You are currently viewing অপেক্ষা || রোকন রেজা

অপেক্ষা || রোকন রেজা

অপেক্ষা

     রোকন রেজা

 

আয়না ঠিকই টকে টকে থাকে। সময়মতো সুযোগটা লুফে নেয়। আজিমদ্দি কিছুই বুঝতে পারে না।

আয়নার দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহ তাকে এবার ফেরাবে না। তার মানত কিছুুুুুুুুুুুুুতেই বৃথা যাবে না। মাটির চুলায় লাউয়ের তরকারি সেদ্ধ হতে থাকে আর দূরকল্পনায় আয়না আগত সন্তানের মুখ দেখে রোমাি ত হয়।

আজিমদ্দি ঘটনা যখন জানতে পারে সময় তখন অনেকটাই হাত ছাড়া। আয়নাও নাছোড়বান্দা। অগত্যা আজিমদ্দি হাল ছেড়ে দেয়।

আয়না পেটের ফটো তোলে না। ফটোর প্রতি চরম বিতৃষ্ণা তার। আগেই সে মন ভাঙতে চায় না। নিজের। আজিমদ্দির। সকলের। যদিও এবার মানতে তার কোনো ঘাটতি নেই।

পরপর দুই মেয়ের পর আয়না অনেক ফরিয়াদ করেছিল আল্লাহর কাছে। কিন্তু আল্লাহ শেষমেষ নিজের ইচ্ছাই পূরণ করেছিল। আয়নার না।

তিন মেয়ে নিয়ে আজিমদ্দি অসন্তোষ্ট নয়। মেয়েরা তার যথেষ্ট খেয়াল রাখে। সারাদিন মাছ  বেচে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে বড় মেয়ে নিরু পাখা দিয়ে বাতাস করে। মাঝে-মধ্যে তেল-মুড়িও মাখিয়ে দেয় সামনে। আজিমদ্দি চৌকির ওপর বসে বসে আয়েশ করে মাখানো তেল-মুড়ি খায়।

মেজমেয়ে মিরুটা একটু চ ল। মেয়েটা আজিমদ্দির মা’র আদল পেয়েছে। মেয়েটাকে দেখলেই আজিমদ্দির মা’র কথা মনে পড়ে। মনে মনে তখন একধরনের বেহেস্তি নরম প্রশান্তি পায় আজিমদ্দি। মেয়েটা তার মা হয়ে ফিরে এসেছে।

আয়নার এই সংবাদে আজিমদ্দি মুখ পানসে করে ঘুরে বেড়ায়। সারাদিন ব্যবসা-পাতি করে। কিন্তু যখনই আয়নার কথা মনের মধ্যে ফিরে আসে তখনই চতুর্থ কন্যার মুখ কল্পনা করে কুঁকড়ে যায় সে। তবে একথা সত্য যে কোনো কোনোদিন তীব্র শীতের কুয়াশামাখা ভোরে যখন তার বিছানা ছাড়তে কষ্ট হয় তখন সে একটা পুত্রের অভাব ঠিকই টের পায়। একটা ছেলে থাকলে সে ঠিকই তাকে পাঠিয়ে দিত গঞ্জে-যা বাপ, আম ইট্টু পরে আয়চি। তু মাছ লি বসি যা।

আজিমদ্দি মনে মনে খুশিই হতে চায়। কিন্তু মনটা কোথায় যেন বাধা পেয়ে ফিরে আসে। দ্বিধা, সংশয় বরফের মতো জমে আসে ভেতরে। যদি এবারও…

কিন্তু আয়না ঠিক তার বিপরীত। যেন সে ধরেই নিয়েছে মুসকিল এবার আসান। এ মানত বৃথা যেতেই পারে না। আল্লাহ তার কথা এবার শুনবেই শুনবে। তাছাড়া শরীফা চাচীর গাছ তো আছেই!

