You are currently viewing অদ্ভুত এই না-জানা, অদ্ভুত এই অনিশ্চয়তা > ঋতো আহমেদ

অদ্ভুত এই না-জানা, অদ্ভুত এই অনিশ্চয়তা > ঋতো আহমেদ

অদ্ভুত এই না-জানা, অদ্ভুত এই অনিশ্চয়তা

ঋতো আহমেদ

গত ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রয়াণের মাধ্যমে সমাপ্ত হল প্রায় ৭০ বছরেরও বেশি সময়ের তাঁর রাজত্বকাল। ৯৬ বছরের দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর স্বামী প্রিন্স ফিলিপ বেঁচে ছিলেন অবিশ্বাস্য ৯৯ বছর। পরবর্তী রানী কে হবেন, এই আলোচনা চলছে সর্বত্র। এমনকি আমার ১৩ বছরের ছেলেও তার স্কুলের বন্ধুদের গ্রুপে এই নিয়ে চ্যাট করে যাচ্ছে খুব। মনে আছে, আমার সময়ে, সেই ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে, প্রিন্সেস ডায়নার মৃত্যুর পর তাঁর একটা বড় ছবি এনে টাঙিয়ে রেখেছিলাম আমার পড়ার ঘরের দেয়ালে। সেই থেকে আমার স্ত্রীর ধারণা আমি বোধয় ডায়নার ভক্ত। আসলে ডায়না নন। আমার আগ্রহ ফিলিপে। না, তিনি প্রিন্স ফিলিপও নন। তিনি ফিলিপ লারকিন। ব্রিটিশ কবি। তাঁর কবিতা আমাকে টানছে বেশ। তাঁর কবিতায় ভাষার প্রাঞ্জলতা আমার সচেতন দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শত বর্ষ আগে ১৯২২ সালের যুক্তরাজ্যের কৌভেন্ট্রিতে জন্মেছিলেন এই কবি। আমারই মতো তিনিও সারা জীবন চোখের দৃষ্টি সমস্যায় ভুগেছেন। বিয়ে করেননি। দীর্ঘ দিন হাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর কাব্য চর্চা করে গেছেন নিরলস। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে ইয়েট্‌স আর থমাস হার্ডির কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিজস্ব কবিতাপথ নির্মাণ করেন। কিন্তু কেমন সেই পথ? হ্যাঁ, এই পথে এগুলে একজন পাঠক অনুধাবন করতে পারেন আধুনিক কবি কীরকমভাবে সমসাময়িক সমাজের ভাষায় লিখতে পারেন তাঁর পরিপার্শ্বের আশ্চর্যকে। স্বাদ পেতে পারেন শ্রেষ্ঠ সেইসব কবিতার যেখানে পাওয়া যায় বাস্তব জীবনের যাপিত অভিজ্ঞান। যে অভিজ্ঞান পাঠকের চেতনায় জাগাতে পারে অবস্থা আর অবস্থানের বোধ, মানুষ আর মনুষ্য ঘটনার অভিঘাত। যা কিনা বিশেষ কোনও দৃশ্যে কবির অবলোকনকে করে তোলে বিশ্বাসযোগ্য। হ্যাঁ, পড়তে পড়তে এমনই শিল্পকুশলতা দেখতে পাই আমরা লারকিনের কবিতায়। কবিতায় বলা সত্যগুলো যতোই জটিল বা প্রপঞ্চময় হোক না কেন কবিতার ভাষার প্রাঞ্জলতায় তা ঠিকই গেঁথে যেতে পারে পাঠকের মনে ও মননে। আমরা বুঝতে পারি, আমাদের আপন জীবন, একেকটি নৈমিত্তিক সত্যের উন্মোচনের মাধ্যমে, কবিতা হয়ে উঠতে পারে। মিলিয়ে নিতে পারি জীবনকে জীবনেরই সঙ্গে। আমাদের কোনও অলৌকিকের প্রয়োজন নেই। A poem is better based on something from ‘unsorted’ experience than on another poem or other art.

