You are currently viewing আগুনকাফন>  বিপাশা মণ্ডল

আগুনকাফন> বিপাশা মণ্ডল

আগুনকাফন

বিপাশা মণ্ডল

হাতেম আলী কলেজের কাছাকাছি একটা মেসে থাকত আনিস। ঢাকায় ২৫ মার্চের তুমুল অত্যাচারের কথা শুনে মা ন্যাওটা আনিসের চোখে প্রথম ভেসে উঠেছিল মায়ের মুখ। তারপরেই মসজিদের মুয়াজ্জিন বাবার মুখ। বাবা নিরীহ গৃহস্থ কৃষক। এরপর একে একে ছোটো ভাইবোনদের মুখ, শেষে দাদীর মুখ। ঐ মুহূর্তে ও ব্যাগ ও ত্রিপল ঢাকা বেডিং বেঁধে পরদিন সকাল সাতটার মুনীর লঞ্চে উঠে বসেছিল। বুকের মধ্যে উৎকণ্ঠা। চারটা টিউশনি করাত। দুটো বাড়ির টাকা পেয়েছিল পনের ও বিশ পঁয়ত্রিশ টাকা, অন্য দুটো বাড়ির টাকা পায়নি। গত রাতে তাদের দুটো বাড়িতেই গিয়ে দেখে বড় বড় তালা ঝুলানো। শহরের রাস্তা থমথমে। এক অন্তহীন অন্ধকার যেন পুরো পৃথিবীকে গিলে খেতে আসছে।

বাড়ি ফিরে ও অবাক হয়ে গিয়েছিল। কোথায় যুদ্ধ! কোথায় দুশ্চিন্তা! লঞ্চ ঘাট থেকে রিকসা করে বাড়ির রাস্তার মুখে রিকসা ছেড়ে দিল আনিস। গঞ্জের বড় বড় দোকানগুলোয় ধুমসে রেডিও বাজছে, ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া।’ ওখান থেকে বাড়ির রাস্তা আধ ঘণ্টার হাঁটা পথ। রাস্তার পাশের ধানজমিগুলো এখন ফাঁকা। দু একটা জমিতে রবিশস্য এখনো আছে। অন্যান্য শুকনো খটখটে মাঠে পুরো গ্রামের ছেলে মেয়েরা ডাংগুলি আর ফুটবল খেলতে নেমে গেছে। বাড়িতে ঢুকে দেখে, উঠানে আব্বা বিরাট এক ইলিশ মাছ কিনে এনে সদরুল চাচার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। আনিসকে দেখে অবাক হলেন, “তোর কলেজ কি বন্ধ হইছে নি? পড়া ফাঁকি দিস না আনিস, গরীব মাইনসের পড়া ছাড়া কিছু নাই।”
আনিস অবাক হয়। এরা কি দেশের পরিস্থিতির কথা কিছুই জানে না! ও দমে যাওয়া গলায় বলে, “দেশের যা পরিস্থিতি। কলেজে তো বেশিরভাগ দিনই ক্লাস হয় না। হোস্টেলও অর্ধেকের বেশি খালি হয়ে গেছে।”
“যাউকগা। যাগো টাকা আছে। তারা বাড়িতে গিয়া সুখ আহ্লাদ করুক। আমরা গরীব মানুষ। একক্লাসে দুই বছর পড়ানোর তৌফিক নাই।”
সদরুল চাচাও বলে ওঠে, “কামডা তুমি ঠিক করো নাই বাজান। দেশে পাট্টি থাকলে, লড়ালড়ি হইবে। হের লইগ্গা তো নিজের কাজ-কাম শিকায় তোলন যাইবে না। হেগো আর কি, আমাগো তো খাইট্টাই খাওন লাগে।”
আনিসের মনে হচ্ছে খুব ভুল হয়ে গেছে। সহপাঠীদের দেখাদেখি, খবরের কাগজ পড়ে আর রেডিও শুনে বরিশাল ছেড়ে চলে আসা ঠিক হয়নি। কিন্তু ওই শহরের তো অর্ধেক মানুষই কোথায় কোথায় চলে গেছে!
“আনিস, ভিতরে আয় বাবা, হাত-মুখ ধুইয়া ল।” মায়ের স্নেহার্দ্র কণ্ঠের ডাক শুনতে পায় আনিস। বুঝতে পারছে বাবার কঠোর জিজ্ঞাসাবাদ থেকে ওকে বাঁচাতে চাইছে।