আগেরবার গাছ ঠিকমত কাজ করেনি। কেন করেনি একথা শুনতে গেলে শরীফা চাচী বলেছিল-তু বুদায় লিয়োম-কানুন ঠিকমুতো মানিসলি বৌ! তা না হলি ইরকম তো ঘটপে না।

আয়নাও মনে মনে তাই ভাবে। কোথাও না কোথাও ভুল সে একটা করেছিল। কিন্তু এবার সে খুব সাবধান,সজাগ, সচেতন। তাই দিন যতই কাছে আসতে থাকে আয়না ততই আলোকিত হতে থাকে। চেহারায় যৌবনের লাবণ্য ফিরে আসতে থাকে।  দেহের ত্বক মসৃণ, ঝকঝকে হতে থাকে। কি এক অদেখা খুশিতে সারাদিন ঘুরে বেড়ায় আয়না।

 

অবাক করা বিষয়! আটমাস তেইশদিন পর আয়নার মুখ আলো করে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়।

তিন কন্যার পর পুত্র! আজিমদ্দি যা করে তাই ভালো লাগে। মাছ বিক্রির একদিনের লাভের টাকা সে পাড়াশুদ্ধ লোককে মিষ্টি খাওয়িয়ে দেয়। সারাদিনের খাটা খাঁটুনির পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ছেলের নিষ্পাপ মুখটা দেখলে ক্লান্তি যেন নিমিষেই কেটে যায় আজিমদ্দির। মনের মধ্যে বাকুম বাকুম আনন্দ খেলা করে।

একদিন সন্ধ্যায় খেয়ে-দেয়ে আজিমদ্দি যখন বালিশে মাথা দেয়, মশারির খুঁট লাগাতে লাগাতে আয়না বলে-জানো আমি কি মানত করিলাম?

এইটুকু বলেই আয়না থামে। মনের মধ্যে কথাগুলো সাজিয়ে নেয়। তারপর বলে-মানত করিলাম আল্লা যদি ইবার ছেলি দেয় তালি তারে আমি বড় মওলানা বানাবো। কুরআনের হাপেজ বানাবো।

আয়না আবারও থামে যেন সে নিজ চোখে দেখতে পায় তার সন্তানের অবয়ব। ছোট্ট সুন্দর ফিনফিনে পাঞ্জাবি,সাদা টুপি,পাগড়ী-কোথায় যেন হারিয়ে যায় আয়না টুকুস করে। তারপর আয়না ড্রেসিং-টেবিলের বড় আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় । উৎসাহী গলায় বলে-রুজার মাসে আমার ছাওয়ালের পিছে কত লোক নামাজ পড়বি। আয়না যেন এ দৃশ্যও তার মানসচক্ষে দেখতে পায়। দেখতে পায় তার ছেলে সূরা ফাতেহা দিয়ে নামাজ শুরু করেছে। তার পেছনে কয়েকশ মানুষ। তার ছেলে একের পর এক কুরআন থেকে তেলোয়াত করে যাচ্ছে। আহ, কি সাবলীল, কি মিষ্টি সেই কন্ঠ! আয়না যেন সবই দেখতে পায়। তার বুকটা ভরে ওঠে গৌরবে,আনন্দে। সে ভাবে তাদের এই ছেলে নিশ্চয় তাদেরকে বেহেস্তে নিয়ে যাবে।

আয়নার কথা শুনে কপালের শিরাগুলো সামান্য ফুলে ওঠে আজিমদ্দির। চোখের তারায় উদাস ভাবনা ভর করে। আয়নার বলা কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসে মনের মধ্যে-মওলানা বানাবো, হাপেজ বানাবো,আল্লার রাস্তায় দিয়ে দেবো।

 

সাত বছর পর। স্বপ্তডিঙা হাফেজিয়া মাদ্রাসা।

এক সকালে রাতুল বাবার সাইকেলের ক্যারিয়ারে চেপে ভর্তি হয়ে আসে মাদ্রাসায়। তিনদিন পর গুছিয়ে দিয়ে আসে আজিমদ্দি নিজেই।

আয়নার বুকটা চৌচির হয়ে যায় চৈত্রের মাঠের মতো। বোনেরা কান্না জুড়ে দেয়। অতটুকু রাতুল সত্যিই তখন বোঝে না পৃথিবীতে কেন এত বন্ধন, কেন এত মায়া।

আয়না মনে মনে খুশি হয়। এ তো আল্লার কাছ থেকে চেয়ে নেয়া পুত্র। এ তো তারই মহাদান। তাই মানত যদি পূর্ণ না হয় তাহলে তিনি যদি আবার অন্যথা করে বসেন! আয়নার মনের মধ্যে সিরসিরানি ভয়,দ্বিধা সারিবাধা পিঁপড়ের মতো ওঠা-নামা করে।

