You are currently viewing আজ বসন্তের শুন্য হাত >  নিশাত জাহান রানা

আজ বসন্তের শুন্য হাত > নিশাত জাহান রানা

আজ বসন্তের শুন্য হাত

নিশাত জাহান রানা

আবার দেখা যদি হলো

ভোরের বেলায় সুশীলদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম আমরা তিনজন। পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত জেলার  হৃদয়পুরে সুশীলদার আবাস। গত সন্ধ্যায় আমি আর আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু নাহার ঢাকা থেকে কলকাতা পৌঁছেছি। তারপর সুশীলদার বাড়ি। নানা উত্তেজনায় রাতে আমাদের কারোরই খুব ভাল ঘুম হয়নি। ভাড়াকরা একটা ছোট গাড়িতে আমরা চলেছি রানাঘাটের দত্তফুলিয়া অভিমুখে। সেখানে খোঁজ পাওয়া গেছে বিষ্ণু বিশ্বাসের। ১৬ বছর আগে ঢাকা থেকে নিখোঁজ কবি বিষ্ণু বিশ্বাস। গাড়িতে আমি, নাহার এবং  সুশীলদা। বিষ্ণু সকলেরই পূর্বপরিচিত।

খানিকটা ভাঙা-চোরা পথ, খানিকটা ভাল। রওনা হওয়ার আগে পথের দূরত্ব সম্পর্কে যে ধারণা পেয়েছিলাম, মনে হলো তারচেয়ে যেন অনেক দীর্ঘতর এই পথ! প্রায় ঘন্টাতিনেকের পথ পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম দত্তফুলিয়ায়। আমাকে বিস্তারিত ঠিকানা পাঠিয়েছিলেন কবি নান্নু মাহবুব। তাছাড়া কবি বিভাস রায় চৌধুরীর সার্বিক নির্দেশনা তো ছিলই। বড়বড়িয়া স্কুল পার হয়ে বড় তেঁতুল গাছের পাশে নিত্য বিশ্বাসের বাড়ি। সেখানেই বিষ্ণু থাকে। আমাদের আগেই কলকাতা থেকে সে বাড়িতে পৌঁছে গেছেন কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, কবি গৌতম চৌধুরী, মিতুল দত্ত প্রমুখ। বিষ্ণু মৃদুলদা এবং গৌতমদারও পূর্বপরিচিত। আর বিভাস তো ছিলেনই। তাঁরই  তত্বাবধানে হঠাৎ সংবাদে পরিণত হওয়া বিষ্ণুকে নানা অযাচিত উৎপাতের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা  চলছিল।

বিষ্ণুর প্রায় সমবয়সী মাতুল নিত্য বিশ্বাসের পরিবারের তত্বাবধানে অনেকদিন ধরে দত্তফুলিয়ায় রয়েছেন  সপুত্রক বিষ্ণুর মা। নিজেদের ক্রয়কৃত জমিতেই বাড়ি। মাটির বাড়ি। বারান্দায় গুটিকয় চেয়ার পাতা। তাতে পূর্বাগত অতিথিরা বসে আছেন। একটি চেয়ারে বিষ্ণু বিশ্বাস উপবিষ্ট। কিন্তু, এই কি বিষ্ণু! ছিপছিপে তরুণ  সুদর্শন মায়াময় সেই ছেলেটি, যে একদা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত সবুজে টুকরো পাতার তরবারি  বেজে চলার ঝনঝন শব্দে গলা মিলিয়ে গান গাইতো- ‘কেন যে মন ভোলে, আমার মন জানে না। তারে মানা করে কে, আমার মন মানে না’! ঘাসের গালিচায় বসে গভীর মগ্নতায় আবৃত্তি করতো জীবনানন্দ দাশ, প্রেমেন্দ্র মিত্র অথবা পূর্ণেন্দু পত্রী! এই কি সেই ছেলেটি যে তার দিদির পায়ে পায়ে যুধিষ্ঠিরের কুকুর হয়ে স্বর্গে যাবে বলে আকাঙ্খা পুষতো হৃদয়ে! এই বিষ্ণুর মাথাভর্তি প্রায়জটাবদ্ধ কেশরাজি, মুখভর্তি প্রলম্বিত সাদাকালো শ্মশ্রুমন্ডল, আঙুলে সূর্পনখার মত দীর্ঘ নখ।  ভাঙাচোরা শরীরে অপুষ্টির গভীর চিহ্ণ-যেন সোমালিয়ার ক্ষুধার্ত শিশুর অসহায় ভগ্নস্বাস্থ্য। কঠোর  নিয়ন্ত্রণে বুকের ভেতর পাথর চাপা দিয়ে রাখা আমার অঝোর কান্নারাশি সেদিন আর বাধ মানেনি।

সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম অসীম দাসের কাব্যগ্রন্থ – ঝঞ্ঝা ও পুনরুত্থান, আমার গ্রন্থ – তুমি ধ্বংস তুমি উদ্ধার  এবং ভোরের মন্দির। বিষ্ণু বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখলো কিছুক্ষণ। আমার বই বেরিয়েছে জেনে ওর মুখ আনন্দ-উদ্ভাসিত হলো। একজন কবি এই গ্রামে বাস করেন এতোকাল পর সেকথা জানতে পেরে গ্রামের সমস্ত মানুষই যেন সেদিন ওই বাড়ির উঠোনে এসে ভীড় জমিয়েছিল। তারা এতদিন জানতো এই নির্বাক দাদাবাবু কথা বলতে জানেন না। তিনি কেবল সন্ধ্যেবেলায় হেঁটে হেঁটে দূরের চায়ের দোকানে গিয়ে বসেন। খবরের কাগজ পড়েন। তারপর আবার বাড়ি ফিরে আসেন। কারো সঙ্গে কথা বলেন না। আজ তাদের সে  ভুল ভাঙলো।

 

ভোরের মন্দিরে ঘন্টাধ্বনি

ব্যাগের ভেতর একরাশ সুগন্ধি বেলীফুলে ডুবিয়ে রাখা সুরভিত লাল-সাদা জর্জেটের শাড়ি আর চৌকোণা কোমল গোলাপী খামে ভরা নিচের চিঠিটি নিয়ে ১৯৮৪ সালের তেসরা মে সকালবেলায় রাজশাহী  বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের গেটে আমার খোঁজে উপস্থিত হয়েছিল যে কিশোর তরুণ-তার নাম বিষ্ণু। বিষ্ণু বিশ্বাস।

দিদি,

আজ বৃস্পতিবার, তেসরা মে। একটি বিশেষ দিন- তোমার জন্মের শুভক্ষণটির জন্মদাতা; জন্মদিন।

সেদিন কী থমথমে মেঘ ছিলো আকাশে? দূর্দান্ত ঝড় ছিল? ঝাঁঝালো রোদ্দুর?

বোশেখের সব বৈশিষ্ট্য তোমাতে প্রতিভাত। ছুরি-ফলা-রোদ্দুরের তীক্ষ্ণতা, আচমকা থমথমে রহস্যময়ী হয়ে ওঠা, ঝড়ের উচ্ছ্বাস, শস্য সম্ভাবনা,

ধ্রুপদ জোছনা সবই মেলে। যেন চুরি করেছো বোশেখী আত্মার  সব আলো অন্ধকার। তোমাকে ভালোবাসলে কষ্ট পেতে হয়। আবার কাঁঠালী চাঁপার সুগন্ধি ঝাঁজে ভরে  ওঠে মন।

এমনই প্রচন্ড প্রভাবী বৈশিষ্ট্য তোমার- এড়িয়ে যায় সে সাধ্য কার!

হয়তো হুল্লোড়ে পাব না সুযোগ চরণ ছোঁয়ার। তাই চিঠিতে গ্রহণ কোরো আমার প্রণাম। তোমায় অদেয় কিছুআর নেই আমার। পার্থিব প্রণামী দেওয়ার সাধ অনেক, সাধ্য সীমিত। শুধু            শুভকামনায় হৃদয় ভরা। তাই-ই প্রণামী বলে মেনো।

সম্ভাব্য যা কিছু হয়ে ওঠার তাই হও।

হয়ে ওঠো জ্যোতির্ময়ী।

বিষ্ণু

*দেবী নিশাত দিদি রূপেন সংস্থিতা নমঃস্তস্যই নমঃস্তস্যই নমঃস্তস্যই নম নমঃ।

জন্মদিনের ভোরে এরকম একটা উপহার পেলে মন কেমন আলোকিত, উদ্বেল, প্রসন্ন হয়ে ওঠে-সে তো সর্বজনজ্ঞাত। এভাবেই আমার জীবনে তরুণ কিশোর বিষ্ণু বিশ্বাসের আসন হয়তো চিরস্থায়ী হলো। আদরে মমতায় ভালবাসায়। যথার্থ অর্থে রবীন্দ্রনাথের ‘দিদি’ গল্পের দিদি হয়ে ওঠার সাধ্য-শক্তি ছিল না বটে, তবে মনে মনে এবং বাস্তবে সে আমার ছোট ভাইটিই হয়ে উঠলো চিরকালের জন্য।

