You are currently viewing আধুনিকতা ও যুগচেতনার আয়না || পারমিতা ভৌমিক

আধুনিকতা ও যুগচেতনার আয়না || পারমিতা ভৌমিক

আধুনিকতা ও যুগচেতনার আয়না

পারমিতা ভৌমিক

একটা উত্তাল সময়ে সাহিত‍্য বয়ে এনেছিল আধুনিকতার কনসেপ্ট অনেক গ্রহন বর্জনের মধ‍্যে দিয়ে। রবীন্দ্রকাল্ট আর কল্লোলীয় সাহিত‍্য বোধে চাপান উতোর চলেছিল। ছিল টানটান বৈপরীত্যে লেখালেখির সীমাহীন উতরোল।কিন্তু আধুনিকতার সংজ্ঞা আজকেও পুরোপুরি অনির্ধারিত। আমরা সকলেই জানি যে যুগচেতনা ও যুগআনুগত্য এক নয়। আলাদা করে দেখলে ,দেখব এ দুটো মানসক্রিয়াই চেতনা আর আনুগত‍্য একই মস্তিষ্কে থেকেও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অবস্থানে আছে। জীবন সমস্যার সমাধান যে কোনো লেখক যাই দিন না কেন আধুনিক যুগের সমস্যার রূপ কতখানি তার লেখায় প্রতিফলিত হল তা দেখাটাই আসল কথা। কোনো লেখক তাঁর মতো করে তীর্ণতার পথ দেখাতেই পারেন কিন্তু মূল সমস‍্যাকে এড়িয়ে তা হবার জো টি নেই।

ফরাসী সাহিত‍্য যতটুকু জেনেছি তা অনুবাদের মাধ‍্যমেই জেনেছি। তবে সব ক্ষেত্রেই সেই সব অনুবাদকরা অবিসংবাদিত। জেনছি ফরাসি উপন্যাসিকরা যেমন জীবনের ব্যাপক অবক্ষয় ও বিকৃতির চিত্র দিয়েছেন তেমনি এই ব্যাপক অপমৃত্যু বিকৃতির মধ্যেও সুস্থ জীবনের মহৎ আদর্শকেও তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে বলতেই পারি, রমা রঁল্যার “জাঁ ক্রিস্তফ”এর নায়ক যেমন ছিল আদর্শবাদী যুবক।

এই তীব্রযুগ সচেতনতাই আধুনিক পাশ্চাত্য উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই যুগ সচেতনতা থেকেই লেখকেরা যুগের সংশয়ে অবিশ্বাস ও নৈরাশ্যকে উদঘাটিত করেছেন। কিন্তু যুগের এই অবস্থা চিত্রিত করার জন্য লেখক নিজেও সংশয় বা নৈরাশ্যবাদী হবেনই এমন তো কোন কথা নেই। এমন হতে পারে তাঁর নিজের মধ্যে বিশ্বাস ও আদর্শের বীজ ছিল। থাকতে তো পারেই। সেই অনুযায়ী তিনি যুগ সমস্যার সমাধানও দিতে পারেন। তিনি কি তাহলে যুগসচেতন নন?

ভিক্টোরীয় যুগের পরে অন্তঃসারশূন্য মূল্যবোধের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত এই সংশয় অবিশ্বাস উদঘাটিত হতে শুরু হয় ।

এ ধারায় আমরা পাই স্যামুয়েল বাটলারকে। তাঁর The way of an flesh উপন্যাসে অর্থহীন কল্পনা বিন্যাসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপটি বোঝা যাবে। ঠিক সেরকম কল্লোলের যুগেও উদঘাটিত হলো রবীন্দ্রদর্শনের প্রতি অকারণ অন্ধ আনুগত্য, গতানুগতিক অনুস্মৃতি ও ঘূণধরা সমাজ জীবনের মিথ্যাচারের ছবি। রবীন্দ্রনাথেও কিন্তু এসব যুগচেতনার পরিচয় পেয়েছি । গলসওয়ার্দির “দি ফারসাইট সাগা “—উপন্যাসের শেষভাগে পাই —-
“সোয়ামেস এর সঙ্গে প্রথমা পত্নী আইরিনের বিবাহ বিচ্ছেদের কাহিনী। সোয়ামেস দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন। এই দ্বিতীয়পত্নীর কন্যা হল -ফ্লু। আইরিনও দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছে । তাদের দ্বিতীয় বিবাহের পুত্র হল জন। জন আর ফ্লু এক অর্থে ভাইবোন। সোয়ামেস চাইলো ফ্লুর সঙ্গে জনের বিবাহ।

পুরাতন দৃষ্টিতে এরা ভাই বোন হলেও আধুনিক সমাজে সে বিবাহ চলে। এখানে যুগসচেতনতা আছে। সমস‍্যাও আছে। এইই আবার স্বীকৃত আধুনিকতাও। প্রাচ‍্য পাশ্চাত্যের এই ব‍্যাপারে দৃষ্টি ভঙ্গির পার্থক্য আছে। আদ্রেঁ জিদের স্ট্রেট টু গেট ― এর চিন্ময় গুহ কৃত অনুবাদ শীর্ণ তোরণ―এও আলিসা ও জেরোমের ভাইবোন সম্পর্কের জন‍্য উচ্চতর প্রেম বা বিবাহ প্রস্তাব ও গুরুজনের প্রস্তুতির অভাব হয়নি। বিয়েটা হলে আটকাতো না কোথাও। আমাদের প্রাচ‍্যের চোখে দেখলে অন‍্যরকম মনে হয়।