রাতুল মাদ্রাসায় এসে পায় বাড়ির পাশের হামজা। আস্তে আস্তে সখ্যতা গড়ে ওঠে ওর সাথে।

হামজার মা বিষ খেয়ে মরে যাবার পর সহায়-সম্বলহীন নানী তাকে নিয়ে পড়ে মহা বেকাদায়। অবশেষে জগলু মেম্বারের পরামর্শে হামজাকে এখানে দিয়ে যায় সে। থাকা-খাওয়া বাবদ মাসে মাসে কিছু দেবার কথা থাকলেও হামজার নানী কোনো মাসেই তা ঠিকমত দিতে পারে না। তাই মাদ্রাসার বড় হুজুর এনামুল হাফেজ হামজাকে দিয়ে একটু বাড়তি কাজ-টাজও করিয়ে নেয়।

কোনোদিন কোনোদিন ঝিমিয়ে পড়া বিকেলে যখন ওদের সহপাঠীরা পায়জামা পরে মাদ্রাসার মাঠে ফুটবল খেলে তখন হামজা আর রাতুল আস্তে আস্তে বেরিয়ে পড়ে। দুজন চলে আসে স্বপ্তডিঙা বাজারে। রাস্তার পাশের দোকান থেকে ওরা তেলেভাঁজা কিনে খায়। চা’য়ের দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে টেলিভিশনে গান দেখে। সিনেমা দেখে। মেয়েদের রেসলিং দেখে। তারপর একদিন রাতুল কাউকে কিছু না বলে হামজার সাইকেলে উঠে বাড়ি চলে আসে।

সন্ধ্যার পর ওদের খোঁজ হয়। এনামুল হাফেজ মোবাইল করে আজিমদ্দিকে। আজিমদ্দি তখনও বাড়ি ফেরেনি। সে আয়নার কাছে মোবাইল করে নিশ্চিত হয় ছেলের অবস্থান। হাফেজের কাছে ক্ষমা চেয়ে বাঁচে আজিমদ্দি। হামজার নানীর মোবাইল নেই।

 

শীতের কনকনে হিম ভোরে উঠে নামাজের আগেই সবক। ঠান্ডা পানিতে ওজু। একসাথে নামাজ। একটানা দুইঘন্টা হেবজ। আধা ঘন্টার বিরতি। আবার সবকের পারা। জোহরের আগেই আমুখতা শুরু, আসর অব্দি। এ যেন নিয়মের প্রাচীর। পাখির খাঁচায় বদ্ধ জীবন।

মাঝে মাঝে থাকে কালেকশন। বড় হুজুর এসে বলে, তোমরা রেডি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি। আজ কালেকশন ঘোলদাড়ি হাটে। তখন রাতুলরা তাড়াতাড়ি পায়জামা পাঞ্জাবি আর টুপি পরে রেডি হয়ে নেয়। বড় হুজুর বললেই হাঁটা শুরু করে। তারপর সারা দুপুর-বিকেল দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তায়। মানুষের কাছে ভিক্ষা চায় টাকা। মানুষও ধর্মের নামে কিংবা বেহেস্তে যাবার লোভে ওদের ভিক্ষা দেয়। তারপর সন্ধ্যার আগে আগে ওরা আবার ফিরে আসে মাদ্রাসায়। সেদিন পা দুটো টনটন করে ব্যথায়।

মাদ্রাসার এই ভাত-তরকারিতেও রাতুলের ঠিকমত পোষায় না। অন্যরা যখন গোগ্রাসে গেলে তখন সে অসহায়ের মতো ওদের খাওয়া দেখে। তবে ওদের দাওয়াত থাকে প্রায়ই। এগ্রাম-সেগ্রাম। কলেমাখানি,মিলাদ,ছেলে-মেয়ের কামান আরও কত কি! পূণ্যের আশায় মানুষ এইসব অসহায়, দরিদ্র, এতিম ছেলেদের ওরা খাওয়ায়। আর সেইসব দিনগুলোতে রাতুল পেট ভরে ভাত খায়।