দুই দিন পরে সকালবেলায় ফজরের আযান দিয়ে ও নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন আনিসের বাবা ফকরুল মিঞা। উঠানে বসেই আনিসের বাবা আনিসকে বোঝাতে লাগলেন, পড়াশোনাই আসল, এতে ফাঁকি দিতে নাই। বাড়িতে ঢুকল সদরুল চাচা, হাতে একটা তিন ব্যান্ডের রেডিও। চোখমুখ আতঙ্কে বসে গেছে, মুখ হা হয়ে আছে। কোনোক্রমে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়াল আনিসের বাবার পাশে, “অবস্থা খুব খারাপ ভাইজান, ঢাকায় তো কাতারে কাতারে মানুষ মাইরা ফালাইতেছে, বরিশালেও বোমা পড়ছে।”
বৈশাখের অর্ধেক পার হয়ে গেছে, তারপরেও একটা হিমেল বাতাস যেন আনিসের শিরদাঁড়া ভেদ করে ভিতরে ঢুকে যায়। যদি ও তখন বরিশালে থাকত? আনিসের বাবা একটু অপরাধীর দৃষ্টিতে তাকায় আনিসের দিকে। এই এক্ষুনি তিনি ছেলেকে সবক দিচ্ছিলেন যেন সে বরিশাল ফিরে যায়।

এখন গ্রামে একধরনের আতঙ্ক, একধরনের অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছে। যদিও অনেকের আচরণে যা হয় হোক এরকম একটা মনোভাবও দেখতে পায় আনিস।
সেদিন ভোর হওয়ার আগেই দুইটা স্পীডবোড এবং একটা লঞ্চ ভর্তি মিলিটারি থামে আনিসদের বাড়ি ছাড়িয়ে দু বাড়ি পরের বড়ো খালের ঘাটে। আনিসের মা পাক ঘরে পাক করছিল। বাবা মসজিদ থেকে ফিরে গরুর জন্য বিচালি কাটছিল। ছোট তিন ভাইবোন উচ্চস্বরে বই পড়ছিল। দাদী ধানের কুঁড়ো আর ভাতের ফ্যান মাখছিল হাঁস-মুরগীকে খেতে দেবে। আনিস সকাল বেলাই একটা জাল আর হাড়ি-খালুই নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়ে গেছে। তখন এলাকার নয় বছরের ছেলে জিতুর দায়িত্ব ছিল বড়ো খালের ঘাটে নজর রেখে রেখে গ্রামের সবাইকে সতর্ক করার। ও দূর থেকে একবার শুধু বুঝতে পারল যে যানবাহনগুলো মিলিটারির, সঙ্গে সঙ্গে কূউ-উ-উ-উ কুকু কূউ-উ-উ-উ কুকু বলতে বলতে পানকৌড়ির মতো গলা থেকে রক্ত বের করে ফেলল। আনিস তখনও মাছ ধরছে খানিকটা দূরের একটা খালপাড়ে। ও টের পেল না ছোট্টো জিতুর সতর্কবাণী। ঘাটে এসে লঞ্চ লাগার সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্বাগত জানাতে হাতে হাত ঘষতে ঘষতে এগিয়ে গেলো ইউনিয়নের রাজাকার গ্রুপের চেয়ারম্যান কাসেম মিঞা। মিলিটারিরা প্রথমেই গেল পুবদিকের হিন্দু পাড়ায়। যাকে সামনে পেল গুলি করে মারলো। দামী জিনিসপত্র লঞ্চে তুলল। এরপর খালি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল।

