You are currently viewing অলস ভাবনায় ডুকে থাকা এক সকালের কথা > মেহনাজ মুস্তারিন 

অলস ভাবনায় ডুকে থাকা এক সকালের কথা > মেহনাজ মুস্তারিন 

 

অলস ভাবনায় ডুকে থাকা এক সকালের কথা

মেহনাজ মুস্তারিন 

 

জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি। পেছনের দীর্ঘপথের দিকে তাকিয়ে মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমি কে? কে আমি?

এই যে চারপাশে এতো আলো-বাতাস, সূর্যের স্নিগ্ধতা, কখনো আবার প্রখরতা, দিনশেষে অস্ত যাবার ব্যথা সবই চিরন্তন, তবুও দেখি সেখানেও অপেক্ষা আছে, আছে জেগে উঠবার আকাঙ্খা নতুন দিনে। আবারও সকাল হবে, আর নতুন প্রভাতে আমাদের সকলের মুখজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে গোলাপি আভা, বড্ড অন্যরকম দেখাবে। নতুন দিনের কোলাহলে প্রকৃতি তার নতুন রূপ নেবে, সূর্য তার মিষ্টি আলো ছড়িয়ে দেবে এপাশ ওপাশ সবখানে। আবার যখন পূর্ণিমা তিথি শুরু হবে বর্ষার কোনো এক ঝরঝরে দিনে, তখন জ্যোৎস্নার আলো দিকবিদিক আলোকিত করবে, আর তা ছড়িয়ে পড়বে মনের অলিগলি, সবখানে। আমাদের দেহপল্লব ব্যাকুল হবে, তখন ফুটফুটে রাত আমাদের জন্য নিয়ে আসবে মায়া, আমরা আবদ্ধ হবো নতুন বন্ধনে। প্রেম জাগবে হৃদয়ে, দেহ মনে ভর করবে কোলাহল, তখন মনে হবে কিছু একটা খুঁজছি। হ্যাঁ, কিছু একটা! সেই কিছু একটার শূন্যতা তখন আকাশ পানে তাকিয়ে থাকবে, উজ্জ্বল সেই আলো ছোঁবে বলে। হাতের মুঠোয় চুপটি করে থাকা অপেক্ষাগুলো তখন বাঁধা অতিক্রমের নেশায় ব্যাকুল হবে, না পাবার ব্যথাগুলো তখন বেশ খানিকটা সজাগ হয়ে অপেক্ষা করতে থাকবে শুভক্ষণের। আর বেদনাগুলো ফুটফুটে রাতে বড্ড বেশি একা হয়ে পড়বে, হারিয়ে যাবে অতলে।

ইদানিং চারপাশ কেমন যেন অচেনা লাগে। কেমন যেন ফাঁকা! সেই অচেনা অনুভব, এই ফাঁকা-ফাঁকা অনুভবের যে ব্যথা, তাকে ভুলে যেতে মাঝেমধ্যে আশ্রয় খুঁজি সবুজের কাছে, আমি যে বাঁচতে চাই আবারও, বাঁচতে চাই বারবার। ইচ্ছেগুলোর ঠিকানা খুঁজতে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি পৌঁছে যেতে চাই। অদ্ভুত এই মানব জনম; মনের কষ্ট,ব্যথা এবং অস্থিরতাগুলো চমৎকার ভাবে কমে আসে সবুজের চোখে চোখ রাখলে, ওদের সাথে মনের কথা বললে। তাহলে কেন বলি যে, ওরা কথা বলতে পারে না! ব্যথা বোঝে না! ওরা যা বোঝে মানুষ তা বোঝে না বলেই আমরা ওদের কাছে আশ্রয় নিতে ছুটে যাই, স্বস্তির খোঁজ করি। গাছ-লতা-পাতা অথবা ঘাসের জগত সেটা অনুভব করে বলেই বারবার নতুন ভাবে নবরূপে জন্ম নেয় সাজিয়ে তোলে নিজেকে।  পাতা ঝরে, আবার নতুন-নতুন কচি পাতার আহ্বানে  নিজের শরীর মুড়িয়ে নেয়, মেলে দেয় উৎসর্গ করে প্রেমে।