কবিতা পড়ার নেশায় কিছু তরুণ-তরুণী সমন্বয়ে একদা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠে আবৃত্তি সংগঠন স্বনন। একেবারে আশির দশকের সূচনালগ্নে। আমি সেই সংগঠনের এক সক্রিয়-নিবেদিতপ্রাণ কর্মী এর জন্মমূহুর্ত থেকে। উচ্ছ্বল সমুদ্রের মতো সে সংগঠনে প্রতিবছর যোগ দেয় আবর্তের নতুন তরঙ্গ আর সেই নবাগতবৃন্দ ক্রমে স্বনন পরিবারের অংশীভ‚ত হয়ে বৃহত্তর জগতে মিশে যায়  বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নশেষের সনদ হাতে নিয়ে। প্রবহমান স্বনন সমুদ্রে আরো অনেকের সঙ্গে একদিন  যোগ দিল বিষ্ণু বিশ্বাসও। কবিতার প্রতি ভালবাসা, আবৃত্তি-দক্ষতা, গান গাইবার স্বতস্ফূর্ত স্বভাব-এইসব মিলিয়ে  দ্রুতই হয়ে উঠলো আমাদের বন্ধুবৃত্তের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিছুদিন পরে আমি যখন স্বনন-এর আহ্বায়ক, তখন বিষ্ণু বিশ্বাস আর ফয়জুল ইসলাম সুমন নির্বাচিত হলো যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে।  দুজনেই খুব স্নেহের আর আদরের অনুজ আমার। কবিতা পাঠের নিয়মিত চর্চায় ক্রমাগত আমার ঘনিষ্ঠ  হয়ে উঠল বিষ্ণু। সে ওরই স্বভাবগুণে। যাকে পছন্দ করতো, ভালবাসতো, তার সঙ্গেই  ভারী নিবিড়  সংযোগ গড়ে উঠতো ওর। বয়োজ্যেষ্ঠদের আদর লাভ করতো যেমন, সমবয়সী কিংবা অনুজদের  ভালবাসাও পেত তেমনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণটি এমন সুনিবিড় প্রাকৃতিক স্নেহছায়াময় যে সেখানে মানুষ  পরস্পরের সজল ভালবাসায় স্নাত হয়ে ওঠে যেন অনায়সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির দিনগুলোতে বাড়ি  ফিরে গিয়ে অনেক চিঠি লিখতো বিষ্ণু আমাকে। ভারী সুন্দর ওর হস্তাক্ষর, আর ততোধিক সুন্দর ওর লেখার ধরন। তখন আমাদের জীবনের প্রাচুর্য্যময় তারুণ্যের দিন। কথায়-কবিতায়-সঙ্গীতে ভরপুর দিন। উতল হাওয়ার স্রোতে ভেসে যাওয়ার দিন। দলবেঁধে একসঙ্গে গান গাওয়ার দিন- ‘নাগো, এই যে ধুলা আমার না এ’; ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ’, ‘তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ দুঃখের অশ্রুধার’; ‘লক্ষ্মী যখন আসবে তখন কোথায় তারে দিবিরে ঠাঁই’; ‘কেন যে মন ভোলে আমার মন জানে না’ অথবা ‘আজ তারায় তারায় দীপ্তশিখার অগ্নি জ্বলে’; ‘সারাবরষ দেখিনে মা’- এমনি কত কত গান আর কবিতা! সেইসব দিনের রূপময়তা বর্ণনা করি- সাধ্য কি!

আমার বন্ধুদের অনেকেই তখন নিয়মিত কাব্যচর্চায় নিমগ্ন। মোহাম্মদ কামাল, অসীমকুমার দাস, আরিফুল হক কুমার, শামসুল কবীর কচি, এনায়েত কবীর এবং বিষ্ণু বিশ্বাসও। ওদের কারো কারো উদ্যোগে বেরোলো ছোট কাগজ পেঁচা। কিছুকাল পরই ঘরের কার্ণিশ থেকে সে পেঁচা অন্ধকারে উড়ে গেল যদিও! এইসব মুখর দিনের ভেতর দিয়ে একসময় স্নাতক পরীক্ষা শেষ করে ঢাকায় পাড়ি জমালো ইতিহাসের ছাত্র বিষ্ণু বিশ্বাস। ততোদিনে আমাদের বন্ধুদের অনেকেই রাজশাহী থেকে ঢাকায় পাড়ি দিয়েছে। সেই বলয়ের ভেতরে থেকেও ক্রমে বিষ্ণুর আরো বৃহত্তর বন্ধুবলয় তৈরি হলো। ওর মনে হলো-প্রাতিষ্ঠানিক সনদের কি-বা প্রয়োজন! তাই আর স্নাতকোত্তর পাঠের জন্য রাজশাহী ফিরলো না সে। বরং ঢাকায় লেখক বন্ধুদের সঙ্গে কাটতে লাগলো দিন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষে আমি তখন ঢাকায় এক পত্রিকায় কাজ করছি। নীলক্ষেতে অফিস। এলোমেলো বিষ্ণু মাঝে মাঝে একপাতা-দু’পাতা কবিতা নিয়ে হাজির হতো। বলতো – এটা তোমার কাছে রেখে দাও, আমার কাছে থাকলে হারিয়ে যাবে নির্ঘাৎ! ওর দিনযাপনের সকল বৃত্তান্ত তখন আর খুব প্রগাঢ়ভাবে জানার সময় হয়ে উঠতো না আমার। জানা হতো না ওর কোনো মেয়ের প্রেমে ডুবে থাকা অথবা নতুন বন্ধু-পরিচিতদের হদিস।