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেইন্ট জন্স কলেজ থেকে ইংরেজিতে গ্রাজুয়েশন করার সময় লারকিনের পরিচয় ঘটে ঔপন্যাসিক ও কবি কিংসলে অ্যামিসের সঙ্গে। এরপর তিনি গ্রন্থাগারিক হওয়ার জন্য প্রফেশনাল পড়াশোনা বেছে নেন এবং জীবনের বাকীটা সময় বেশ কয়েকটি গ্রন্থাগারে দায়িত্ব পালন করে যান। প্রথমে শ্রপশা ও লেস্টা, পরে বেলফাস্টের কুইন্স কলেজে এবং শেষে হাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতাবইগুলোর পাশাপাশি লারকিনের দুটো উপন্যাসও রয়েছে। [Jill (1946), A girl in winter (1947)]। এ ছাড়া তিনি সাহিত্য সমালোচনা, প্রবন্ধ আর জাজ সঙ্গীতের উপর আলোচনাও লিখেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিদের একজন ধরা হয় তাঁকে। ১৯৮৫ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁকে বলা হতো “England’s other Poet Laureate” । ১৯৮৪ সালে সভাকবির ওই পদটি শূন্য হলে বহু কবি সাহিত্যিকই সেখানে তাঁকে আশা করেছিলেন। তবে লারকিন কিন্তু বরাবরের মতোই লাইমলাইট এড়িয়ে থাকতেই পছন্দ করলেন।

পুরো জীবনে লারকিন প্রশংসিত হন মাত্র চারটি কবিতা বইয়ের প্রকাশে। একেকটি বই দশক-দীর্ঘ সময় বিরতি নিয়ে নিয়ে বেরিয়েছে। The Less Deceived (1955), The Whitsun Weddings (1964) আর High Windows (1974) – এই তিনটি বইয়ের কবিতাগুলো পড়লে একজন কবিতাবিমুখ মানুষও ফিরে আসতে পারেন কবিতায়। পেতে পারেন স্বস্তি আর আনন্দ। লারকিন তাঁর কবিতায় ছন্দমিল, স্তবক আর মাত্রার মতো ট্র্যাডিশনাল টুলই ব্যবহার করেছেন। খুঁজে বেড়িয়েছেন আধুনিক মানুষের জীবন-যন্ত্রণা, যা প্রায়শই অস্বস্তিকর ও ভয়ংকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে অর্জিত। কৌশলগত উজ্জ্বলতায় আর অনুরণিত সৌন্দর্যে এইসব কবিতা অনন্য মাত্রা পেয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে গভীর গোলমেলে হলেও অধিকাংশ পাঠকের কাছেই তা সহজ ও আবেদনময়।

 আবার স্বাদকে তো নির্ভর করতে হয় মেজাজের উপরও। লারকিনের দুঃখময়তার শৈলী কিংবা তাঁর কবিতা-কৌশল আমাদের সবসময়ই কি প্রলুব্ধ করতে পারে? জাগাতে পারে সহানুভূতির অনুরাগ? কখনও কখনও তাঁর বিষণ্ণতা আমরা পেয়ে যাই ঐকান্তিক রূপেও। জেমস রাইট কিংবা ডব্লিউ এস গ্রাহামের চেয়েও কিছুটা দূরবর্তীর তিনি। তবে এমনও নয় যে তাঁর কবিতায় সহনশীল ক্ষোভের ঝিমিয়ে পড়া ওই অনুভূতিটুকু অ-স্বতঃস্ফূর্ত। যদিও শান্ত, অবসন্ন আর অনেকটাই নির্মোহ। হয়তো এইজন্য যে, তিনি মনে করতেন রোমান্টিসিজম বিস্বাদ হয়ে গেছে। প্রকৃতিতে, পরিবারে এমনকি হৃদয়েও এর কোনও স্থান আর নেই। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কবিতা আমাদের এও উপলব্ধি করায় যে, মানুষ জন্মগত স্বপ্নদর্শী হলেও তাকে মনে রাখতে হবে জীবনের নানান আকাঙ্ক্ষায় প্রলুব্ধ হয়েও আপন সীমাকে জানা প্রয়োজন, দমন করা দরকার যুক্তির বাইরের সমস্ত অবাঞ্ছিতকে। আবেগের বিসর্জন নয়, তাঁর কবিতা মানেই অনুভূতি আর যুক্তির মিশ্রণ, বিষয়গত পরিত্যাগের সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ। থমাস হার্ডির মতোই মানবীয় প্রত্যাশার হ্রাস তাঁর কবিতার পরতে পরতে প্রবাহিত। কিন্তু হার্ডিতে যে অন্তরাত্মার অস্থির আকাঙ্ক্ষা আর প্রজ্ঞা দেখাতে পাই আমরা—ভালোমন্দের বোধে উৎসারিত অবিরাম দুঃখানুভুতির যে আবেশ আলোড়িত করে আমাদের—তার সঙ্গে কতোটা মেলাতে পারেন আমাদের লারকিন?

ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা সত্যেও লারকিনকে আমরা খুব কমই দেখেছি সাক্ষাৎকারের মুখোমুখি হতে, কিংবা কবিতা পাঠের আসরে তাঁর কবিতা পাঠ করতে। হাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক হয়ে তিনি অনেকটাই আলাদা থাকতেন। সমকালীন সাহিত্য সমাজ, নগরজীবন আর বিভিন্ন গোষ্ঠী-তকমা এড়িয়ে চলতেন। তাঁকে পাওয়া যেত অসাহিত্যিক, মফস্বলীয় আর একান্ত ব্যক্তিগতের দলে। হাল-এর অভ্যন্তরে তাঁর ওই অবস্থান থেকেই একের পর এক কবিতা লিখে গেছেন তিনি। এঁকেছেন যুদ্ধোত্তর প্রাদেশিক ইংল্যান্ডের ভীতি আর আধুনিক যুগের আত্মিক হতাশা। তুলে এনেছেন তাঁর সময়ের ব্যর্থতা এবং অনুশোচনাকে। লিখেছেন স্থবির জীবন আর নষ্ট আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে। আবেগকে নিরাবেগ-প্রকাশের কথোপকথনীয় ভাষা আর লক্ষ্যবিন্দুর স্থানীয়করণ লারকিনের নিজস্ব কৌশল, যা পাঠকের সাথে দারুণভাবে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে পারে। হয়তো এইজন্যেই পরিচিত ইংরেজি লিরিকের জগতে কোনও জীবিত কবি তাঁর সম পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন না। আজকের জীবনের আগে বা পরে, যে কোনও জীবনের অর্থে ও জীবন বোধে, তাঁর কবিতা তীব্র ও মর্মান্তিক। জীবনের সীমায়ও আবদ্ধ। তবে লারকিনের স্বাতন্ত্র্যসূচক কৌশল-দক্ষতা, আঁটসাঁট ফর্মের চাহিদার সঙ্গে খুব ব্যক্তিগত কথোপকথনের মুড অভিযোজনের সূক্ষ্মতা, পাঠকের কাছে খুব দ্রুতই অসামান্য হয়ে ওঠেনি। নিপুণ শিল্পকার হিসেবে তাঁর ওই শক্তিমত্তা অনেকটা সময় নিয়ে, ধীরে ধীরে তাঁর কাব্য-প্রতিভার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য হয়ে ওঠে। 

 

অদ্ভুত এই না-জানা, নিশ্চিত হতে না-পারা

বাস্তব অথবা সঠিক অথবা সত্য বিষয়ে,

অথচ বাধ্য তুমি, যোগ্যতার অর্জনে, কিংবা এমনই মনে হয় আমার,

অথবা হয়তো, ব্যাপারটা এমনই:

কারও নিশ্চয়ই জানা উচিৎ।

 

দুনিয়ার নিয়ম সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়াটা অদ্ভুত:  

প্রয়োজন মিটিয়ে নেয়ার সবার ওই দক্ষতা,

আকৃতির অনুভূতি, আর সময়নিষ্ঠ বীজের বিস্তার,

এবং বদলে যাওয়ার আগ্রহ;

হ্যাঁ, এই অজ্ঞতা সত্যি অদ্ভুত,

 