পুব পাড়া থেকে পশ্চিম দিকে এগোবার সময় হঠাৎ কাসেম মিঞার চোখ গেল পাড়ার শেষপ্রান্তে একটা পোড়োবাড়ির দিকে। ঘৃণায় রি রি করে উঠলো কাসেম মিঞার শরীর। ছোটোবেলায় ঐ বাড়িতে একদিন ঐ বাড়ির ছোটো ছেলে হারাধনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল। কখন যেন বেখেয়ালে ওদের রান্নাঘরের দাওয়ায় ঢুকে পড়েছিল লুকাতে। ব্যস হারাধনের আশি বছরের বৃদ্ধা ঠাকুমা সঙ্গে সঙ্গে চিলচিৎকার দিয়ে উঠেছিল, “নাম নাম, শীগগীর নাম রান্নাঘর দিয়া।” শুধু ওকে নামিয়ে দেওয়া নয়। সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে গোবরজল এনে পুরো রান্নাঘর লেপে দিয়েছিল বুড়ি। কাসেম মিঞার ঘৃণা যেন বলকে বলকে উঠে আসে ঐ দিনের ছড়িয়ে দেওয়া গোবরের ঘ্রাণের ম তোই। ও মিলিটারি কমান্ডারকে উর্দূতে বোঝায়, এই বাড়িটাও হিন্দুদের। ওরা দেশদ্রোহী, পালিয়ে ভারতে চলে গেছে। এই বাড়িটাও পুড়িয়ে দেওয়া উচিত। বাড়িটা বহুদিন থেকে পরিত্যক্ত দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। শুধু শুধু পেট্রোল খরচ করার দিকে কমান্ডারের আগ্রহ ছিল না। কিন্তু কাসেম মিঞার চাপাচাপিতে বাধ্য হয়ে কয়েকজন জোয়ান পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরাতে উদ্যোগী হল। কাসেম মিঞা এরমধ্যে বাড়ির চারপাশে পরে থাকা বেশুমার সুপারীগাছের শুকনো কড়কড়ে খোল এনে বাড়িটার উপরে ছুঁড়ে মারতে লাগলো। ইন্ধন ও আগুন একজোট হয়ে মুহূর্তেই পুরোবাড়িটায় জ্বলে উঠলো ভয়ঙ্কর আগুন।