দিন চলে যায়, চলে যায় বছরও। আমার কাজের ক্ষেত্র বদল হয়। স্থানও। লালমাটিয়ায় আমার অফিস তখন। বিষ্ণুর সঙ্গে যোগাযোগ খুব অনিয়মিত হয়ে যায়। ভাল করে জানিনা কখন কোথায় থাকে! কি করে! খবর পাই- যখন হঠাৎ করে সে নিজেই দেখা করতে আসে।

বেলা প্রায় অপরাহ্ণ। সূর্য মাঝ-আকাশ থেকে পশ্চিমে ঢলে পড়তে শুরু করেছে। অফিসে ব্যস্ত আমি। শ্রান্ত মলিন অবয়ব নিয়ে বিষ্ণু উপস্থিত হলো। দু’একটা কথার পরই জানালো-দুপুরে তার খাওয়া হয়নি। ক্ষুধার্ত। ৫০টি টাকা চায়। টাকা পাওয়ার পর চলে গেলো। এই ঘটনা একাধিক দিন ঘটলো। এরমধ্যে আমার কানে এলো ওর মাদকাসক্তির কথা। বন্ধুদের কাছে জানতে পারলাম যে শাহবাগের মোড়ে, পিজির ভেতরের আড্ডায় বা অন্যত্র বিষ্ণু মাদকাসক্তদের সঙ্গেই বেশি ওঠাবসা করছে আজকাল। তাই এরপর যখন দুপুরে খায়নি বলে টাকা চাইতো, নগদ টাকা দেয়ার বদলে আমি খাবার আনিয়ে দিতাম। কিন্তু খাবারে ওর খুব আগ্রহ থাকতো না। আসলে সুন্দর করে সাজিয়ে খেতে বসতে ভালবাসলেও বরাবরই পরিমাণে খুব সামান্যই খেতো বিষ্ণু। তার একটা কারণ ছিল হয়ত দীর্ঘদিন ধরে নেশাদ্রব্য গুল ব্যবহার করার অভ্যেস।

একদিন সকালের দিকে এলো। এলামেলো-উস্কোখুস্কো চুল। মলিন জামাকাপড়। যেমনটি ওকে ঠিক মানায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন খুব গুছিয়ে সাদা ট্রাউজার্স আর সাদা কিংবা হালকা রঙের জামা পরে পরিচ্ছন্ন সুন্দর হয়ে তবে সে ঘর থেকে বেরোত। চোখে উদভ্রান্তি। ফিসফিস করে বললো- একটা লোক ছুরি হাতে একটা সাদা গাড়িতে করে ওকে তাড়া করছে অনেকক্ষণ ধরে। সে কোনোমতে পালিয়ে এসেছে আমার কাছে। আমার অফিসের গলির মুখে এখন সেই গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। ও বের হলেই হয়তো ওকে খুন করবে। এই অলীক ভাবনা ও ভীতির জগতে বিচরণপ্রবণতা ওর ভেতরে হয়তো ছিল বহুকাল ধরেই, তবে সেগুলো আরো বেড়ে উঠেছিলো বাবরি মসজিদ নিয়ে দাঙ্গার পর।

একদিন সন্ধ্যেবেলায় আমার অফিসে এসে জানালো-ওর মা মারা গিয়েছেন। ঝিনেদা থেকে সে এইমাত্র ফিরেছে। সরাসরি বাসস্ট্যান্ড থেকে এসেছে আমার অফিসে। ওর মাতৃমৃত্যুর সংবাদ শুনে আমি তো শোকাহত। কিন্তু আমার সে শোকদশা উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই ওর মুখে আরো অনেক অদ্ভুত গল্প শুনে কিরকম হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। মাসিমা কিভাবে মারা গেলেন- আমার এ প্রশ্নের উত্তরে বিষ্ণু জানালো, তাদের গ্রামের বাড়ি ঝিনেদা অঞ্চলে একটি ব্যবসায়ী দল মানুষের শরীর থেকে কিডনী বের করে নিয়ে বেচে দিচ্ছে কোথাও। ওর মায়েরও কিডনী বের করে নেয়ার ফলে তিনি মারা গেছেন। এখন তারা বিষ্ণুর পিছে পিছে আস্ছে ওর কিডনী বের করে নেয়ার জন্য।…এইসব গল্প যখন ক্রমাগত ডালপালা মেলতে লাগলো, তখনই প্রথম আমার বোধোদয় হলো- ওর মানসিক অবস্থা কতখানি বিপর্যস্ত! দ্রুত বিষ্ণুর আর এক বন্ধু এবং আমি ওকে নিয়ে যাই লালমাটিয়ায় আমার অফিসের পাশেই মনোচিকিৎসক ডাক্তার হেদায়েতুল ইসলাম-এর হাসপাতাল- ঢাকা মনোরোগ-এ। ডাক্তার জানালেন বিষ্ণু সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। তবে সেটা ভয়াবহ কিছু নয়। হয়তো নানারকম ড্রাগস থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়াও হয়েছে। আপাতত নজরদারি ও চিকিৎসার জন্য তাকে একমাস হাসপাতালে রাখতে হবে। সেই রাত্রেই দরকারি কিছু জিনিসপত্র কিনে দিয়ে ওকে হাসপাতালে রেখে আমরা চলে আসি। হাসপাতালের কোলাপসিবল গেট যখন বন্ধ করে দেয়া হলো, দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বিষ্ণুর সেই বিস্মিত অসহায় দৃষ্টি আমি কোনোদিন বিস্মৃত হবো না হয়তো!

