You are currently viewing আজও অভিনন্দিত নয়/ জেবুন্নেছা জোৎস্না

আজও অভিনন্দিত নয়/ জেবুন্নেছা জোৎস্না

আজও অভিনন্দিত নয়/ জেবুন্নেছা জোৎস্না

সন্ধ্যায় নিউইর্য়ক নগরী যেন এক স্বপ্নপুরী। কেউ স্বপ্ন পকেটে পুরে, আর কারও স্বপ্ন আতশ বাজীর মতো মিলিয়ে যায় মধ্য আকাশে। ভাঙ্গা স্বপ্নের দীর্ঘশ্বাস শুন্যে ছুঁড়ে ব্যস্ত হই রেস্টুরেন্টের পার্টির ব্যবস্থাপনাতে। আজ পাঁচটা থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত কাজের শিফট। রেস্টুরেন্টে হার্ভাড থেকে সদ্য পাশ করা এক সাদা তরুণীর গ্রাজুয়েশন পার্টি চলছে; আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ হাস্যজ্বল তরুণটির পাশে তার গর্বিত বাবা-মা, আর সারাক্ষণ হাত ধরে থাকা ছেলেটি বোধ করি ওর বয়ফ্রেন্ড হবে। আমার বয়সী একটি মেয়ের সাফল্যৎসব দেখে,  নিজের ব্যর্থতা আর ভুলের অতীতগুলো আবার যেন নতুন করে হৃদয় মুচড়িয়ে গেল; সবকিছু ঠিক থাকলে আমিও হয়তো আজ গ্রাজুয়েশন করতাম! রিহ্যাব থেকে ফিরে এসে  মাসখানেক হলো রিসেপশেনিস্টের এই  জবটা পেয়েছি। ফেলে  আসা অতীতের দুঃসহ যন্ত্রণা ভুলে আবার নতুন করে বাঁচতে চাই, একদিন আবার আমার স্বপ্নের ক্যাম্পস হার্ভাডে ফিরে যাবো এই প্রত্যাশায়। আর তাইতো  কখনও ডাবল শিফটেও কাজ করতে হয় ইউনিভার্সিটির ক্লাসের খরচ যোগাতে।  আজ কেন জানি বার বার আ্যলেক্সের কথা মনে পরছে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, বিপরীত গোলার্ধের ভিন্ন দুই সমাজে, আমার জীবনটাও আমার মা’য়ের মতো অবহেলিত হয়ে গেল; তবে আমার মা হারেনি, জানি আমিও হারবো না।

আমার দুবাই প্রবাসী বাবা মা’কে বিয়ের পর  বাংলাদেশের এক  মফস্বল শহরে মা’কে তার যৌথ পরিবারে রেখে দু-বছর পর পর দেশে আসতো, আর দু-মাস থেকে চলে যেত। আমরা একে একে চার বোন হয়ে যেন মা’য়ের জীবনটা একদম নরক করে দিলাম। বংশের প্রদ্বীপ জ্বালানোর অস্থিরতায় আমার দাদী তখন রাত-দিন এক ভয়ংকর ব্যধিতে ভূগতো, আর যত রকম মানসিক কষ্ট দেয়া যায় তার সবটুকুই মা’কে দিত। আমার মামা’র কারণে আজ সাত বছর হলো আমরা ইমিগ্রান্ট হয়ে নিউইর্য়ক এসেছি; মা সংসারের সব কাজ সামলিয়ে নিউইর্য়কের বিভিন্ন বাঙ্গালী দোকানে হাতে বানানো রুটি, পিঠা, আর শুটকী ভর্তা সাপ্লাই দিয়ে, কখনও বা পরিচিত বাঙ্গালী মহিলাদের কাপড় সেলাই করে  আজ স্বাবলম্বী এক নারী। এ বয়সে যখন অনান্য মেয়েরা পড়াশুনার পাশাপাশি  জব করে, মা তখন তার কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে কেবল আমাদের পড়া-শুনা করতে বলতো। সবই ঠিক ছিল, হার্ভাডে যাওয়ার আগ পর্যন্ত; ডর্মে থাকাকালীন বন্ধু-বান্ধবের সাথে আমেরিকান কালচার অনুসরণ করতে যেয়ে প্রতি সন্ধ্যায় পড়াশুনার চাইতে হৈ-হুল্লোড় আর রাত অবধি পার্টিতে অভ্যস্ত হয়ে পরি একসময়; আর কোন রকমে সি প্লাস পেয়ে সেমিস্টার গুলো উতরে যাই।