কত কথা মনে পড়ে রাতুলের। মা তাকে কত আদরেই না খাওয়াত। জিওল মাছের লম্বা কাঁটা বেছে দিত পাতে। পাঙাশ মাছের দেহ কি নরম আর তুলতুলে হতো! বাবা বাজার থেকে মাংশ আনলে মা কলিজাগুলো আলাদা করে রাখত। কি সুস্বাদুই না ছিল সেই কলিজা রান্না। আর এখন কি জীবন! খাওয়ার পর এখন নিজের থালা বাটি নিজেই ধুতে হয়। মাঝে মাঝে বড় হুজুরের এঁটো থালা বাটি, ময়লা জামা কাপড়ও তাদের ধুয়ে দিতে হয়। রাতুলের দু’চোখ ভরে তখন জল চলে আসে। বুকের মধ্যে বাতাস ফুরিয়ে যায়। ছোট্ট বুকের মধ্যে হাহাকার জমা হয় পাহাড়ের মতো।

রাতুলরা যে ঘরটাই থাকে পরপর পাঁচটা কাঠের চৌকি। রাতুলেরটা জানালার পাশেই। মাঝে মাঝে বিরস মুখে সে বসে থাকে তার চৌকিতে। বসে বসে দেখে বাঁক কাঁধে দেলখোসয়ালা, ভ্যানগাড়ীতে আইসক্রীময়ালা। আরও দেখে ফূর্তিভাজা, চালতার আচার। কি এক মধুময় হাঁক ছেড়ে চলে যায় সবাই। আর ঐ হাঁক শুনে রাতুলের মন তখন বাঁধভাঙা জলের মতো বাড়ি খায় কূলে।

রাতুলের কাছে টাকা থাকে না। মাসের খরচ হাফেজের কাছে জমা করা। আগে মা’র কাছে ছুটে গেলেই দু’চার টাকা পাওয়া যেত। রাতুলের মনে হয় হঠাৎ করেই মা যেন কত দূরের হয়ে গেল! তার মনে হয় এই দেলখোস, এই আইসক্রীম, চালতার এই মিষ্টি আচার, ফূর্তিভাজা তার জীবন থেকে বুঝি একেবারেই হারিয়ে গেল!

মাঝে মাঝে নিরুর কথা মনে হয়। কত মজা করত সে ওদের সাথে। বিকেল হলেই হেঁটে বেড়াত এপাড়া-সেপাড়া। কত মানুষের সাথে দেখা হত, কথা হত। কত মানুষ আদর করত। চুল নেড়ে দিত। মাঝে মাঝে একবেলা হাটে বাবা তাকে নিয়েও যেত। কত মানুষ সেই হাটে! কতকিছু বেচা-কেনা হত সেখানে। রাতুল পলিথিন ভরে খুরমা, জিলাপী নিয়ে আসত নিরুদের জন্য। আহা! সেইসব দিন আসতে না আসতেই কোথায় যেন মিলিয়ে গেল!

 

তুমুল বৃষ্টির সন্ধ্যা। শোঁ শোঁ বাতাস। এনামুল হাফেজ কোথায় যেন কলেমা খতমে। ফিরে এসে দেখে দুইজন নেই। কিন্তু তাতে তার চোখে-মুখে চিন্তার কোনো বলিরেখা ভাসে না। সে নিশ্চিত ওরা আবার বাড়ি চলে গেছে। এই দুই বজ্জাতকে নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না। বড়টা ছোটটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে।

দু’দিন হয়ে যায়। দু’জনের কেউই ফেরে না। এনামুল হাফেজ অনেকটা নির্বিকারভাবে মোবাইল করে আজিমদ্দিকে।

আজিমদ্দির সেদিন হাট নেই। দাওয়ায় বসে দম নিচ্ছে। আয়না রান্নাঘরে ভাত চড়িয়েছে রাতের। মেয়েরা ঘরের মধ্যে খিলখিলিয়ে হাসে লুডুখেলায়। ঠিক সেইসময় এনামুল হাফেজের মোবাইল আসে-আপনার ছেলেকে নিয়ে তো মুসকিল হয়ে যাচ্ছে। আজও পাঠালেন না! দুদিন হয়ে গেল!

আজিমদ্দি প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে না আগা-মাথা। একটু ধাতস্থ হয়ে নেয়। তারপর বলে-কি বুলচেন হাপেজ সাপ! ছেলে তো ইবার বাড়ি আসেনি!

বাড়ি যায়নি? ওপাশ থেকে হাফেজের কন্ঠস্বর ধমকের মতো শুনায়।

আজিমদ্দি একথার কোনো উত্তর না দিয়ে আয়নাকে ডেকে ওঠে-আয়না,রাতুল কি বাড়ি আইচে?