একমাস পর ডাক্তার জানালেন- এবার বিষ্ণুকে হাসপাতাল থেকে মুক্ত করে দেয়া যেতে পারে। তবে অব্যাহতি দেওয়ার সময় তিনি ওর সার্বক্ষণিক দেখাশোনার ওপর সবিশেষ জোর দিলেন। সেইসময় আমাদের সকলের পেশাগত জীবনের প্রারম্ভলগ্ন। কারো পক্ষেই খুব সহজ ছিল না একটি পারিবারিক আবহে সার্বক্ষণিক যত্নে ওর দেখাশোনার ব্যবস্থা করা। তবু বন্ধুদের কেউ কেউ ওর দায়িত্ব নিল। সকালে বিষ্ণুকে বাড়িতে একা রেখে অফিসে চলে যেতে হতো সবাইকেই। বন্ধুদের নজরদারি ফাঁকি দিয়ে হঠাৎ বিষ্ণু উধাও হয়ে যেত। এইসময় সে রাজশাহীতেও গিয়েছিল। অসীমকুমার দাস, যাকে হয়তো অনেকের মতো বিষ্ণুও গুরুই মানতো, এবং আরো অন্যান্যদের সঙ্গে দেখাও করেছিল। হয়ত গিয়েছিল কলকাতায়ও, দেখা করেছিল সুশীলদার সঙ্গেও। এইভাবে উধাও হওয়া এবং আবার ফিরে আসার মধ্যেই কবে যেন একদিন বিষ্ণু বিশ্বাস একেবারেই নিখোঁজ হয়ে গেল। দীর্ঘদিনের জন্য।

কিন্তু কোথায় গেল বিষ্ণু! এই প্রশ্নটি আমাদের মনের ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলো বছরের পর বছর ধরে। নাগরিক ব্যস্ততার এই শহরে বিষ্ণুর বন্ধু- পরিচিতদের, অথবা শহর ছাড়িয়ে দূরে যেখানে বিষ্ণুর বালকবেলার বন্ধুরা আছে-সকলেরই মাথার ভেতর নানা অবকাশে এই প্রশ্ন ফিরে ফিরে এলো অনেক অনেকবার। অনেক কল্পকাহিনী তৈরি হলো নিখোঁজ বিষ্ণুকে নিয়ে। কেউ বললো- সে ভারতে চলে গেছে। সেখানে তার মায়ের সঙ্গে আছে। কেউ বললো- সে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে ওপার বাংলায়। তার একটি পুত্রও আছে। কেউ বললো- সে একেবারেই অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছে। আর কি জানি কে বললো একথাও যে- বিষ্ণু আত্মসংহার করেছে। এইসব কথার অদৃশ্য টুকরো ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত উড়ে বেড়াতে লাগলো বিবিধ আড্ডার কলরোলে অথবা বন্ধু-অনুরাগীদের নিভৃত চিদাকাশে।

বিষ্ণুকে হারিয়ে ফেলার দুঃখ আমাদের অনেককেই পীড়িত করতো। ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনুরাগীদের কারো কারো সঙ্গে দেখা হলেই ফিরে ফিরে আসতো বিষ্ণুর সন্ধান পাওয়ার কৌশল নিয়ে আলোচনা। সেইসময় বিষ্ণুর লেখা পুরনো চিঠির স্তূপ ঘেঁটে আমি কখনো কখনো ওর নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদ্ধারের সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টাও করেছি। স্বৈরশাসনের দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আন্দোলন প্রতিহত করার নানা অজুহাতে প্রায়শই হল খালি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছুটি দিয়ে দেয়া হতো। সেসব ছুটি হতো দীর্ঘ এবং অনির্ধারিত সময়ের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির এসব সময় বিষ্ণু বাড়ি থেকে চিঠি লিখতো আমাকে। এক চিঠিতে সে লিখেছিলো-