ছোটোখালে চারবারের বার জালটা ফেলে টেনে তুলতেই আনিসের কানে আর্তচিৎকার ভেসে আসে। পূর্বদিকে ধোয়ার কুÐলী। আনিস প্রথমে বুঝে উঠতে পারে না কী হয়েছে। পরে এক ঝটকায় মনে পড়ে খবরের কাগজে ছাপা হওয়া বীভৎস ছবি, রেডিওতে শোনা ভয়ঙ্কর অত্যাচারের বিবরণ, প্রত্যক্ষদর্শী নাহিদ ভাইয়ের বলা ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অত্যাচারের ঘটনা। আনিসের বুক কেঁপে ওঠে।
তার এখন খুব দ্রুত বাড়ি ফেরা দরকার। মা কী করছে? আমেনা, আম্বিয়া আর আরিফ কোথায় আছে? আব্বা? আব্বা কী আবার মসজিদে ফিরে গিয়েছিল? নাকি বাড়িতেই? দাদী?
আনিস পাগলের মতো বন-বাদার ভেঙ্গে বাড়ি ফিরে যেতে চাইছে। কিন্তু ওর পা দুটো যেন কেউ খালপাড়ের বাঁশঝাড়ের ওই ঝোপের ভিতরেই পুঁতে দিয়েছে। যেন ওর পায়ে শেকড় গজিয়ে গেছে। নাহিদ ভাই বলেছে, ‘পাকিস্তানী সেনারা বেছে বেছে জোয়ানদের হত্যা করে। জোয়ানদের হত্যা করে যেন তারা রুখে দাঁড়াতে না পারে, তাদের একাধিপত্য বজায় থাকে। আনিস যদি এখুনি বাড়ি যায়, যদি পাকিস্তানী সেনারা ওকে ধরে ফেলে, যদি স্থানীয় বিশ্বাসঘাতকেরা ওকে ধরিয়ে দেয়?
আনিস কোনো সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারে না। একদিকে মায়ের প্রতি প্রবল ভালোবাসা অন্যদিকে নিজের জীবনের আশঙ্কা। আনিস দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ একসঙ্গে কয়েকটা কুকুর তারস্বরে ডেকে ওঠে। কয়েকটা গুলির শব্দ তারপর মৃত্যুশীতল নীরবতা। পুবদিকের ধোয়ার কুÐলী পুবদিক ছাড়িয়ে সবদিকে ছেয়ে ফেলছে উপুড় পেয়ালা ঝকঝকে নীল আকাশটাকে। যেন এই সকাল বেলাতে সন্ধ্যা নেমে এসেছে মাছিমপুর গ্রামে।
আরো একঘণ্টা পানির মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকে । নিজে একটু ধাতস্থ হয়ে পায়ের দিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠে। তিনটি ছোটো সাইজের জোক লেগে আছে। জোঁকগুলো রক্ত খেয়ে ফুলে পটোলের মতো ঢোল হয়ে গেছে। জোকের ভয়ে আগেই ও বাড়ি থেকে একটা কাঁচি এনেছিল। ডাঙায় উঠে কাঁচি দিয়ে টেনে নামিয়ে জোঁকগুলোকে কুচিয়ে কুচিয়ে মারে। জোঁকগুলো কম পক্ষে আধপোয়া রক্ত শুষে নিয়েছে শরীর থেকে। ওর মাথার মধ্যে ঝিলিক দিয়ে যায়, পাকিস্তানী বাহিনী কি জোঁকের চেয়ে কম কিছু? ঊনিশশো আটচল্লিশ থেকে শুরু করেছে নিজেদের কর্তৃত্ব বিস্তার। বাংলাদেশের মানুষকে কি ওরা সম্মানের চোখে দেখে? নিজেদের বড় মনে করে আর বাংলাদেশের মানুষের খাটনির রোজগারে নিজেদের ব্যাঙ্ক ভর্তি করে। এরাও তো কোনো মহাজনের চেয়ে কম না। আনিসের মাথা থেকে আবার দীর্ঘস্থায়ী শোষণের ইতিহাস সরে গিয়ে বর্তমান আক্রমণের বিষয়টাই মূখ্য হয়ে ওঠে। এখন কী করবে ও? কীভাবে পরিবারের লোকজনদের বাঁচাবে? আনিস চট করে নুয়ে পড়ে খালপাড় থেকে কিছুটা পলিমাটি খুবলে নেয়। একটা ডানকানা মাছ লাফিয়ে সরে যায় ও হাত বাড়ালে। দ্রæত মাটি মাখে হাতে পায়ে মুখে ও গলায়। চুলেও মাখে খানিকটা। জাল ও খালুই নিয়ে এবার ও বাড়ির পথ ধরে, জানে না এভাবে গিয়ে বিপদ থেকে রেহাই আদৌ পাওয়া যাবে কি না, কিন্তু বাবা মায়ের খোঁজ তো নিতেই হবে।
আনিস বাড়ির কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পরে। না, তাদের বাড়ি তো পুড়িয়ে দেয় নি। তাদের বাড়ির পরে একটা এক বিঘার কাঠাল বাগান। বাগানের পরে একটা দরজাবন্ধ দোতালা কাঠের বাড়ি ছিল। আনিস ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছে এ বাড়িটা বন্ধ পড়ে থাকে। ঐ বাড়িটার পরেই হিন্দুদের বাড়িগুলো শুরু। এখন ওখান থেকে কুÐলী পাকানো কালো কালো ধোয়া উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। আর আকাশের গায়ে বিকেলের মতো লাল আভা। আনিস একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
ও বিড়ালের পদক্ষেপে বাড়ির ভিতর ঢোকে। বাড়িতে কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। না মানুষের, না তৈজসপত্রের। ও যেন নিজের বাড়ি নয় অন্য কোনো অচেনা ফাঁকা বাড়িতে ভুল করে ঢুকে পড়েছে। বাড়ির ভিতরে মৃত্যু শীতল নীরবতা। পুরো বাড়ি ছবির মতো স্থির হয়ে আছে। ঘরে বারান্দায় পাকঘরে কোথাও কেউ নেই। মা-বাবা, ভাইবোন কেউ না। অনেকক্ষণ পর ও গুঙিয়ে ওঠার আওয়াজ পায় গোয়াল ঘরের পিছনের খড়ের গাদার ভিতর থেকে। আনিসের দাদী। সকালে বেরিয়ে যাওয়ার আগে যে দাদীকে দেখে গেছে ও যেন সেই দাদী নয়, অন্য কেউ। চোখমুখ বসে গেছে। চোখের জলে কাপড়ের খুঁট ভিজে গেছে। ও কম্পিত স্বরে জিজ্ঞাসা করে, “দাদী, আম্মা, বইনেরা কই গেছে? কারা আইছিল?”
ওর দাদী এবার চাপাস্বরে নয়, হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, “যারা আইছিল তারা কেউ তাগোরে পায় নায়। কিন্তুর তারা আর বাইচ্যাও নাই। তোর মায়ে আর বাইচ্যা নাই। নাতি-পুতি ও বাইচ্যা নাই। তোর আব্বায়ও মইর‌্যা গ্যাছে গা আনিসসা।”
আনিস প্রথমে বুঝে উঠতে পারে না, বাড়ি থেকে কাউকে ধরে নিয়ে যায় নি, বাড়িতে আগুনও দেয় নি, তাহলে এই তিনঘণ্টার মধ্যে কি হল যে সকলে মরে গেল। আনিস ভাবল চারপাশের অগ্নিকাÐ দেখে দুঃখে দাদীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ও দাদীকে খড়ের গাদা থেকে তুলে এনে ঘরে বসায়। দাদীকে পানি খেতে দেয়। দাদী এখন কান্না ভুলে গেছে। আনিস আবার জিজ্ঞাসা করে, “সবাই কই গেছে দাদী?” দাদী এবার আর মুখে কথার উত্তর দিতে পারে না, শুধু আঙুল দিয়ে দেখায়। ওদের বাড়ির পূর্ব দিকে যে পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়িটা আছে সেই দিকে। এখনো সেখান থেকে কুÐলী পাকানো ধোয়া উড়ছে।

