You are currently viewing অলিভিয়া’র ইচ্ছে-পূরণ > জাকিয়া শিমু

অলিভিয়া’র ইচ্ছে-পূরণ > জাকিয়া শিমু

অলিভিয়া’র ইচ্ছে-পূরণ

জাকিয়া শিমু

লুকেসের প্রশ্নটা শুনে যারপরানই বিব্রত হই। আজকের দিনের শুরুটা ছিল চমৎকার। সাধারণত আবহাওয়ার সাথে আমার মনের ভাবসাব ওঠানামা করে। সকালবেলার আকাশ ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার, নীলাচলে ঢাকা। হাওয়ায় ফাগুনের আমেজ। গাছের কচিপাতায় সূর্যের নরম আলো চিকচিক করছিল। সবুজ পাতার উপর আলোর নাচন দেখে প্রজাপতি ভেবে ভ্রম করেছিলাম। এমন একটি অপরূপ দিনে লুকেসের প্রশ্নের উত্তর করে মনটাকে বিষন্ন করা ঠিক হবে কিনা, ভাবছিলাম।

একটু বিরতি নিতে সন্মুখে রাখা শীতলপানির বোতলের ঢাকনা খুলতে অযথা মনোযোগ দিই। বাঁদিকের জানালা দিয়ে আকাশ দেখবার সুব্যবস্থাটা এতক্ষণ চোখে পড়েনি। একখণ্ড দলছুট লঘুমেঘ, স্কুলঘরের ছাদটা ছুঁয়ে ভুদৌড়ে হাওয়া হয়ে গেল। আমি মুগ্ধ হয়ে সেদিকে দৃষ্টি রাখার ভান করি, প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার কানে এসে লাগে।

“মেক এ উইশ’ ফাউন্ডেশন-এর সাথে বছর দশ হয় কাজ করছি। এখানে গুরুতর অসুস্থ বাচ্চাদের মনের ইচ্ছে পূরণ করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্কুলে আমাদের সংস্থাকে পরিচয় করিয়ে দিতে- বাচ্চাদের সাথে আলোচনা এবং অভিজ্ঞতার বিনিময়,আমাদের কাজের একটা অংশ। বাচ্চারা, আমাদের সংস্থার কাজ বিষয়ে জানতে আগ্রহী হয়ে প্রশ্ন করে, আমরা সেবিষয়ে তাদের বুঝিয়ে বলি। বাচ্চাদের প্রশ্নের ধরন সাধারণত তাদের মতো আনাড়ি এবং কৌতুক উদ্দীপক হয়। যে কোন সিরিয়াস বিষয়ে এরা হাস্যরস খুঁজতে আগ্রহী হয়। বেশিরভাগ বাচ্চা প্রশ্ন করতে হাত উঁচিয়ে বসে আছে। বেশিরভাগ একই গোছের- ধারার প্রশ্ন! যেমনঃ

“ তোমার কাজের মজার কোন অভিজ্ঞতা বল”

আমাদের কাজে্র ধরনে বলতে গেলে মজার অভিজ্ঞতা অর্জনের কোনো জো নেই। যেসব বাচ্চা নিয়ে আমাদের কাজ, তারা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবিরত লড়াই করে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে তাদের পাশে দাঁড়ালে ভিনজগতের ভাবনা এসে জাগতিক স্বপ্নদের উড়িয়ে নিয়ে যায়। তারপরও একটা ঘটনা বছরদুই আগের- আমার কাছে একটু অন্যরকম মনে হয়েছে…

ব্লেক, ছ’ বছর বয়েসের উচ্ছল, প্রাণবন্ত বালক। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। স্পাইনাল কর্ড ক্যান্সার’  নিঃশব্দে ঘুণের মতো করে খেয়ে দেহটাকে ঝিঙেরখোলের ন্যায় ঝাঝরা করে দিয়েছে। কর্কটরোগটা তার চপলতার আড়ালে ঢাকা পরে ছিল। টের পাওয়া গেল তাও শেষবেলায়। ডা.কোন আশা দেখাতে পারলেন না। আমাদের ডাক পড়ল।

