‘অরণ্যে যেতে দাও বৃক্ষ প্রণয়ে’
মাহফুজ পারভেজ
একবিংশের এই তপ্ত পরিস্থিতিতে, করোনাকালে, পশ্চিমী ভূগোলের কৃষ্ণসাগর তীরের যুদ্ধংদেহী রণহুঙ্কারের বিপরীতে বাংলা ভাষার এক আধুনিক কবি বলছেন, ‘মানুষকে রেখো না বেঁধে শৃঙ্খলিত খাঁচায়/অরণ্যে যেতে দাও বৃক্ষপ্রণয়ে’। কবির চৈতন্যের সরণিতে এই মাতাল, অস্থির, ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীতেও ‘ডাহুক এখনো ডাকে/দূরে/অদৃশ্যে/অরণ্যপথে/বিপন্নতায়-একাকী’।
‘লোকায়ত সহজ জীবন আর প্রাণ-প্রকৃতির সপক্ষের লড়াকু মানুষদের’ উৎসর্গকৃত কবিতায় ‘রক্তজোছনায় প্রগাঢ় বেদনা’ ঢেলে দিয়েছেন তিনি মানুষ, নিসর্গ, প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি অপার ভালোবাসা ও দরদে। যাবতীয় অন্ধকার ও প্রতিকূলতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে উচ্চারণ করেছেন, ‘নিঃসঙ্গ নিঃশ্বাস নিতে দাও/যেতে হয় যাবো নির্জনে একাকী’। হোসাইন কবির তার কবিতায় মানুষের অন্তহীন গতি আর প্রকৃতি সান্নিধ্যের সমান্তরালে তার কাব্যযাত্রাকে অবিরাম পরিচালিত করেছেন। বলেছেন, ‘মানুষ যাবে/উত্তরে দক্ষিণে কিংবা পুবে পশ্চিমে/জলস্থলে অন্তরীক্ষে/অনেক দূরের পথে মানুষকে যেতেই হবে’।
সমকালীন কাব্যধারায় নিজস্ব স্বাতন্ত্রিক বিন্যাস রচনাকারী কবি হোসাইন কবির (২ ফেব্রæয়ারি, ১৯৬৩), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। যাপিত জীবনে তিনি চট্টগ্রাম ও নিউইয়র্কের যৌথতায় বসবাস করেন সঙ্গে নিয়ে মেঘনা অববাহিকার চাঁদপুরের স্মৃতি, নস্টালজিয়া ও সত্ত্বাকে।
১৯৯৭ সালের বাংলা একাডেমি গ্রন্থমেলায় কবি হোসাইন কবিরের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জলের কল্লোল বৃক্ষের ক্রন্দন’ প্রকাশ পায় ঢাকার বাড পাবলিকেশন্স থেকে। মনে আছে, সেই ফেব্রুয়ারি আমরা একত্রে কাটিয়ে ছিলাম ঢাকায়। শহিদ মিনার, বইমেলা, নীলক্ষেত্রে আবর্তিত ছিল আমাদের দিন আর রাতগুলো। শিল্পী উত্তম সেন অঙ্কন করেন প্রচ্ছদ। আমি লিখেছিলাম ভূমিকা। হোসাইন কবিরের প্রথম কাব্যগ্রন্থের আনন্দ ও উত্তেজনায় শরিক ছিলাম আমরা অনেকেই।
তারপর, ২০০৪ সালে হোসাইন কবির প্রকাশ করেন পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘ও মাটি ও শূন্যতা’, ২০১৪ সালে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁকোর নিচে শান্তজল’, ২০২০ সালে চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ ‘নিঃসঙ্গ পাতার বাঁশি’ এবং এই ২০২২ সালে পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘ডাহুক এখনো ডাকে’।
‘জলের কল্লোল বৃক্ষের ক্রন্দন’ (১৯৯৭) থেকে ‘ডাহুক এখনো ডাকে’ (২০২২) পর্যন্ত দীর্ঘ কাব্যযাত্রায় হোসাইন কবির সুনির্দিষ্ট করেছেন কবিতার প্রতি তার অন্তর্গত অনুরাগ এবং প্রকাশ্য অভিমুখ। এক অভিনব বিশিষ্টতায় এবং স্বাতন্ত্রিকতায় নির্মিত শৈলীতে তিনি প্রতিস্থাপন করেছেন কবিতা, মানুষ, প্রকৃতি ও নিসর্গের নান্দনিক পাটাতন। শব্দ-দূষিত সমাজের হৈ-হট্টগোল পেরিয়ে তার কবিতা একান্তে কথা বলে আধুনিক মননের প্রাকৃতিক নিবিড়তায়। কাব্য সুষমায় তিনি রচনা করেন আরণ্যক পদাবলী, যা মানুষের আক্রান্ত ও ক্ষয়-প্রাপ্ত দোসরের বেদনা ও অশ্রুমালাকে পুঞ্জিভূত করে পাঠকের আত্মার অলিন্দে। তার প্রেম, তার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতা যেন সতত আবর্তিত হয় মানুষ, প্রকৃতি ও নিসর্গে বর্ণালীতে, ‘পদ্মা মেঘনা ডাকাতিয়া কর্ণফুলীর শ্যামলিম মৃত্তিকা হতে/মাঘে মাঘে ধূলিতে-ধূসর স্মৃতির পাতায়/রাইনের এপারে দাঁড়িয়ে ওপারের পর্বতশৃঙ্গে/দেখি আজও অপ্সরা লোরেলাই’।
পুরোটা জীবনের সমস্ত রোদ মাথায় নিয়ে ধূলোয় ধূসরিত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে একটি প্রলম্বিত বটের ছায়ায়, সুনিবিড় প্রকৃতিতে, অরণ্যের আলো ও অন্ধকারে, নিসর্গের জ্যামিতিতে, জলের কল্লোলে কিংবা বৃক্ষের ক্রন্দন ছুঁয়ে হোসাইন কবির পৌঁছে যান একাকী ডাহুকের ডাকে। রোমাঞ্চকর কাব্যযাত্রার এই কবি মানুষ ও প্রকৃতির এতোটাই কাছাকাছি, যতটা তিনি দূরতম আত্মপ্রচার, বাহবা, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার কুৎসিত মঞ্চ থেকে। ভিড় বা সাহিত্যিক ইভেন্ট মেনেজমেন্টের পাণ্ডাদের অবজ্ঞা করে তিনি ঠিকই সৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা। তার কবিতার প্রবহমান শক্তিমত্তাই সমকালীন জঞ্জালকে নস্যাৎ করে একজন প্রকৃত কবির যথার্থতার তুল্যমূল্যে তাকে কালের দর্পণে অবশ্যই চিত্রিত করবে।