এবার আনিস এক লহমায় সব বুঝতে পারে। খোদা! ও ধপ করে নিচে বসে পড়ে মাটিই খামচি মেরে আঁকড়ে ধরে। পরিত্যক্ত বাড়িটার পিছনের বারান্দায় আনিসের ক্লাস ফাইভে পড়–য়া ভাই আরিফ আর নাইনে পড়–য়া বোন আলেয়া মিলে ট্রেঞ্জ খুড়তে শুরু করেছিল। ভেবেছিল এলাকার সবাই জানে ভাঙা পোড়ো বাড়ি ঐ হিন্দু বাড়িটা। ওটায় কি আর কেউ খোঁজখবর করবে?
আনিসের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। এলাকায় মিলিটারি ঢুকেছে শুনেই ওর বাড়ির লোকজন সব ঐ পরিত্যক্ত হিন্দু বাড়িটায় গিয়ে লুকিয়েছে। দাদী ছুটতে পারে না তাই কোনক্রমে নিজেকে হেঁচড়ে নিয়ে খড়ের গাদায় গিয়ে মাথা ডুবিয়েছে। হায় আল্লাহ! আনিস উদভ্রান্ত চোখে পাগলের মতো দৌড়ে যাবার চেষ্টা করলেই দাদীর সম্বিত ফিরে আসে। সে তার হাত সাড়াশীর মতো চেপে ধরে আনিসের কব্জিতে। ধীর গলায় বলে, “যাইস না আনিস, আমি টের পাইছি, বেজম্মাগুলায় আগুন লাগানোর পর যহন চইলা গেল, আমি নাড়ার মদ্য দিয়া মাথা জাগাইয়া দেখছি, লাল লাল আগুন লকলক করতাছে পুবধারে। এট্টু পরেই হগলডি চেঁচাইতে শুরু করল,..” আর বলত পারে না দাদী কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আনিস কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। হঠাৎ ওর মনে হয় যদি কেউ বেরুবার চেষ্টা করে থাকে? যদি সে বেঁচে থাকে? যদি তাকে বাঁচানো যায়!
আনিস এক ঝটকায় দাদীর হাত ছাড়িয়ে পুবমুখো দৌড় দেয়। পিছন দাদী চিৎকার করে, ‘যাইছ না আনিসসা আমারে একলারে রাইখ্যা যাইস না।”
আনিস গিয়ে দেখে পুরো বাড়ি ভষ্মীভূত হয়ে গেছে। চারপাশের বাতাসে কাঠপোড়া গন্ধ। হয়তো কাঠের বাড়ি বলেই এতো দ্রুত পুড়ে গেছে। শুধু কালো কালো ছাইয়ের স্তূপের ভিতর থেকে ভারী কাঠগুলোর লাল লাল অঙ্গার এখানো উঁকি মারছে। ও দৌড়ে বাড়ির পিছন দিকে যায়। কেমন চামড়া পোড়া গন্ধ আসছে? কোথা থেকে আসছে? ও বাড়ির পিছনের দিকে আগাছা ঝোপের দিকে এগোয়। একটা বেত ঝোপের পাশে প্রায় সবটুকু পুড়ে যাওয়া একটা মানব শিশুর অবয়ব। ওর চোখ যায় প্যান্টের দিকে। একটা ইংলিশ প্যান্ট। প্যান্টটা দেখে ও চিনতে পারে। আরিফ।
“আরিফ!”
আনিস ভাঙা গলায় চিৎকার করে ওঠে। ওর চিৎকার শুনে হঠাৎ তিন-চারটা কাক কা কা শব্দে ডেকে উড়ে চলে যায়। আনিস মৃতদেহটার পাশে বসে থাকে। কী করবে এখন ও? কী করবে? কী করা উচিত?
প্রায় আধাঘণ্টা পরে পিঠে হাতের স্পর্শে চমকে ওঠে। দাদী। কান্না শেষ হয়ে তার গলা থেকে ফ্যাসফেসে আওয়াজ বের হচ্ছে। “ওঠ আনিসসা। ওঠ। ওরে কাফন দেওন লাগবে। আর হগলডিরে তো আল্লায় আগুনের কাফন দিয়া কব্বর দিছে।”
আনিস অপ্রকৃতিস্থের মতো টলমল পায়ে হেঁটে এসে বাড়ি ঢোকে। ট্রাঙ্ক খুলে বের করে দাদীর ধোয়া কাপড়। কাপড়ে জড়িয়ে আরিফের লাশ বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়ির পশ্চিম দিকে দাদার কবরের পাশে একটা ছোটো কবর খোঁড়ে।