এ বয়সী বাচ্চাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আজগুবিসব ইচ্ছে থাকে। তার ইচ্ছে- ভবিষ্যত জীবনে সে পিকল’কোম্পানিতে কাজ করবে। পিকল’ তার পছন্দের খাবার। আমরা তার ইচ্ছে পূরণে পিকল’ কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করলাম। কোম্পানি সাদরে তাতে সম্মতি জানাল। কোম্পানির ড্রেস কোড’ মেনে তার জন্য বিশেষ পোশাক আশাকের ব্যবস্থা করা হল। এবং একদিন ভোরে আমরা তাকে কোম্পানির প্রতিদিনের নিদিষ্ট সময়ে ফ্যাক্টরিতে কাজে নামিয়ে দিলাম। শিফট’ শেষে তার মুখের হাসিতে আমাদেরও মন ভরে উঠল। আমি ব্লেক এর কাজের ড্রেস পরা ফটোগ্রাফ বাচ্চাদের দেখালাম।

ক্লাশসুদ্ধ হাসির রোল পড়ে যায়। নিজেরা নিজেদের মধ্যে তাদের সে বয়সের ইচ্ছেগুলো নিয়ে আলাপের ডালাপালা খোলে বসে। কিন্তু লুকেসকে নির্বিকার দেখা যায়। সে বহুক্ষণ হাত উঁচিয়ে আমার মনোযোগ নিতে অপেক্ষা করছে। আমাদের আলাপে তার মনোযোগ নেই। আমি কথার মধ্যিখানে ইশারায় তাকে হাত নামাতে বললে, সে বেঞ্চের ওপর হাতের কুনই ঠেকিয়ে অর্ধ-হাত উঁচিয়ে চেহারা আগের মতো মলিন করে বসে রইল। লুকেস স্বভাবে ধীরস্থির,চেহারায় এ বয়সে গাম্ভীর্য এসে ভর করছে।

লুকেসের প্রশ্নে শুধু আমি নই এতক্ষণ খিলখিলিয়ে উঠা পুরোক্লাশ একনিমিশে পিনপতন নিরবতায় চলে যায়। প্রশ্নটা তার ব্যক্তিত্বের মতো গম্ভীর গলায় বেরিয়ে আসে এবং  আগের মতো মাথা নিচের দিকে রেখে চুপ হয়ে বসে থাকে। লুকেসের পাঁশেবসা বন্ধু, তার কাছ ঘেঁষে বসে, পিঠে আশ্বাসের হাত রাখে। পরক্ষণে সামান্য গুনগুন আওয়াজ ওঠে যদিও বন্ধুদের মাঝে। আমি লুকেসের ব্যক্তিগত বিষয় জানি না। কাছের বন্ধুরা হয়তো জানে, তাদের চোখে-মুখে বন্ধুর প্রতি সহানুভূতির ঝিলিক ফুটে ওঠে। প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাকে আরও কিছুক্ষণ সময় নিতে হয়, নিজের মনকে ধরে রাখতে।

“ যে মা ইচ্ছে করে হারিয়ে যায়, তাকে তোমরা খুঁজে দিতে পারো”?

হৃদয়ের গভীরে খোঁচা-দেওয়া প্রশ্ন। আকাশের কালোঘন মেঘখণ্ড ততক্ষণে সরে চলে গেছে বহুদূরে। তারপরও পরিষ্কার আকাশটাকে আমার কাছে মনে হয় যেন বিষণ্ণ কুয়াশার আবরণে ঢেকে রয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য নিমিষে ঢাকা পড়ে যায়। আমি আমার মনেরপাড়ে জমে থাকা জমাটবাঁধা ভাবনা হতে বেরিয়ে আসি, উন্মুখ মুখগুলোর কাছে।

বছর চার আগেকার ঘটনা। ফিনিক্স চিলডেন হসপিটাল’ থেকে আমাদের কাছে একটা ফোন আসে। বিষয় অতিশয় জরুরি বিধায় আমি পরদিন ভোরবেলায় রওনা হয়ে যাই। হসপিটালে পৌঁছলে জানতে পারি- অলিভিয়া নিজ বাড়িতে আছে। আমি তার সরাসরি ডা. কাছ থেকে অবস্থার পুরোদস্তুর জানতে পারি। অলভিয়া Acute myeloid leukemia বহন করছে এবং যা রক্ত-ক্যান্সারের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ধাঁচের এবং বলাবাহুল্য ডা.কোন তেমন কোন আশা দেখাতে পারছেন না।

