুনিয়া অচল। তো যা হচ্ছে ইদানীং, আমার ঘরে সর্বত্র কবিতা যেন আসন পেতে বসেছে। ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় যাবো, পাতার মর্মর ধ্বনী, পাখিদের কলরব, সকলেই দেখি কবিতার শব্দ উচ্চারণ করছে; সেখান থেকে রান্না ঘরে যাবো চায়ের পানি বসাতে, দেখি বাষ্পের ভেতর থেকে কবিতার শব্দ বের হয়ে আসছে। সকাল থেকে তাই ভাবছিলাম, ঠিক আছে কবিতা-অনুভব-অভিজ্ঞান নিয়ে কিছু লিখব। তাতে করে গদ্যের অভিমানে কিছু জল দেয়া যাবে, আর কবিতা কেন এত জ্বালায় তারও একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যাবে। তো লিখতে বসে দেখি, নানা দ্বিধা-দ্বন্দ কাজ করছে। এই সামান্য যাপনে কিছু লেখার অধিকার আসলে জন্মায় না। আমি সচেতনভাবে জানি, যা লিখছি, কিছুই হয়তো হয় না। দু-একজন সাহস করে সেই কথা বলেও ফেলেছে। তখন মনে হতো, ধুর ছাই, আর না, আমাকে দিয়ে আর যাই হোক, কবিতা হবে না। তারপরও কবিতা পিছু ছাড়ে না। প্রচন্ড জেদি এক কন্যার মতো, যেন আমি তার বাপ, আর তার যত দাবি আমার কাছে। কন্যার সেই জেদের দাম দিতেই হয়তো কবিতা লিখি।  লিখি কি না লিখি, কবিতার মধ্যে ঝুম হয়ে বসে থাকতে কিন্তু বেশ লাগে। রীতিমত একটা নেশার মতো, ফুরফুরে অথচ গাঢ় নেশা। এ যেন মধুর মতো মিষ্টি আর আঠালো যা জলের সাথে মিশ খায় না। কবিতা যে শুধু নেশা নয়, এ যে একটি অবিশ্রান্ত অন্তর্লীন যাপন, অনুভব করছি ক্রমেই ।

ছোটবেলা থেকে  মাকে দেখছি আত্মমগ্ন হয়ে কবিতা পাঠ করতে। কোলে মাথা রেখে বা পাশে বসে শুনেছি কতশত কবিতা। বলে রাখি, আমার মায়েরও ডায়েরি লেখার অভ্যাস, তাঁর ডায়েরি জুড়ে অনেক লেখা, বেশিরভাগই কবিতা। আমার কবিতা ভাবনা আর  মুগ্ধতাটুকু হয়তো মায়ের কাছে থেকেই পাওয়া। কবিতা এমন একটি অনুভব যা গহীন  আঁধারের ভেতর থেকে আনন্দকে খুঁজে বের করে, উজ্জ্বল আলোকিত মুখের ছায়ায় দেখে নীলকণ্ঠ, অথবা বেদনাকে কখনো সখনো জাগিয়ে তোলে নির্ঝরে। মাঝে মাঝে মনে হতো কবিতা বোঝা এত কঠিন হবে কেন? কেন তা সহজবোধ্য হবে না! নিরন্ন মানুষের জন্য লিখব, অথচ তাদের সুখ, দুঃখ, বঞ্চনা অভাব বেদনার কথা জটিল হবে কেন? আমি কঠিনভাবে লিখতে পারি না, যা বলতে  ইচ্ছে করে, যা মনে আসে তাই লিখি।

ইদানীং টের পাচ্ছি অনুভবের ধারণা এখন একটু একটু করে বদলে যেতে শুরু করেছে। মাঝেমধ্যে বেশকিছু জটিল শব্দ মাথার ভেতর ঘুরঘুর করে। তারপরই দেখি, অব্যক্ত ইচ্ছেগুলো ডালপালা সাজাতে শুরু করেছে। এ এক আশ্চর্য চলাচল, যেখানে অবচেতন মন টুক করে এসে শব্দকে ছুঁয়ে দিয়ে চলে যায়। অনেকটা গানের স্বরে শ্রুতির সুর লাগানোর মতো। সহজসাধ্য তো নয়ই, গভীর ও অনন্ত এক সাধনার ক্ষেত্র। তুমুল রহস্যময় এক যাপন, যেখানে সারাজীবন এই জানা-অজানার এক অনন্ত যাত্রায় হেঁটে যেতে হবে! কিন্তু পথ ফুরাবে না। অবচেতন মন থেকে উঠে আসা এই উপলব্ধি ক্রমশঃ নির্জন করে তুলছে আমাকে। কবিতার চেতনে অবচেতনে শ্রুতিতে আমি হারিয়ে যাই স্বপ্নলোকে। সেই সাম্রাজ্যের আমিই অধিপতি, অথচ তার বিচরণে কোন শেষ নাই যেন কোন ঠিকানা নাই তার। আমি চলছি তো চলছি! সেই চলা সবসময় মশৃণ হবে, নিশ্চয়তা নাই। মাঝেমধ্যেই পথটি হয়ে পড়ে কন্টকময়, তখন অন্ধকারের ভিতরে আমি প্রতিনিয়ত খুঁজতে থাকি আলো!  খুঁজতে থাকি একটু বাতাস! খুঁজতে থাকি সূদুর সেই পথ। তখন ভয় করে, মনে হয়, কবিতাগুলো হয়তো হতাশায় হারিয়ে যাবে, তখন আবারও খুঁজতে হবে তাদের। এ যেন, সেই পুরনো ডায়েরির ছেঁড়া পাতা যেখানে সে  রূপকের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল। কোন সাজ ছিল না তার অঙ্গে, তবু কেউ কখনো জানতে পারেনি সেই শব্দের গভীরে লুকিয়ে ছিল না বলা কত ছন্দ কত সূর! কত অনুভব! কত চেতনা!  হয়তো কোনদিন  অন্যকোন ডায়েরির কোন এক পাতায় সে কথা লেখা থাকবে গোপনে যা বলতে চেয়েছি বারবার!

১৮-০১-২০২৩।

**==**==**==**==**==**