গোসল সেরে ঘরে ঢুকে দেখে দাদী একটা বড় পুটলী বানিয়েছে। বোকার মতো মুখ করে বলে, “ট্রাঙ্ক সুটকেস লইলাম না আনিসসা।” একটু হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বলে, “তোর ওজন টানতে কষ্ট হইব।” আনিস বাহ্যজ্ঞানহীনের মতো চারপাশে তাকায়। যত দ্রæত সম্ভব এই বাড়িটা থেকে ওকে বেরোতে হবে। খালি বাড়িটা ওকে দাঁত নখ থাবা বিস্তার করে যেন ওকে গিলতে আসছে।
আলেয়ার স্কুল ব্যাগে ওষুধপত্র আর আব্বার বাক্সের তালা ভেঙ্গে টাকা পয়সা নেয়। কোথায় যেতে হবে, কীভাবে যাবে কিছুই জানে না ও। পথে বেরিয়ে দেখতে হবে কোথায় যাওয়া যায়। ঘরের তালা-চাবি রাখা ছিল চৌকাঠের পাশের তাকে। ঘরে তালা দিয়ে বাইরে বের হয়ে মনে পরে যদি ওরা আবার আসে? এই বাড়িটাও যদি পুড়িয়ে ফেলে? দ্রæত তালা খোলে আনিস। দাদী আতঙ্কিত। আনিস কি যাবার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল! মায়ের ট্রাঙ্ক খোলে আনিস। ট্রাঙ্ক হাতড়ে কিছু গহনা পায়। আর পায় খামে ভর্তি এক বাÐিল ছবি। ছবিগুলো বুকে নিয়ে আবার হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। দাদী পোটলাগুলো বাইরে রেখে আবার ঘরে ঢোকে। “আনিসসা, দেরি করিস না। তাড়াতাড়ি কর।” দাদীর কথায় সম্বিত ফেরে আনিসের। মায়ের চুল আঁচড়ানোর আয়নাটায় ওর ছায়া পড়ছে। ও নিজেকেই চিনতে পারে না। এই কয়েকঘণ্টায় যেন ওর দশ বছর বয়স বেড়ে গেছে। আনিস ছবিগুলোও ওষুধের ব্যাগের মধ্যে ভরে। এরপর পোটলা মাথায় নিয়ে দাদীর হাত ধরে পথে নামে।