আমার হাতে সময় অল্প। আমি সঙ্গে সঙ্গে অ্যারিজোনার ছোট্ট শহর ওইনকলম্যান- এ অলিভিয়ার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাই। অ্যারিজোনা পাহাড়ের দেশ। মস্তবড় এক পাহাড়ের গা ঘেঁষা ছোট্ট শহর, ওইনকলম্যান। শহরের সৌন্দর্য চোখে বড় আরাম দেয়। শহরের মাঝ বরাবর পাহাড়ি হ্রদ, শহরটার বুক চিরে নিঃশব্দে বয়ে চলেছে। দুপাশে পাহাড়ি গাছগাছলার নানান রঙের ফুলে ছেয়ে আছে। শীতকালে অবশ্য ভিন্ন চিত্র। সাদা বরফকুচিতে ঢেকে থাকা শহরকে আকাশের পরে ভেসে বেড়ানো বিকট মেঘখণ্ড বলে ভ্রম হয়।

গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে আমার গাড়ি অলিভিয়ার চমৎকার সুন্দর দু’তলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। পাহাড়ের গায়ে ঠেস দিয়ে বাড়িটি দাঁড়িয়ে। বাড়ির প্রবশদ্বারের দুপাশে দুটি জ্যাকারান্ডা গাছ। পার্পল ফুলে ঢেকে আছে। আমি গাছতলায় দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখি।

পাহাড়িএলাকা প্রতি ঋতুতে নতুনভাবে সাঁজে। বসন্তে তার  রূপেরভাঁজ পুরোপুরি খুলে যায়। পাহাড়িফুলের সৌন্দর্যের তুলনা মেলা ভার। তবে অলিভিরায় বাড়ি প্রবেশের পর আমার বুকটা কেমন মুচড়ে উঠে, মন-খারাপের নিরবতায় ঢেকে আছে চমৎকার এ বাড়িটি। আমি ফোনে যোগাযোগ করে আসি। লম্বাক্ষণ গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। একটা সময় পর ষাটোর্ধ সুঠামদেহি এক ভদ্রলোক আমাকে অন্দরঘরে নিয়ে বসান। ঘরে মার্জিত সৌখিনতার অভাব নেই। ইনি অলিভিয়ার বাবা। তার কিছুক্ষণ পর মা, অনেকটা নিঃশব্দে আমাদের পাশে এসে বসেন।

অলিভিয়ার বয়স বারো। দু’বছর বয়সে এরা তাকে দত্তক নেন। নিজেদের বাচ্চাকাচ্চা নেই। গত দশ বছর এরা অলিভিয়াকে অবলম্বন করে বেঁচে আছেন। অলিভিয়া সাত বছর বয়সে জানতে পারে এরা তার আসল বাবা- মা নন। কিন্তু এমন চরম সত্য জানার পরও তার মধ্যে কোনরকম পরিবর্তন দেখা যায়না। বরং জানার পর থেকে সে আরও গভীরভাবে তাদের কাছে ঘেঁষতে শুরু করে। ভদ্রলোক এটুকু বলার পর আর এগোতে পারে না। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। ভদ্রমহিলার দু’চোখ বেঁয়ে শ্রাবন-বর্ষণ, ঝরঝর ধারায় বইছে যেন। হেঁচকিওঠা কান্নার ফাঁকে ফাঁকে অলিভিয়ার জীবনের বাকিটুকু বললেন।। অলিভিয়ার রোগটা ধরা পড়তে ভদ্রলোকের একটা কার্ডিয়াক এটার্ক হয়। বসারঘরের জানালার ধারে বেশ বড়সড় একটা ম্যাগ্নোলিয়া, রাতের আকাশে বিছিয়ে থাকা নক্ষত্রের মতো শতেশতে ধূসর শাদা ফুল ঝুলছে। চোখের ছলছল জল লুকাতে আমি সেদিকে চেয়ে থাকি।

সেসময়ে অলিভিয়া ওপরতলা হতে সিঁড়ি বেঁয়ে ধীরলয়ে নেমে আসে। মিশরীয় মেয়েদের মতো গায়ের গড়ন। শঙ্খশুভ্র গায়ের রং, নাক-চোখ কাটাকাটা। আকাশরঙা একটা গাউন পরে ও-যখন নিচে নেমে আসছিল, আমি চোখ সরাতে পারছিলাম না। অদৃশ্যকল্পনায় আঁকা হুরপরীর মতো ফুটফুটে মেয়েটা। আমার নিকটে এসে আপনজনের মতো করে আমাকে জড়িয়ে ধরলে, বুকটা আমার ছ্যাঁত করে উঠল। বুকের ভেতর সহস্র তুরপুনের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হলাম। অদৃষ্ট সৃষ্টিকর্তার ওপর বড্ড অভিমান হল। এমন একটা পরীজীবন কেনো এত অল্পসময়ে কেড়ে নেওয়া হবে !

