You are currently viewing আজরাইলের ডানায় চেপে>  রোকসানা পারভীন সাথী

আজরাইলের ডানায় চেপে> রোকসানা পারভীন সাথী

আজরাইলের ডানায় চেপে

রোকসানা পারভীন সাথী

 

দুর্বার সংযমের জয়জয়কারে মুখরিখ গোটাদেশ। অফিসে, আদালতে, ম্যানিজিং কমিটিতে বখরা নিয়ে কামড়াকামড়ি, কুকুরের আর ধূর্ত শেয়ালের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের চোটপাতে পবিত্র মাহে রমজানের সংযম বেচারা পড়েছে বড্ড বেকায়দায়।
বাজারে সংযমের রমরমা বেসাতিতে খাবি খাচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষ। ঘাম ঝরানো মেহনতি, মধ্যবিত্ত, ক্ষেতমজুর, কল-কারখানার মজুর, মুটে, কুলি।
নিত্যদিনের সওদাপাতি করার হিম্মত মনোয়ারার নেই। বাজারে ঘুরে আর ভিক্ষা করে। মুখ ঢেকে ডান হাত বাড়িয়ে দেয়। পৃথিবীতে চলছে উল্টো ¯্রােত। এখন দেয়া নয়, চলে শুধু নেয়া! খাল ভরে, বিল ভরে, জলাশয় ভরে, খেত-খামার ভরে গেছে বালুতে, নদী থেকে বালু তুলছে বড় বড় ড্রেজিং পাইপ দিয়ে। নদীর চৌদ্দটা বাজিয়ে দিয়েছে নেতা, মেঝো নেতা, আতি-পাতি নেতায় কিলবিল করছে দেশ। দেশে উন্নয়নের জোয়ারে ক্ষেত-খামার ভরে গেছে বড় বড় তালগাছের মত উচুঁ অট্টালিকায়। অনাবাদী ক্ষেতগুলো পড়ে আছে চরম অবহেলায়। ক্ষেত-খামারে কাজ করার লোকের বড্ড সংকট। গ্রামগুলো গিলে খাচ্ছে নগরায়নের নামে লুটেরা দুবৃর্ত্তেরা!
বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, চিত্রা, মনু, কালিগঙ্গা, মধুমতি, ইছামতি, ব্র²পুত্র হারিয়েছে যৌবন নাব্যতা। বালুহীন নদীগুলো ঠুটো জগন্নাথ বনে গেছে। শীতল²্যকে ছোট্ট পানা পুকুরের মতো দেখায়। ভূমিখেকো, জলখেকো, বালিখেকোয় দেশ সয়লাব!
রাতারাতি দ্রব্যের দাম বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে! দেখভাল করার কেউ নেই? রঙিন রোদচশমা চোখে বিদেশ ট্যুরে ব্যস্ত দেশপ্রেমিকের দল। দলবাজি আর টেন্ডারবাজির বিজয়কেতন হাহাকারের শঙ্খধ্বনি বাজছে। আর ভূমিহীন ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারিতে বাতাস বিপন্ন হয়ে ওঠে।
গোস্তের দোকানের আশে পাশে ডোম মাছির মতো ঘুরপাক খায় মনু। গরুর ইয়া বড়ো তলচকচকে সিনা দোল খাচ্ছে লোহার শিকে। মস্তো বড়ো চর্বিওয়ালা রানের রূপ দেখে ঘোর লাগে দু’চোখে। রানের সলিড গোস্ত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। ঠ্যাং দু’খানা উপরে তুলে মাথা নিচু করে আছে নৃত্যরত উলঙ্গ খাসি। দেখে শরম লাগে। ন্যাংটা ন্যাংটা লাগে। মলিন হয়ে যাওয়া, তালি মারা শাড়িটা কি ঠিকমতো গোপন অঙ্গগুলো ঢেকে রেখেছে? পরখ করে নেয় মনোয়ারা নিজেকেই। টাক দিয়েছে গতরাতে শাড়ির ছেঁড়া জমিনগুলো। দিন গুনছে বিশ বাইশ রোজার। মাগফিরাতের সময়টায় যাকাতের শাড়ি-লুঙ্গি বিলায় জুম্মন ব্যাপারি। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে দুটো শাড়ি জুটবে কপালে! মানুষের মাথা মানুষে খায়! সেহেরি খেয়ে লাইন ধরে শাড়ি মাগার জন্যে। দশ তেরো ঘন্টা অধীর অপেক্ষার পরে জোটে বহু কাক্সিক্ষত শাড়ি, কারো লুঙ্গি আর অশ্রাব্য অঝোরধারার গালিগালাজ, খিস্তি খেউর। কুকুরের সোদর এরা। কুকুরের গায়েও মায়া-দয়া আছে। এদের তাও নেই। অর্থ-বিত্ত আছে, মায়া নেই, নেই মমতা, ভালোবাসা, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম। দেশের মালিক এরাই।
জনমদুখী মায়ের গর্ভজাত সন্তান মনোয়ারা। মা আদর করে মনু ডাকে। অভাবে দারিদ্র্যে দীনতায় আর অবহেলায় মনোয়ারা নামের অক্ষরগুলো ধুলো-ময়লা-আর্বজনায় বিলীন হয়ে যায় কালের  স্রোতে। ফুল পাখির ঘুম ভাঙাতো মনু। শিউলি ফুলের মালা গেঁথে কাঁসার বাটিতে রেখে গোসলের সময় শীতলক্ষ্যায় ভাসিয়ে দেবে। নদী তার সই। শীতলক্ষ্যা জনম জনমের সই।
সুরে সুরে ঠোঁট রাঙিয়ে মনু গায়:

আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুমবাগে উঠবো আমি ডাকি
…………………………………………..
আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে
তোমার ছেলে উঠলে মাগো রাত পোহাবে তবে…..

সিটি পল্লীর বস্তির ঘরে ঘুম ভাঙতেই দু’চোখ মেলে ছোট্টবেলার ভোরের শুভ্রতায় শিউলির সুবাসিত মমতায় গুনগুন করে দু’ঠোঁটের জমিন। অভাব, দারিদ্র্য, অবহেলা, নির্যাতন, সহিংসতার প্রতিরোধ নিজেই করে মনু নিজের সাথে। বড় মেয়ে দু’টোকে লেখাপড়া করাতে পারেনি। ডাঙ্গর হতে না হতে ওদেরকে গেরস্তের ঘরে চালান করেছে শিয়ালের লোলুপ থাবার আগ্রাসন ঠেকাতে। আধপেটা সংসারে চালান করেছে আদরের মেয়ে দু’টোকে।

পাখি, আঁখি মনুর ছোট দুই মেয়ে। গার্মেন্টেসে যায় আঁখি। পাখির ডান পা একটু ছোট। খুঁড়িয়ে হাঁটে। কোনো কাজ না পেয়ে ঘরে বসে মা-মেয়ে ঠোঙা বানায়। তাল তাল টুকরো কাগজ আর লেইয়ের ডিব্বা। এই এদের জগৎ। দু’মেয়ের রোজগারে ঢিমিয়ে খুঁড়িয়ে চলে মনুর চালচুলোহীন জগত সংসার। মেয়েরা মাকে গাইলায়, “পোলা পোলা কইরা তোমার জীবন যাইবো। পোলা কি তুমারে জিগায়? না ভাত কাপড় দেয়? ”
মেয়েদের গরম ছ্যাঁকা দেয়া কথাগুলো দাঁত চিবিয়ে, মুখ খিঁচিয়ে হজম করে।
সিটি পল্লীর দুষ্টু পোলাপানের লগে মনুর আদরের ধন পুত বিশ্ব ওরফে বিশু মিশে গেছে পানাপুকুরের জলে। যে জলে নামা যায়, সেই জল থেকে কিন্তু কেউ কখনো ডাঙায় ফিরতে পারেনি।
প্লাস্টিকের ঠোঙায় মুখ ডুবিয়ে বড় বড় আরামের নিশ্বাস নেয় বিশু। বিশুর হাতে প্লাষ্টিকের ঠোঙা ধরিয়েছে সিটি পল্লির সর্দার। “দে বেডা সুখটান দে, কুনু দুঃখ থাকবো না। দে টান। টান দে মন ভইরা।” চকচকে ছুরি, মলম তুলে দেয়। যাত্রাবাড়ি ফ্লাইওভারের নিচে আস্তানা গাড়ে। খ্যাপ মারার আশায় ডাহুক পাখির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অলখের পানে। বিশু, কামাল, রশিদ, জানু, ইমরান পঞ্চ পান্ডব এরা। রিক্সার যাত্রীর চোখে মলম দিয়ে ম্যানিব্যাগ, মোবাইল, হাতঘড়ি, ভ্যানিটি ব্যাগ, বেল্ট, জুতো, স্যুটকেস, ব্রিফকেস ছিনিয়ে গা ঢাকা দেয়। চুরি চামারি, নেশা ভাঙ্গে মেতে উঠে। জুয়া, আড্ডা, মাগিবাজি মউজ মস্তি সবই চলে পবিত্র সংযমের চোখ ফাঁকি দিয়ে।
বিশুর মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে। মানুষ হবে। “সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় যার মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার!” স্কুল নেই, বাড়ি নেই, মমতা নেই, দেশপ্রেম নেই, নৈতিক শিক্ষা পায়নি বি ত বিশু। মা-বোন আছে বোনদের ইজ্জত রক্ষার দায়িত্ব নিতে শিখেনি। সুন্দর, সৎ কল্যাণের মমতাময় সাহচার্য জোটেনি বিশুর কপালে। ভাগাড়ের ময়লার চেয়েও জঘন্য এদের যাপিত জীবন।
সর্ষের ভেতরে ভূত! রুখবে কে বিশুদের? দেখবে কে বিশুদের? আল্লাও দেখে না বিশুদের! ওদের মালিক জুম্মন বেপারি। সিটির পল্লীর মালিক। ওদের সবার মালিক। স্কুলে লেখাপড়া নয় ওরা শেখে জাল ভোট দেয়া। ভোট কেন্দ্রের দেখভাল করা। দখলদারির রমরমা মহরত চলছে গোটা দেশ জুড়ে। বিশুরা সমাজের অভিশাপ নয়-ওরা গনতন্ত্রের হাতিয়ার!