মানুষের কাফেলার সঙ্গে ওরা হাঁটতে হাঁটতে একসময় ইন্ডিয়া বর্ডার পার হয়ে একটা আশ্রয় কেন্দ্রে পৌঁছায়। আশ্রয়কেন্দ্রে যেন মানুষের মেলা লেগে গেছে। স্কুলঘরের মধ্যে তৈরি আশ্রয়কেন্দ্রে ওরা আশ্রয় পায়। ওখানের কমকর্তাকে ওদের বাড়ির সকলের অপঘাতে মৃত্যুর কথা জানায়। তারা সহানুভূতি দেখিয়ে বৃদ্ধা দাদীকে একটা খাটের ব্যবস্থা করে দেয় ক্যাম্পে। দাদীর খাটের ঠিক পাশেই মেঝেতে জায়গা হয় আনিসের। দাদী এখন অনেকটা সুস্থির কিন্তু তার চোখের কোন শুকায় না। শরীফা বানু বোধহয় অন্ধই হয়ে যাবে লবন পানিতে।
ক্যাম্পে পৌঁছানোর সাতদিন পরে ঘুম থেকে জেগে শরীফা বানু দেখে তার খাটের নিচের যে জায়গাটায় আনিস ঘুমিয়ে থাকত সেখানে আনিস নেই। অন্য আরেকটা মেয়েমানুষ ঘুমিয়ে আছে। শরীফা বানু সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে। আনিস চলে গেছে। তাকে এই মস্তবড় পৃথিবীতে একা ফেলে আনিসও চলে গেছে। সে মাথার কাছে দেখে কাপড়ের পুটলি ঠিকঠাকই আছে। পাশে আলেয়ার স্কুলব্যাগ চাপা দেওয়া একটা কাগজ। ট্রেনিংয়ে যাবার আগে একটা চিঠি রেখে গেছে আনিস।
শরীফা বানু শূন্য চোখে স্কুল ঘরের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারও উপরে ছাদের টিনের নিচে কাঠের বাতার মধ্যে ঘাস পাতা দিয়ে বাসা বেঁধেছে ছোট্ট চড়ুই পাখি। দুটো পাখি উড়ে উড়ে একবার বাইরে যাচ্ছে আর একবার খড়কুটো নিয়ে আসছে বাসায়। বোধহয় ডিম দেবে মা চড়ুই।

=====================