মনের এই দোদনদোলায় দুলতে দুলতে আমার ইচ্ছে করে কিছু সময় নদীর কিনারে গিয়ে বসি, তারপর বসে বসে নদীর বয়ে চলা প্রত্যক্ষ করি। আমাদের জীবনটা তো নদীর মতোই, কোথাও নদীর পানি বহমান তো কোথাও আবার শুকিয়ে এক হাঁটু চর পড়ে গেছে, সেখানে নদীর কূল নাই, নাই কোন প্রেমের স্পন্দন। বৈঠা হাতে মাঝির সুরেলা গান কত পুরনো দিনের ঘটনা। শুশুক গুলো সেই যে ভরা জোয়ারে মাথা তুলে ডিগবাজি দিত, শুকনো নদীতে তাদের আর চোখে পড়ে না। পালতোলা নৌকায় নববধূদের এগ্রাম থেকে ওগ্রামে পারাপার হতে দেখা যায় না আর। নদীতে আর আগের মতো আছড়ে পড়ে না ঢেউ। এ যেন মানুষের মনের উথাল পাথাল ভাঙাগড়ার মত। কখনো বসন্ত নাড়া দিয়ে যায়, তো কখনো আবার শুষ্ক জলরাশি। এই ধারা পরিবর্তনে এই ভাঙা গড়ার মাঝখানে, নদী তার অস্তিত্ব এখনও টিকিয়ে রেখেছে। একইভাবে সমুদ্র তার উত্তাল ধরে রাখে।  কখনো সে শান্ত কখনো আবার সেরকম দূরন্ত। ঢেউগুলো ঝাপটা দিয়ে কিনারে আসছে আবার ছুটে যাচ্ছে অজানায়। সেই ঢেউ এর ধাক্কা গায়ে মাখবো বলে সঠিক সময়টার জন্য আমরা অপেক্ষা করি, তাকিয়ে থাকি সম্মুখে; স্থির অপেক্ষা আমাদের। তারপর ভেজা শরীর আগলে নিয়ে পাহাড়ের কাছে যাই, দেখি কী দৃঢ চিত্ত তার। অব্যক্ত কথাগুলো বলার জন্য ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। আমরা মানুষ কেটে টুকরো টুকরো করছি তাদের। বানাচ্ছি উঁচু দালান, বিনোদন কেন্দ্র, হোটেল,  আর বাড়ি বানিয়ে বসতি গড়ছি, তাইতো দিন দিন কষ্টগুলো ব্যথায় রূপ নিচ্ছে। পাহাড়গুলো প্রতিনিয়ত হচ্ছে ছোট আরও ছোট। ওদের শরীর বেয়ে অঝোরে যে ঝর্ণা ধারা বয়ে যায়, বিমুগ্ধ নয়নে চেয়ে দেখবার চোখগুলো যেন জলবায়ুর বিষাক্ত দহনে ম্লান হচ্ছে অথবা হারাচ্ছি প্রতিনিয়ত চোখের সৌন্দর্য। মনের একরাশ চাহিদা।