ওদের গুরু, ফাদরের ফাদাররা ধরি মাছ না ছুঁই পানি। পথে নামায় ওদের। অন্ধকারে অতল গহীনে পা বাড়ায়। চোরাবালিতে হারিয়ে যায় কেউ। কেউ হয়তো ফিরেও। হারিয়ে যায় যার সে বোঝে হারানোর হাহাকার। কি যাতনা বিষে, কভু আশিবিষে দংশেনি যারে …….
বিশু ফিরেনি গতরাতে। সজনে গাছে প্যাঁচাটা ক্ষনে ক্ষনে ডুকরে কেঁদে ওঠে। আনচান করেছে মনু সারা রাত। মনে কুঁ ডেকে যায়। আয়তুল কুরসি পড়ে বুকে ফুক দেয়। ঘর বদ্ধ করে। দু’চোখ বন্ধ করে বিশুর চেহারা দেখে আর ফুক দেয় মুখে বুকে শরীরে।
“আল্লায়ো আমার পুতেরে বালা রাইখো। শয়তানের আসর থেইকা ফিরাইয়া আইনো গো মাবুদ। মাবুদ য়ো মাবুদ।”
সেহেরী খেয়ে শুয়েছে। ঝিমুনিতে দু’চোখ লেগেছে মাত্র। সিটি পল্লির সারা বস্তিতে হৈ চৈ। গুঞ্জন। ফিস ফাস! দৌঁড়ঝপ! ধরফরিয়ে শোয়া থেকে দাঁড়ায় মনু। থরথর কাঁপছে বুক। কইলজা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। দু’হাতে বুক চেঁপে ধরে। একি তাজ্জব দৃশ্য! এ দেখার জন্য এখনো বেঁচে আছে মনু!
কারা যেন ধরাধরি করে বিশুকে শুইয়ে দেয় মনুর কপাটের পাশে। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। মনুর চিৎকারে গোটা সিটি পল্লির আসমান জমিন কেঁপে ওঠে। কেঁদে বুক ভাসায় সমবেতজন।
“ওোঁ মাবুদ! তুমারে কইছিলাম গো মাবুদ আমার পুতেরে বালা রাইখখো। শয়তানের আসর থেইকা ফিরাইয়া দিও গো মাবুদ……
মনুর গগনবিদায়ী চিৎকারে বিজু বৈসাবীর সুবাসিত ফুলে, নীলিম জলের নোনা ¯্রােতের ধারা চমকে দাঁড়ায়। মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরুদ্ধ অপশক্তি পৈশাচিক নির্মমতায় বিশুর অপ্রাপ্তির নির্ঝরের স্বপ্নালোকের আনন্দগান, বৈশাখের নকুলদানা, কদমা, বাতাসা, রমনার বটমূল, পান্তা-ইলিশ, লাটিম, মোয়া, মুড়কি, বিন্নি ধানের খৈ-কালো গাভীর দৈ, ঈদের লাল পাঞ্জাবির স্বাদ থেকে বি ত বিশু জাপটে ধরে আজরাইলের সাদা ডানাদুটো।
মায়ের কান্নার আহাজারি বিশুকে স্পর্শ করছে না, বোনের আর্তনাদের মর্মন্তুুদ ধাতব শব্দে ভোঁতা বিশুর কর্ণকুহর। সংযমের পবিত্রতার গোলাপ-আতর লোবান জলে হারিয়ে যায় নিশীথের পথে।

=================