আমি যখন সোফোমোর, তখন  আ্যলেক্সের সাথে আমার পরিচয়। সে সদ্য একটি ব্যাংকে জবে ঢুকেছে, সচ্ছল। কিন্তু ওর পারিবারিক ইতিহাস আমাকে ব্যথিত করতো: ওর মা সালুদা নিজের জীবনে ঘুরে দাঁড়িয়ে সফল হতে  পারিনি;  ইকুয়েডর থেকে আসা স্বল্প ইংরেজী জানা মহিলা, জীবিকার তাগিদে নিউইর্য়কের রাস্তায় পিনাটা বিক্রি করে; ফুড স্ট্যাম, ইবিটি ক্যাশ আর শেল্টারে থেকে সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছে। সাময়িক ভাল লাগায় সে কেবল এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে গিয়েছে, আর প্রত্যেকেই তাকে একটি করে বাচ্চা দিয়ে,  দায়িত্ব এড়িয়ে পালিয়ে গিয়েছে। শেষ যৌবনে এসে সে খুব চাইছিল কাউকে বিয়ে করতে, কিন্তু সব পুরুষই তাকে ধোঁকা দিয়ে চলে গিয়েছে। আর এখন সে একজন সিঙ্গেল মাদার, পাঁচ ছেলে-মেয়েক  লালন করেছে, যাদের প্রত্যেকেরই বাবা ভিন্ন। যদিও আমেরিকার কালচারে এটা কোন ব্যাপার না। এখানে মহিলারা ইয়াং বয়সে সংসার করে স্থিতু হবার চাইতে লিভ টুগেদার করতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তারা বিয়ে করতে চায়না ডিভোর্সের আশংকায়; আর এ ভাবেই বিবাহ বর্হিভূত জীবন কাটিয়ে দেয় অনেক বছর, কখনও বা যুগ।

আমার শ্যামলা বর্ণের গায়ের রঙ, লম্বা চুল আর কালো চোখের কারণে আ্যলেক্স আমাকে পাগলের মতো ভালবাসত, আমিও। ওর  বুদ্ধিদীপ্ত চলন, অতি যত্নে গড়া শারিরীক সুঠামতা, আর সেই সাথে আমার প্রতি ওর  সীমাহীন যত্ন আমাকে অধীর করে তুলতো সারাজীবন ওকে  কাছে পাবার। সুযোগ পেলেই দু-জন মিলে ঘোরাঘুরি, মুভি দেখা, শপিং করা; একসময় আমরা একে অপরের খুব কাছে চলে আসি এবং মাঝে-মধ্যেই আমি আ্যলেক্সের আ্যাপর্টমেন্টে আমার অবসর সময় কাটাই। তবে সারক্ষণ একটা  ভয় থাকে, যদি আ্যলেক্স আমাকে ছেড়ে চলে যায়, যেভাবে তার বাবা তার মা সালু’দাকে প্রতারিত করেছে; তাই আত্মসম্মান ভুলে বাঙ্গালী কালচারের প্রসঙ্গ এনে আ্যলেক্সকে বিয়ের ব্যপারে মাঝে-মধ্যে  চাপ দিতাম; কিন্তু বিয়ের প্রসঙ্গ এলেই সে কেমন যেন এড়িয়ে যেত। এমনি ভাবেই দু-বছর কেটে গেল— একদিন বুঝতে পারি যে  আমি কনসিভ করেছি। ব্যাপারটা আ্যলেক্সকে বলতেই সে প্রচন্ড উচ্ছাস প্রকাশ করলো। সেদিন সন্ধ্যায় আ্যলেক্স তার মা আর পরিবারের সাথে পারিবারিক ডিনারে আমাকে নিয়ে গেল এমন আনন্দ সংবাদ সবার সাথে সেলিব্রেট করতে; ডিনার শেষে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আ্যলেক্স আমার সামনে একটি হীরার আংটি বের করে জানতে চাইলো যে তাকে আমি বিয়ে করতে চাই কিনা! আমার  আনন্দের সীমা রইলো না।তবে আ্যলেক্স এবং তার পরিবার এটাও জানালো যে তাদের একটি ছেলে সন্তান চাই; তাদের পরিবারে অনেক মেয়ে, তারা আর কোন মেয়ে বাচ্চা চায় না। মুহুর্তে আমার জগতটা বিষন্ন হয়ে যায়; পৃথিবীর সমঅধিকারের একটি দেশেও কেউ আগত সন্তানটি পুত্র হোক এই চায়; তবু  মনের সমস্ত জোড় দিয়ে বিশ্বাস করতে থাকি যে আমাদের একটি ছেলে সন্তানই হবে।