-রাতুল! এটুকু বলেই থেমে যায় আয়না।

গতবারই ছেলেকে কেমন যেন উদাস মনে হয়েছিল তার। মনে হয়েছিল এ ক’দিনেই সে যেন অনেক বদলে গিয়েছে। অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। বুঝে গিয়েছে পৃথীবির অনেককিছু। চিনে গিয়েছে মানুষের শক্ত মন। এই ক’দিনেই সে যেন অনেক কঠিন হয়ে গিয়েছে। আয়নার তাই মনে হয়েছিল কেউ নিশ্চয় তার ছেলের মাথায় খারাপ পোকা ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আয়না তাই অনেক বুঝিয়েছে ছেলেকে। তার মানতের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। হাফেজিয়া পাশ করে মওলানা হলে, বড় হাফেজ হলে বেহেস্তে কিরকম সুখে থাকবে তারা সেটাও সে বলেছে ছেলেকে।

কিন্তু রাতুল যেন কিছুই শোনে না। তার মন পড়ে থাকে করিমনের মাঠে লেজয়ালা ঘুড়িতে। জসিমের রঙিন ফুটবলে। স্বপ্তডিঙা বাজারের দুইটাকার সন্দেশে। হামজা তার মনের মধ্যে অতি সংগোপনে অন্য এক পৃথিবীর স¦প্ন ঢুকিয়ে দিয়েছে। যা কেউ জানে না।

আজিমদ্দি তখনই সাইকেল নিয়ে ছোটে মাদ্রাসায়। কিন্তু না, সেখানে সে সত্যিই নেই। সেদিন সেই বৃষ্টির রাতে হামজা তার পাশের চৌকির ফরজের বালিশের কভারের ভিতর থেকে দুইশ আশি টাকা চুরি করে রাতুলকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। সহপাঠীরা মাঠে খেলতে খেলতে ওদের একসঙ্গে যেতে দেখেছে।

এনামুল হাফেজের বুদ্ধিতে আজিমদ্দি বাড়ি ফেরার পথে গঞ্জে রেকর্ডিং-এর দোকানে গিয়ে নিখোঁজ সংবাদ রেকর্ড করে।

আয়না ছুটতে ছুটতে আসে হামজার নানীর কাছে-তোর লাতী তো বড়,উই আমার ছেলিকি ফুসলায়ে লিগিছে।

ফুসলায়ে নিয়ে যাক আর ভালোবেসেই নিয়ে যাক দুজনেই তো লাপাত্তা। প্রতিবেশীরা আয়নাকে বুঝায়। দুই মেয়েকে নিয়ে আয়না ফিরে আসে নিজের ঘরের মাটির দাওয়ায়। রাত তখন কত কে জানে!

বড় মেয়ে নিরু আসে সন্ধ্যায়। ভায়ের জন্য অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করে থামে। ওর কোলের ছেলেটা ওকে ক্রমাগত বিরক্ত করে যায়।

আয়নার চোখের জল বিকেল থেকে কেঁদে কেঁদে নিঃশেষ। প্রতিবেশীরা সান্ত¡না দেয় ছেলে ফিরে আসবে। কিন্তু আয়না বুঝতে চায় না ছেলে কখন ফিরে আসবে আর কবে ফিরে আসবে।

দু’রাত থেকে নিরু ফিরে যায় স্বামীর কাছে। অনেক কাজ পড়ে আছে বাড়িতে। আগে যেদিন আসত সেদিনই ফিরে যেত। এবার তবু দু’রাত থেকে গেল। আর কিছুতেই সম্ভব নয়।

আজিমদ্দিও হাটে হাটে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাছের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় এহাট-সেহাট। এ-নদী সে-নদী।

মেয়েদের স্কুল শুরু হয়েছে। সকাল-বিকাল প্রাইভেট। আস্তে আস্তে ওরাও ভুলে যাচ্ছে ওদের একটা ভাই ছিল। শুধু  মাঝে মাঝে দূরে পায়ে চলা মাটির পথের পানে দু’চোখ মেলে চেয়ে থাকে আয়না। শুকনো বালুচরের মতো পুত্রহারা কষ্টটা চিকচিক করে কলজের মধ্যে। ধিকিধিকি জ্বলে।

মার্চ-২০২৩

***********************