যদি এমন হতো দিদি, চিঠির পর চিঠি লিখছো তুমি; আমি সাড়া দিচ্ছি না। ভার্সিটি খুলেছে, আমি যাচ্ছি না। তুমি রোজ সুমনকে জিজ্ঞেস করছো, সুমন বিষ্ণু আসেনি? সুমন বলছে-  না, কি ব্যাপারে কে জানে! কোনো চিঠি পত্তরও নেই।

মাস কাটলো, বছর গেল-আমি আর গেলাম না। হয়ত আমাকে আর পেলে না খুঁজে পৃথিবীর ঘাসে। শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে। হয়ত আর বলা হলো না- দিদি, ও দিদি  তোমার নোতুন শেখা গানগুলি শোনাও না! স্বর্গে গিয়েও আমি শান্তি পেতাম না দিদি।

আর একটি চিঠিতে বিষ্ণু লিখেছিল-

আমি উন্মাদের মতো ঢিল ছুঁড়ে যাচ্ছি স্মৃতির অতলে। নিঃসঙ্গ দূরদ্বীপ থেকে উদ্ধার চাইছি তোমার কাছে। নিরুপায় সংকেত পাঠাচ্ছি আলোর তরঙ্গে, অন্ধকারে।

রাত্রে, ‘স্বপ্নগুলি নিদ্রার পিঠে ছুরি মেরে হেসে ওঠে। স্মৃতিগুলো তারই সূত্র ধরে হাওয়া শুঁকতে শুঁকতে, পা টিপে পা টিপে হেঁটে আসে; জানালার ধারে। নিঃশব্দে দাঁড়ায়।’

ডুবুরির মতো অনুসন্ধানী আলো ফেলে এইসব চিঠি পুনর্বার পড়তে গিয়ে আমার মনে হতো – বিষ্ণু কি জানতো সে একদিন এরকম করে কোথাও হারিয়ে যাবে! অথবা হারায়নি সে। হয়ত আছে কাছেই কোথাও! অথবা হয়তো কোনো নিঃসঙ্গ দূরদ্বীপ থেকে সে সত্যিই উদ্ধার চায়! এইসব এলামেলো অসংলগ্ন ভাবনা নিয়ে তবু আমাদের সকল অনুসন্ধানই যেন ক্রমাগত নিষ্ফল হতে থাকলো।

বিষ্ণুর নিখোঁজ হওয়ার ৫/৬ বছর পর যখন যুক্ত প্রতিষ্ঠা করি, শুরু করি প্রকাশনার চিন্তা, তখনই ভাবি বিষ্ণুর কবিতাগুলি সংকলিত করার কথা। সে যে প্রগাঢ় অনুভবের ভেতর ডুব দিয়ে তুলে আনতো লেখার উপাদান, ভিন্ন এক ধারায় তাঁর কবিজীবনের ঋদ্ধ-সূচনাটি ভবিষ্যতের পাঠকের জন্য থাকুক না গ্রন্থবন্দী হয়ে! শুরু করি যুক্তর প্রথম প্রকাশনা ভোরের মন্দির-এর কাজ। এ প্রসঙ্গে আমি বিস্তারিত লিখেছি ২০০১ সালে প্রকাশিত বিষ্ণু বিশ্বাসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ভোরের মন্দিরের ভূমিকায়।

 

যেখানে আছিশিকড় ছেড়ে বসি

কালদর্শনের ভেতর দিয়ে কৃষ্ণ তো অর্জুনকে জানিয়েই দিয়েছিলেন- কিভাবে ভাই ভাইকে নিধন করছে এবং করবে। তবু যুদ্ধ হয়। তবু জয়ের চেষ্টা চলে। যদু বংশ নিশ্চিহ্ণ হবে- সেও-তো জানাই ছিল। সবকিছুই পূর্ব-নির্ধারিত জেনেও ধ্বংসদৃশ্যসমূহের নীরব দর্শক হওয়ার তো কোনো বিকল্প নেই। আজকের এই রোরুদ্যমান পৃথিবীতেও আমাদের চোখের সামনে সব ধ্বংস হয়ে যায়। ভেঙে পড়ে প্রাচীন সভ্যতা। লুটিয়ে পড়ে উচ্ছ্বল শিশুর প্রাণ। আমরা কেবলই নিরুপায় প্রত্যক্ষদর্শী। আমরা থামাতে চাই সে যুদ্ধ, সে ধ্বংস। কিন্তু কালচক্রে কিছুই তো থামে না শেষতক্। শেষপর্যন্ত ধ্বংস এবং উদ্ধার পাশাপাশি হাত ধরেই চলে।