আমরা তখন একটু উদাস হয়ে আবারও মাটির কাছাকাছি যাই, মাটির সুবাসে ফসলের গর্বিত হাসিতে আন্দোলিত হই, ভুলে যেতে চাই অনেক কিছু, পাওয়া আর না পাওয়ার হতাশাগুলো। তারপর বাতাসের কাছে আশ্রয় নিই, বড় করে শ্বাস নিব বলে আগলে ধরতে চাই বাতাসকে। গায়ে মেখে নিয়ে মুগ্ধ হই, তাকাই, বিস্তির্ণ খোলা আকাশের দিকে। কী অদ্ভুৎ ঔদার্য নিয়ে পৃথিবীকে একই মায়ায় ঢেকে রেখেছে সে। অসংখ্য হৃদয়ে আকাশি আবির মেখে দিয়ে প্রশস্ত করতে চাইছে হৃদয়। তুলোর মত মেঘগুলো বলছে আমাদের মত উদার হও, প্রেমময় করো জীবন, আত্নবিশ্বাস বাড়াও, মনের দুয়ার খুলে দাও, দূর কর ভেদাভেদ। মানুষে মানুষে এই যে দূরত্ব, তা মুছে ফেল, যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বেরিয়ে আসো। গোলা বারুদ আর মৃত্যুর অত্যাধুনিক মিছিল থেকে বাঁচাও প্রকৃতিকে। বেরিয়ে আসো রক্তের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। তোমাদের এই রক্ত ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে বাতাসে হৃদয়ের আনাচে কানাচে। বাতাসে ভাসছে শিশুর কান্না, নারীর হৃদয়ের হাহাকার!  এতে প্রকৃতি হচ্ছে বিবর্ণ, ওদের এই  মলিনতা  মানুষের চিত্তকে করছে চঞ্চল, বাড়ছে অস্থিরতা হিতাহিত জ্ঞান স্বার্থপরতা, মানুষ হারাচ্ছে আত্নবিশ্বাস। সুখ আর স্বস্তির ঠিকানায় প্রকৃতি এখন দিশেহারা, তাই সে খুঁজছে নির্মলতা, খুঁজছে ফুল, খুঁজছে সুবাস। সুবজ তার ধূলো বালি ঝেড়ে নির্মমতা মুছে ফেলে আবারও সবুজ রঙে মেলে দিতে চাইছে নিজেকে। আমরা চোখ মেলে দেখি না, কারন আমরা আমাদের খুঁজি না, খুঁজে দেখি না। এভাবেই অনেক হারানো আর না পাওয়ার মধ্যে কখন যেন আমরা মুখোশের অন্তরালে হারিয়ে ফেলি নিজেদের।

সময়টা এখন অনেক সাজানো গোছানো। আর তা এতটাই পরিপাটি করে রাখা যে, বাইরের আভরন দেখে বুঝার উপায় নায় কে কতটা ভালো আছি! বাইরের চাকচিক্য আর ভালো থাকা নিয়ে এতটাই হিসেবি হয়ে উঠেছি যে, মনের খোঁজ নিতে ভুলে গেছি! শরীরের বড় অংশ যে মন, তাকে যথাযথ যত্নআত্তি না নিলে জীবনের সৌন্দর্যগুলো যে মলিন হয়ে মরিচা পড়ে! আর তা প্রতিনিয়ত ক্ষয়ে যেতে থাকে, তখন  কৃত্তিমতার সাথে বসবাস করা ছাড়া উপায় থাকে না। তখন ’তোমাকে ভালোবাসি’ এমনই মধুর কথায় হুট করে জড়িয়ে কত বিপত্তিই না ঘটে! যন্ত্রনির্ভর এই জীবনে আমাদের অনুভূতিগুলো কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে, তা না হলে ভালোবাসার গন্ধ ছড়িয়ে বিশ্বাসের নামে প্রেমিকাকে শারীরিক ভাবে নির্যাতন এমন কী নিজের চাহিদা মতো না পেলে তাকে হত্যা করার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে কীভাবে? অনুভব অনুভূতির জায়গাগুলো এখন অনেকটাই মৃত; পরিবার হোক কি সমাজ, তার কাছে কী চাই আমরা? আমাদের প্রত্যাশাগুলোকে বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা কি পরখ করেছি? কতটুকু দেয়া উচিত একে অপরকে, কাছের জনদের ভালো রাখতে পারছি কিনা, সেখানে কতটুকু হৃদয়ের ছোঁয়া আছে আর কত টুকুই-বা মেকি, সেগুলো নিয়ে ভাববার, সেগুলোর পেছনে সময় দেয়া বড় জরুরি। নইলে সমাজ পরিবার আরও বেশি করে অবক্ষয়ের  দিকে যাবে, বাড়বে কৃত্তিমতা। শুধুই দেখানো ভালো আছি সবাই, এ কোন সুস্থতা না। এভাবেই কি আমরা বাঁচতে চাই? নিশ্চয় না। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বের করতে চাই সমস্ত চাওয়া গুলো।  দেখতে চাই, সবার মুখ জুড়ে খেলছে অনাবিল আনন্দ,  অঘটনগুলো কমে আসবে প্রতিনিয়ত, মানুষ উপলব্ধি করবে সুখ এবং শান্তির তফাৎ।  অন্তরের ঠিকানা খুঁজবে মানুষ,  লোক দেখানো মেকি আচরণ থেকে বেরিয়ে শুধু আমিকে তুলে ধরবে সহজভাবে, ভালোবাসার মানুষকে বুকে আগলে নেবে উষ্ণতায়, প্রকৃতির কাছে দায়বদ্ধতা নিয়ে ভাববে, সৎ আর শান্তিপূর্ণ জীবনের সন্ধানে নিজেকে আবিস্কার করবে নতুন রূপে । তবেই মানুষ খুঁজে পাবে ঠিকানা। লালনের গান থেকে ধার করে বলতে ইচ্ছে করছে:

অবোধ মন তোরে আর কি বলি

যে ধন সেই ধন সব হারালি

তোরে আর কি বলি।

মহাজনের ধন এনে ছিটালিরে কোন বনে

তোরে আর কি বলি

 

গানের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে যেতে চাই এই ধুলি কণার মাঝে, খুঁজে পেতে চাই শান্তি, আবারো বেঁচে থাকতে চাই এই আলোবাতাসে। পৃথিবীর বিষাক্ত ঘ্রান আর বারুদের গন্ধমাখা  রক্তের উত্তাপ থেকে বেরিয়ে এসে আমি আমাকে খুঁজে পেতে চাই, অর্থপিপাসু লোভী নোংরা বিবেকহীনদের দৃষ্টির বাইরে নিজেকে  খুঁজে পেতে চাই। অবৈধ সম্পদ আর প্রাচুর্যের অহমিকার দালানের ভেতর পরিপাটি করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা জায়নামাজ আর তসবির যে অবমাননা, সেই বিবেকহীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে এসে খুঁজে পেতে চাই নিজেকে। আমি ক্লান্ত নই, হবো না কোনদিন; বিষন্নতা ভর করেনি এখনও; এখনও স্বপ্ন দেখি, এখনও ভোরে কি সন্ধ্যায় পাখি হয়ে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে ওই দিগন্তে। এখনও মাটির সোদা গন্ধ মেখে নিতে মন চায়, এখনও সরষে ফুল দেখলে দৌড়ে গিয়ে তা তুলে এনে খোঁপায় পরতে ইচ্ছে করে। এখনও নদীর স্রোতধারা কূলকূল করে বয়ে যাওয়া দেখলে ঝুপ করে সেই জলে লাফ দিতে ইচ্ছে করে। এখনও আমার মন চায় গোলাপ আর বেলিফুলের ঘ্রাণ পেতে, আর পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা হলে বারবার বলতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসি অনেক ভালোবাসি। সেজন্যই বোধ করি এক গোলার্ধ থেকে আরেক গোলার্ধে, দিগন্ত থেকে দিগন্তে খুঁজে ফিরি নিজেকে। খুঁজে ফিরি আরশিতে আমার আমিকে। আর বেঁচে থাকতে চাই, বারবার অনেকবার।

*=*=*=*=*=*=*=*=*=