অলিভিয়া, নিজের গোপন ইচ্ছেটা’ এখনো কাউকে বলেনি। সে একান্তে আমার সাথে কথা বলতে চায়।  হাসপাতাল থেকে আমাকে জানানো হয়েছে।

কঠিন কথা শুনতে হয় সহজ পরিবেশে। তাছাড়া আমি বেশ আবেগি মানুষ। তার সাথে সাক্ষাতের পরথেকে নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। এমন একটা বাচ্চামেয়ে এতঅল্প সময়ে চলে যাবে পৃথিবী ছেড়ে- এটা মেনে নেওয়া বড় কঠিন বিষয়।

আমি অলিভিয়াকে নিয়ে ওদের বাড়ির অদূরে ‘কপার করিডর পার্কে’- এ রওনা হলাম। সে গাড়িতে বসে হাত- চোখ নাচিয়ে আলাপ করে যায়। তার সাথে আমার সবেমাত্র দেখা। মনেহয় যেন কতোকালের পরিচিত আমরা। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর গল্প শুনি। নিজের রোগ কিংবা শেষ ইচ্ছে’ বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হল এবিষয়টা সে ভুলে থাকতে চায়। গতবছর সপরিবারে হাওয়া-ই ঘুরে এসেছে সেসব দিনের কথায় ষোলআনা মনোযোগ। বাবাকে মায়ের চেয়ে একটু বেশিই ভালোবাসে, তার গল্পে সহজেই ধরা পড়ে। বাবার পক্ষে মেয়েদের টান, সহজাত।

পাহাড়ের চূড়া থেকে পাথরের পিঠ বেঁয়ে পাহাড়িনদী নেমে এসেছে সাপের দেহের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে। নদীপাড় ঘেঁষে পাথুরেরাস্তায় আমরা হেঁটে চলে আসি ফোয়ারার কাছাকাছি। গ্রীষ্মের বিকেল। সন্ধ্যা নামতে এখনও ঢের বাকি। অলিভিয়াকে কথাটা আমার পাড়তে হবে। সন্ধ্যার ফ্লাইটে ফিরে যাওয়ার কথা। আমার ভেতর উথালপাথাল টের পাই। বুকের পাঁজরের ঢকঢকানি আওয়াজটা কমছে না। অলিভিয়ার দিকে সরাসরি তাকাতে সাহস পাই না। ওর পাশাপাশি বহুদূর হেঁটে যাই। অ্যারিজোনা রাজ্যের পাহাড়গুলো পাথরের মনে হয়। মাটি, হাজার হাজার বছরে পাথর হয়ে থরেথরে একত্রে পাহাড়ে রূপ নিয়েছে। পাহাড়ের লাল টকটকে পাথর শেষবিকেলের আলোতে আগুনখণ্ডের মতো জ্বলজ্বল করছে। নদীর পাড়ে পাশাপাশি দু’টি পাথরখণ্ডের ওপর আমরা মুখোমুখি বসি।

অলিভিয়া, জন্মদাত্রী মায়ের সাথে সাক্ষাত করতে চায়। কিন্তু তার মা-কে খুঁজে বের করা আমাদের জন্যে বেশ কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়।

নথিপত্র ঘেঁটে মায়ের নাম জানা গেলেও ঠিকানা পাওয়া যায় না। দত্তক নেওয়া হয়েছে, দাদি কিংবা নানির মাধ্যমে। নানি/দাদির ঠিকানায় গেলে সেখানে এমন কারো হদিস মেলে না। সেই ঠিকানায় একসময় অবশ্য বসতবাড়ি ছিল কিন্তু এখন সেখানে দোকানপাট হয়েছে। বসতবাড়ির লোকের খোঁজে সিটি-তে এবিষয়ে দায়িত্বরত ডিপার্টমেন্টে যোগাযোগ করি। তাদের কাছ থেকে অসম্পূর্ণ তথ্য নিয়ে ছুটে যাই। কিন্তু সেখানেও কোন কূলকিনারা হয় না। একরাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে,ভাসাভাসা তথ্যাদি নিয়ে যোগাযোগ চলতে থাকে। একসময় জানা যায়, অলিভিয়ার মা বেশকবছর আগে এদেশ ছেড়ে দখিন আমেরিকার দেশ, পেরু বাস করছেন। পেরু’ ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমেরিকার মতো সহজ নয়। অফিস থেকে আমাকে সশরীরে পেরু যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