এ সময় আ্যলেক্স আমাকে দুরে রাখতে চাইনি, তাই আমি ওর বাসায় মুভ হয়ে চলে আসি; পার্ট টাইম জব আর পড়াশুনার প্রেশারের কথা বলে মা-বাবাকে উছিলা দেই ছুটিতে নিউইর্য়ক না যাওয়ার। আমি আর আ্যলেক্স এখানে-সেখানে ঘুরে, সেল দেখে আমাদের স্বপ্নের ঘর সাজাই; আ্যলেক্স সব কিছুই ব্লু কালারের কিনে, আর আতংকে আমি আমার মধ্যে চুপসে যাই, যদি বাচ্চা ছেলে না হয়। চার মাসের দিকে নির্ধারিত আলট্রাসনোগ্রামের দিন  আ্যলেক্স খুবই উৎফুল্ল, সে নিজ হাতে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে, অফিসে না যেয়ে, ড্রাইভ  করে আমাকে  হসপিটালে নিয়ে যায়। সনোগ্রামের শুরুতেই আ্যলেক্স সনোগ্রাফারকে বলে দিল যে, বাচ্চাটিকে অবশ্যই ছেলে হতে হবে, ছেলে ছাড়া সে অন্য কথা শুনতে চায় না। সনোগ্রাফার যখন দেখলো ফিটাসের সেক্স অর্গান মেয়ের, তখন সে দ্বিধা গ্রস্ত করছিল বলবে কিনা, কিন্তু  আ্যলেক্সের অনুরোধে সনোগ্রাফারকে বলতেই হলো যে আগত বাচ্চাটি মেয়ে।  সাথে সাথে রুমে পিন পতন নিস্তদ্ধতায় আমি  হাউমাউ করে কেঁদে উঠি; আ্যলেক্স তখন সনোগ্রাম শেষ না হতেই রুম ছেড়ে চলে যায়। তারপর অনবরত  আমি আ্যলেক্সকে ফোন দিতে থাকি, কিন্তু সে ফোন পিক আপ করলো না, অথবা ফিরে এলো না আমাকে  নিতে। এমনকি তার পরিবারকে ফোন করেও কাউকে পাওয়া গেল না। আমি তার আ্যপার্টমেন্টে ট্যাক্সি কল করে এসে দেখি, আমার পৌঁছানোর আগেই সে তার প্রয়োজনীয় জিনিষ-পত্র নিয়ে কোথাও চলে গেছে। কষ্ট আর অপমানের -যন্ত্রণা ভুলে থাকার  জন্য আমি  তখন দিক শুন্য হয়ে নেশার পথ বেছে নেই; বাবা-মা’র কাছে যাব যে সে মুখও নেই। অনিয়মিত জীবন-যাপনে প্রেগনেন্সির পাঁচ মাসের দিকে হঠাৎ প্রচুর রক্তক্ষরণে আমার আ্যবেরশন হয়ে যায়। ব্যাপারটা তখন ইউনির্ভাসিটিতে জানাজানি হলে সুস্থতার জন্য আমাকে রিহ্যাবে পাঠানো হয়।

বাইরে প্রচন্ড শীত, কিন্তু ঝকঝকে আকাশে ঝুলে আছে উজ্বল চাঁদ; এত সুন্দর পৃথিবী, কিন্তু আমার জন্য কেউ কোথাও নেই অপেক্ষায়, কেউ বলবে না, তোমার সব ব্যর্থতা আর কিছুই না দেবার পরেও তোমাকে ভালবাসি; হাসি-ঠাট্রা আর নাচে ব্যস্ত নারী-পুরুষের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হয়। তবে সবচেয়ে বড় অভাগা তো সে, যে পৃথিবীতে আসার আগেই কেউ তাকে চায়নি, আর তাইতো সে অনেক অভিমান নিয়ে আর পৃথিবীতেই এলো না। কেবল মধ্য রাতের দুঃস্বপ্নে খুঁজি আমি তাকে, আর কেউ না হোক, অনাগত পরীটা তো কেবল আমার হতে পারতো! কিন্তু স্বর্গের পরী  ঠিকই বুঝেছিল, এই একবিংশ শতাব্দীর সভ্য শহরের  কোথাও আজও মেয়ে হয়ে জন্মানোটা মোটেই অভিনন্দিত নয়!