নিখোঁজ কবি বিষ্ণু বিশ্বাসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ভোরের মন্দির ২০০১ সালে প্রকাশ করে যুক্ত। ২০১১ সালে ভোরের মন্দির-এর প্রথম সংস্করণ বের হয়। সে বছর অমর একুশে গ্রন্থমেলায় কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকসহ আরো অনেকের উপস্থিতিতে বইটির প্রকাশ ঘটে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বহেড়াতলার লিটল ম্যাগ চত্বরে। চারিদিক থেকে পরিচিত অপরিচিত অনেকেই এসে জড়ো হন বৃত্তাকারে দাঁড়ানো যুক্তর সেই আয়োজনে। ততোদিনে প্রায় দেড়দশক ধরে নিখোঁজ বিষ্ণুকে নিয়ে সেদিন অনেকেই কথা বলেন। সেই আয়োজনে উপস্থিত হন পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় আগত কয়েকজন কবি-লেখকও। সকলের আগ্রহ, অনুমান ও উদ্বেগের কথা জেনে এরপর তারা উদ্যোগ নেন বিষ্ণুকে খুঁজে বের করার। এরই ধারাবাহিকতায় কবি বিভাস রায় চৌধুরী ফেসবুকে বিষ্ণুর ছবিসহ একটি পোস্ট দেন। হৃদয় চূর্ণ-করা সেই পোস্টে তিনি জানান- বিষ্ণুর সঙ্গে তাঁরা দেখা করেছেন। কিন্তু সে কোনো কথা বলেনি। এখন তার দিন কাটে অবসাদগ্রস্ততায়। কয়েকটি বিড়াল তার সঙ্গী। তিনি নিজের খাবার তাদেরকেই দিয়ে দেন। কথা বলেন না। লেখেন না। এরপর সেই ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকে তর্ক-বিতর্ক-আক্রমণ-উদ্বিগ্নতা। ২০১১ সালে আমি ফেসবুকে খুব সক্রিয় ছিলাম না। ফলে এসব কিছুই তৎক্ষণাৎ আমার নজরে আসেনি। আমাকে কেউ একজন (হয়ত নভেরা হোসেন! নাম মনে পড়ছে না বলে ক্ষমাপ্রার্থী) ফেসবুকের সেই পোস্টটি শেয়ার করে জানতে চান-এটি সত্যি বিষ্ণুর ছবি কি-না! তারপর এপার বাংলা ওপার বাংলার মধ্যে কত আলোচনা, কত শলাপরামর্শ, কত উপদেশ-নির্দেশের জোয়ার বইলো। ঢাকা থেকে কলকাতা ফোনে কথা হলো কবি ও সঙ্গীত শিল্পী মিতুল দত্তের সঙ্গে। মিতুল ও বিভাস ততোদিনে এক চিকিৎসক দম্পতির সহায়তার আওতায় এনেছেন বিষ্ণুকে। তাঁদের সমানুভ‚তির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ নিতান্তই সামান্য অভিক্ষেপ। তাঁদের সকলেরই মত এই যে, অবিলম্বে বিষ্ণুকে তাঁর পুরাতন বন্ধুদের সন্নিধানে আনা জরুরি। কারণ সে কারো সঙ্গেই কথা বলছে না- হয়তো তারা অপরিচিত বলেই! অনেক আলোচনার পর একদিন তাই বাংলাদেশের বন্ধুদের পক্ষে আমি চললাম বিষ্ণুসকাশে।

বিষ্ণু শারিরীকভাবে বেঁচে আছে- এ যেমন এক অভাবনীয় আনন্দসংবাদ ছিল ওর বন্ধু-পরিচিত-অনুরাগীদের কাছে; তেমনি ওর পরিবর্তিত জীবন ছিল ভয়ঙ্কর এক আঘাত আমার কাছে। ওর বন্ধুদের কাছেও। চুল-দাড়ি-নখের অবাঞ্ছিত জঞ্জাল থেকে তাকে উদ্ধার করা খুব কঠিন হলো না। আমাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরদিন বাড়িতে ক্ষৌরকার ডেকে সেটা সে নিজেই করে ফেললো। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শানুসারে পুরনো বন্ধুদের জগতে তাকে ফিরিয়ে আনার কাজটি খুব সহজ ছিল না। দুইদেশের মধ্যে যে অবিশ্বাস ও অনাস্থা রয়েছে, যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে- তা অতিক্রম করে বিষ্ণুর পরিবারের আস্থা অর্জন আমার পক্ষে খুব সহজ হলো না। একাদিক্রমে তিনবছর আমি যাতায়াত করি দত্তফুলিয়ায়। দীর্ঘ পরিক্রমাশেষে বিষ্ণুকে আনা সম্ভব হয় ঢাকায়।