ওদিকে করোনা’ জীবাণু, চায়না থেকে নিউইয়র্ক হয়ে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে ঢুকতে শুরু করেছে। মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যমের তোরজোরে করোনা’র ভয়ে মানুষের গুহায় পালানোর উপক্রম হয়েছে। ঘরের বাহির হতে বীরবলের আত্নাও যেন ভয়ে কেঁপে ওঠে। তখনও মড়ার মিছিল শুরু হয়নি। কিন্তু এমন ভয় ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল মনে হত ঘর হতে দু’পা পেরুলে সাক্ষাত মৃত্যু। সমস্ত অফিস- আদালত গণহারে বন্ধ হয়ে গেল। শুধু হাসপাতাল এবং সামান্য কিছু মুদিদোকান নিষেধের আওতামুক্ত থেকেছে। এমন একটা দুঃসময়ে নিজের জীবন যখন নিদানের মধ্যে পড়ে আছে, অলিভিয়ার বিষয়টা মনের মধ্যে গেঁথে থাকলেও কিছু করার উপায় ছিল না। বাসা থেকে অবশ্য চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাই।

এরমধ্যে অলিভিয়া হাসপাতালে ভর্তি হয়। আমি নিয়মিত খোঁজখবর করি। অলিভিয়ার সাথে মাঝেমধ্যে  ভিডিও কলে কথাও হয়। অলিভিয়ার সাথে কথা বলে আমি সারাক্ষণ অয়োয়াস্ত্রিতে ভুগি। মৃত্যুদুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকা একজন অবোধ শিশু হারিয়ে যাওয়া মায়ের অপেক্ষার গল্প কতোটা কষ্টের, একজন মা হয়ে আমি সে-ভার নিতে পারছিলাম না। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম। মাকে পৃথিবীর যেকোন প্রান্ত থেকে তন্নতন্ন করে খোঁজে এনে দিব। কিন্তু পরিস্রিতি সম্পূর্ণ প্রতিকূলে চলে যায়।

অল্পকিছুদিনের ভেতর পৃথিবীর বিশেষ করে আমেরিকার চেহারা পুরোটাই বদলে যায়। তাবৎলোকের নজর থাকে পৃথিবীর রাজধানী খ্যাত নিউইয়র্কের দিকে। প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে, হাজারে হাজারে লোক মরছে। তাজ্জব ব্যাপার। নিউইয়র্ক শহরে দিনেদুপুরে গভীর রাতের নিস্তব্দতা নেমে আসে। রাস্তাঘাট লোকশূন্য। সাক্ষাত মৃত্যুপুরি! এ অবস্থা দর্শনে অন্যান্য রাজ্যগুলিও বিশেষ সতর্ক হয়ে ওঠে। এবং বেশকিছু রাজ্যে অচিরেই নিউইয়র্কের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে।

অলিভিয়ার রাজ্যও পিছিয়ে নেই। হাসপাতাল করোনা রোগীতে ভরে যায়। অলিভিয়ার মতো রোগীদের জন্যে বিষয়টা আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কোন উপায়ে এজীবাণু তাদের শরীরে ঢুকে পড়লে, শেষরক্ষা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।

সুখ কিংবা দুঃখ কখনো একা চলে না,সহোদররা গলা জড়াজড়ি করে আসে। অলিভিয়ার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে ঠিক সেসময় তার সরাসরি ডা. করোনায় পৃথিবীছাড়া হলেন। ক্যান্সার হাসপাতালের বেশিরভাগ ডা. দেহে করোনা’ জীবাণু পাওয়া যায়। কারো কারো অবস্থা হলো ভয়াবহ। অনেক জন মারা গেলেন। দু’চারজন ডা. নার্স নিয়ে চলছে পুরো হাসপাতাল। অন্যান্য হাসপাতালের একই দশা। প্রতিদিন বেশ কজন করে ডা. নার্সের নাম মৃত্যুতালিকায় চলে যায় । হাসপাতালগুলো বন্ধ হবার যোগার। অলিভিয়ার বাবার দেহে করোনা জীবাণু, তিনি হার্টের রোগী। তাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। হসপিটালে এ অচিনরোগের কোন ওসুধপত্র নেই। তারপরও মানুষ সেখানে ছুটছে। বুকভরে শ্বাস নেওয়ায় আশায়,তীব্র শ্বাসকষ্ট অসহনীয়। ক্রমেই সে নিঃশ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মজুদ অক্সিজেন সিলিন্ডার শেষের দিকে। পৃথিবীজুড়ে হাহাকার। সর্বত্র মৃত্যু। অক্সিজের উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর একই দশা।