জার্মান উপন্যাসিক টমাস মান তার বুডেন রুক্স উপন্যাসে অভিজাত সম্প্রদায়ের অবক্ষয়ের চিত্রটিই ফুটিয়ে তুলেছেন । আধুনিক যুগের সামাজিক বন্ধন ও নীতিবোধের শৈথিল্য রয়েছে জেমস জয়েসের ইটালিসেস উপন্যাসে। যদিও এটি প্রতীকধর্মী উপন্যাস । এতে রয়েছে মানব মনের অন্তর লোকের চেতনা প্রবাহের উদঘাটন। তবু এখানে যুগগত অবক্ষয়ও উদঘাটিত একইসঙ্গে। আধুনিক যুগের অধিকাংশ উপন্যাসে , এমনকি কল্লোল যুগেও দেখা গেছে ব্যক্তির আর্থিক দৈন্য ও ব্যক্তির আত্মার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কথা উপন্যাসে চিত্রিত। মনে হয় এর আরও একটা যন্ত্রনা হলো বিজ্ঞানের প্রগতি ও তার সঙ্গে যন্ত্রের বিকাশ।

তাতে মানুষের কেবল বাহ্যসমৃদ্ধিই দেখা গেছে। সাম্যবাদ রাষ্ট্রশক্তির সাহায্যে অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করার কথা ভেবেছে কিন্তু এতে মানুষের অন্তরের দৈন্য তো দূর হচ্ছে না। তাই কেবল শূন্যতা বাড়ছে। এর ফলে মানুষের মনে কেবল অসন্তোষ জমা হচ্ছে।

আপাত দৃষ্টিতে ফরাসি উপন্যাসিক মারিয়াক কে অনাধুনিক মনে নাও হতে পারে। তিনি এমন ধর্মে বিশ্বাসী যেখানে মানুষের পূর্ণ মহিমাও স্বীকৃত নয়। সেখানে আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদেরও তো স্থান নেই। এ কি তবে “ক্যাথলিক জ‍্যানসিনিস্ট ধর্মমত?? যা মানুষ কে বলে—–
মানুষ জন্মসূত্রে পাপের উত্তরাধিকারী।
এ থেকে সে নিজেও চেষ্টা করে মুক্তি পেতে পারে না যতক্ষণ না ঈশ্বর করুণা করছেন।

এখানে তিনি আধুনিক তো নন!!? তবু তাকে আধুনিক বলা হয় কেন? মনে হয় , জীবন সমস্যাই বড় কথা। তার সমাধানই সবচেয়ে বড় রেমিডি।

চিন্ময় গুহর অনুবাদ “শীর্ণ তোরণ”–এ এই জ‍্যানসেনিষ্ট ধারণাটি সম্পর্কে আলোকপাত দেখি। তখন থেকেই ব‍্যাপারটি আমাকে হন্ট করতো। এই প্রসঙ্গে আলিসা-জেরোমের , বিশেষতঃ আলিসার উত্তরণ আমাকে ভাবিয়েছে।

প্রসঙ্গে ফিরছি—- প্রত্যেক লেখকের জীবনদর্শনে এ ব্যাপারে যাকে যার যার মতো তাকে তার মতোই স্বতন্ত্র মূল্য দিতেই হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে আধুনিকতা বলছি কাকে? এ পরিচয় কি কেবলমাত্র লেখকের যুগ সচেতনতায় থাকে??? নাকি যুগ আনুগত্যে??? রবীন্দ্রনাথের দর্শন ও সাহিত‍্যবোধের প্রতি অকারণ আনুগত্য থেকে মুক্তি চাওয়ায় কোনো ভুল নেই কিন্তু সেই সঙ্গে ভাবতেই হবে রবীন্দ্রনাথ কি সত‍্যিই যুগসচেতন ছিলেন না? সেইই তো আধুনিকতা। তিনি আধুনিক নন? প্রচুর লেখাই তো আছে।

জীবন সমস্যার সমাধানটি লেখক যাই দিন না কেন আধুনিকের সমস্যাটি তার লেখায় প্রতিফলিত হতেই হবে।

ফরাসি উপন্যাসিকরা আধুনিক যুগের অবক্ষয়ের মধ্যেও বলিষ্ঠ মানবিকতা ও আদর্শবাদী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই জন‍্য আজকেও ফরাসি লেখা আলোচ‍্য। বোধকরি এইজন‍্যেই বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে ফরাসি সাহিত‍্যের ভেদরেখাটি মুছে দেয়া গেছে। সাহিত‍্য ক্ষেত্রে এই বৈশ্বিকতাই আধুনিকতা নয়???

***********************