ঢাকায় ফিরিয়ে আনার পর বিবিধ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় নিখোঁজ একজন কবিকে ফিরে পাওয়ার সংবাদপ্রচারবিষয়ে। কেননা ব্যাপারটা সেইসময় অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিল। খুব সন্তর্পণে তাই বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাহচর্যে কাটে বিষ্ণুর সময়। শারিরীক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ অবসাদগ্রস্ত, জড়তার শিকার বিষ্ণু বিশ্বাস নানান চেষ্টার ভেতর দিয়ে খুব শ্লথগতিতে কিয়দংশে ফিরে পায় তার খাদ্যরুচি, হৃতস্বাস্থ্য, লেখার উদ্যম। কিছুটা জড়তামুক্তি ঘটে তার। প্রতিদিন সকালে তাকে আমার সঙ্গে অফিসে নিয়ে যেতাম। প্রথম প্রথম সে চুপচাপ সারাদিন একটা সোফায় বসে থাকতো। কিছু করার উদ্যম পেত না। কম্পিউটার নামক যন্ত্রটির সৃষ্টির পেছনে গভীর কোনো মহাজাগতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে ভাবতো। অনেক চেষ্টার পর কম্পিউটারের প্রতি তার প্রতিরোধ দূর করা গেল। স্থবির আঙুল সচল হলো। নিয়মিত লেখার অভ্যেসও রপ্ত করানো সম্ভব হলো। যদিও সিজোফ্রেনিক একজন মানুষকে তার অদৃশ্য মনোজগতের দুর্বোধ্য জটিলতা থেকে সম্পূর্ণ বের করে আনা প্রায় অসম্ভব বলেই আমাকে জানিয়েছিলেন চিকিৎসকবৃন্দ। তবু সেইসময়ই খুব অলৌকিকভাবে কোনো কোনো দিন সর্বোচ্চ একপাতা পর্যন্ত লিখতে শুরু করে বিষ্ণু। ভালবাসতে শুরু করে কম্পিউটারে লেখার অভ্যেসটিকেও। জন্ম দেয় বেশকিছু নতুন কবিতার। সেই কবিতাগুলি তাঁর পূর্বতন ধারা থেকে একেবারেই ভিন্ন বলা চলে। এই কবিতাগুলি সংবদ্ধ হচ্ছে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ-তোমার থেকে দূরে এসেছি-তে।

এই গল্প নিশ্চয়ই এখানে শেষ নয়। কিন্তু আমি আপাত-যতি চিহ্ণ আঁকবো এখানেই। কেবল এইটুকু বলে শেষ করা যাক- অবসন্ন বিষ্ণু হয়তো এখন লিখছে না নিয়মিত, তাঁর কবিত্বশক্তির হয়তো বেশকিছু অপচয়ই হলো- ‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে’, তবু তো সে ‘গন্ধ ছড়ালো ঘুমের প্রান্তপারে।’ অন্ধকারে ফুল ঝরে যায়, বিষ্ণু তো জেগে রয়েছে তার লেখার ভেতর- একজন শুদ্ধ কবির মতো নিজের জোরে মাতাল হওয়ার শক্তিতে। হয়তো সে-

একা এসেছিল ভুলে   অন্ধরাতের কূলে

অরুণ-আলোর বন্দনা করিবারে।

অথবা, হয়তো সে-

আঁধারে যাহারা চলে সেই তারাদের দলে

এসে ফিরে গেল বিরহের ধারে ধারে।

করুণ মাধুরীখানি  কহিতে জানে না বাণী

কেন এসেছিল রাতের বন্ধ দ্বারে।

(রবীন্দ্রনাথ)

 

বিষ্ণুর আর একটি চিঠি থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করে উপসংহার টানছি এ লেখার-

‘যেতে যেতে রক্তপাত হয়

যেতে যেতে সর্বাঙ্গের উদ্যমে ও অভিলাষে, বাসনায়, বাহুতে, বল্কলে

নীল মরচে পড়ে।’

রোগটা আমারও ছিল। আমার ইচ্ছেটা অবশ্যি তোমার মতো আকাশ ছোঁয়নি। ছাড়িয়ে যায়নি কাঞ্চনজঙ্ঘাকেও। তবু অতটুকুতেই বুঝেছি। এ এক ভয়ঙ্কর নেশা। কেবল ভাসায়। আমাকে গাছ হতে দেবে না কখনো। বাতাসে ভাসছে বীজ। ভেসেই চলেছে। সারা পৃথিবী চুরাশিবার প্রদক্ষিণ করেও। সুতরাং স্টপ সার্চিং। যেখানে আছি, শিকড় ছেড়ে বসি। বিশাল বটবৃক্ষ না হই, লতাপাতার পোষাকে নগ্ন পৃথিবীকে একটু তো শ্রীমান করি।

বিষ্ণু বিশ্বাস কি গাছ হতে চেয়েছিল! সারা পৃথিবী চুরাশিবার প্রদক্ষিণ করে, এখন কি সে গাছ হয়ে শেকড় ছড়িয়ে বসতে পেরেছে! তার চাওয়া হয়ত পূর্ণ হয়েছে তবে! আর এই পৃথিবীকে একটু শ্রীমান তো সে করেছেই তার কবিতায়। তার কবিসত্তার মাধুর্যে।

১২ জুলাই ২০২২

ঢাকা, বাংলাদেশ।