অলিভিয়ার ঘরে একটা অ্যানটিক সিলিং ফ্যান আছে। লম্বা ডাণ্ডার অগ্রভাগে পাঁচটা পাংখা। আমেরিকাতে পুরনো জিনিসের চড়ামাত্রায় কদর করা হয়। এসব আদ্যিকালের জিনিসপত্র নিয়ে মেলা বসে। মানুষ কপালে চোখ তুলে আগেকার মানুষের ব্যবহার্য সেসব দেখে সেকালের ধারণা নেয়। বেশিরভাগ জিনিস বংশপরম্পরায় যত্ন করে রাখে এবং এসব মেলায় প্রদর্শন করে মানুষকে দেখার সুযোগ করে দেয়। কেউ কেউ অবশ্য টাকাকড়ির ঘাটতিতে নিলামে তুলে বিক্রিও করে দেয়। সাধারণ জিনিস চড়া দামে বিক্রি হয়।

অলিভিয়া’র মাত্র কর্কট রোগ ধরা পড়েছে। বাবা-মেয়ে সবসময় এসব মেলাতে যায়। অলিভিয়া’র মনকে শান্ত করতে বাবা সেবারও তাকে মেলায় নিয়ে যায়। অলিভিয়া তখন এ ফ্যানটা নিবে বলে বাবার কাছে আবদার করে। সেন্ট্রাল এ সি ঘরে ফ্যানের প্রয়োজন নেই। তারপরও বাবা তাতে আপত্তি করেন না। অলিভিয়ার ঘরের এককোণে সে ফ্যান লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়।

অলিভিয়া চমৎকার ক্র্যাফটের কাজ জানে। সে কাগজ দিয়ে লাল টকটকে একটা সূর্যমুখি বানিয়ে ফ্যানের এক পাংখায় সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। পরের বছর আরেকটা ফুল। অলিভিয়া’ জেনেছে পৃথিবী নামক গ্রহটিতে তার বড়জোর পাঁচবছর থাকার সুযোগ রয়েছে। তার খুব ইচ্ছে ফ্যানের পাঁচটি পাখায় পাঁচটি লাল টকটকে সূর্যমুখি ঝুলবে এবং তারপর সে এগ্রহ ছেড়ে চলে যাবে। বাবা একদিন ভুল করে তার ঘরে ঢুকে ফোনটা ছেড়ে দিবে, সঙ্গে সঙ্গে লালটুকটুকে সূর্যমুখি ঘরময় ছুটে বেড়াবে। সেদৃশ্যটা তার চোখে ভেসে ওঠে। বাবার সেদিনের অনুভূতিটা সে চোখ বন্ধ করে দেখতে পায়। তার চোখ বেঁয়ে দরদরিয়ে জল পড়ে।

অলিভিয়ার বাবার মৃত্যুসংবাদ তাকে দেওয়া হয় না। মা একই কারণে হসপিটালে ভর্তি হয়েছেন, সেটাও নয়। অবশ্য সে বুদ্ধিমতী মেয়ে। কখনও কোন অবাঞ্ছিত-বাড়তি প্রশ্ন করে না। বাবা-মা সবসময় হাসপাতালে সকাল-বিকাল তাকে দেখতে আসত। তাদের কাছ থেকে একটা ফোনবার্তাও আসে না। তার প্রকৃত বিষয় বুঝতে বাকি থাকে না।

আমি ওর সর্বশেষ অবস্থা বিষয়ে ফোনে জানতে পারি। তার সাথে কথা বলতে চাই। কিন্তু তাকে শেষ যন্ত্রণা লাঘবে কড়া ওষুধে ঘুম পারিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছে পূরণ হবার নয়।

আকাশপথ থমকে গেছে। বহুকষ্টে একটা টিকিট হাতে নিয়ে আমি পেরুর উদ্দেশ রওনা হয়ে যাই।

অলিভিয়ার হাতটা ওর মা শক্ত করে ধরে আছে। ওর চোখ বন্ধ। দু’চোখের পাতা বাঁশপাতার মতো থরথরিয়ে কাঁপছে। সে কি তার মায়ের স্পর্শ টের পাচ্ছে ! পায়ের কাছে রাখা চৌকোণা যন্ত্র-মস্তিস্ক বলে দেয়, তার অন্তিম ব্রেনওয়েভ- চলছে। কী দেখছে অলিভিয়া ! অতীত নাকি ভবিষ্যৎ! বড় জানতে ইচ্ছে করছে।

=====================