এমনকি শরীরেও এমন এই জ্ঞানকে ধারণ করতে

সে নিজেই ঘিরে ধরে আমাদের

আর সমগ্র জীবন কেটে যায় ধোঁয়াশায়,

কখন মৃত্যু হবে আমাদের

কেন যে জানি না।

[অজ্ঞতা]

 হ্যাঁ, জীবন ভর ইংল্যান্ডই ছিল তাঁর আবেগের স্থান। বিদেশ ভ্রমণে তেমন আগ্রহ ছিল না। এমনকি অন্য দেশের সাহিত্য সম্পর্কেও ছিলেন উদাসীন এবং অজ্ঞ। তবে তিনি আপন সংস্কৃতির জীর্ণতাকে পরিহার করতে সচেষ্ট ছিলেন সবসময়। লারকিন তাঁর গদ্যে নিজের কৈশোরকে উল্লেখ করেছেন ‘অব্যয়িত’ এবং ‘নীরস’ হিসেবে। শহরের কোষাধ্যক্ষের ছেলে হয়ে বেড়ে উঠছিলেন তিনি কৌভেন্ট্রিতে। ক্ষীণদৃষ্টি আর তোতলামি লারকিনের যৌবনকে জর্জরিত করে রেখেছিল। আর তাই তখন থেকেই একাকীত্বে ডুবে গিয়েছিলেন তিনি। একমাত্র বইই হয়ে ওঠে তাঁর সঙ্গী। পড়তেন খুব। আর রাতে নিয়ম করে কবিতা লিখতেন। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে জন ওয়েন আর কিংসলে অ্যামিসের সঙ্গে। পরে, ওয়েলিংটনের ছোট শহর শ্রপশা থাকাকালীন তিনি রচনা করেন দুটি উপন্যাস আর তাঁর প্রথম কবিতাবই The North Ship এর কবিতাগুলো। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব পালনের পর, ১৯৫৫ সালে তিনি হাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত হন। এবং এখানেই জীবনের ৩০টি বছর স্থিরভাবে অতিবাহিত করে ফ্যালেন। দীর্ঘদিনের বন্ধু অ্যান্থনি থোয়াইট তাঁর চিঠিপত্রের একটা সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। ১৯৪০ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত সময়ের তাঁর ব্যক্তিগত আর পেশাগত জীবনের অনেক বিষয়ই উন্মোচিত হয় ওই চিঠিগুলোয়। ঘনিষ্ঠতা, আস্থাশীলতা আর হৃদয় ভাঙার আওয়াজ পাওয়া যায় চিঠিগুলো পড়লে। শোনা যায় সেইসব শব্দ কর্ণকুহরে নেয়ার আকুল আহ্বান। অবশ্য এইসব প্রফুল্ল, উচ্ছ্বসিত ও হতাশাগ্রস্ত। মাঝেমধ্যেই নোংরা ও কুরুচিপূর্ণ, আত্ম-দৃঢ় এবং স্ব-অবমূল্যায়নকারী। যেগুলো পড়ে লারকিনের কবিতা বিষয়ে দিকভ্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও, আমরা জানি প্রকৃত পাঠকের তা হতে নেই। কারণ, কবিকে বুঝতে, কবিতাকে আপন করে নিতে, ওগুলো সত্যিই সহায়ক। তাঁর পরিণত রচনাগুলোর কারুকর্ম ও শিল্প-দক্ষতা সাহিত্য সমালোচকদের সার্বজনীন অনুমোদন প্রাপ্ত। লন্ডন সানডে টাইমসের সাংবাদিক ইয়ান হ্যামিল্টন লিখেছিলেন: “সাম্প্রতিক কবিদের মধ্যে সর্বোত্তমভাবে, [লারকিন] কঠোর মাত্রা আর আঁটসাঁট মিত্রাক্ষরে কথা বলার কণ্ঠকে সমন্বয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন..।” ডেভিড টিমস তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, “লারকিন ছিলেন অসাধারণ বৈচিত্রময় কবি। কাব্য-দক্ষতায় অনন্য। সুনির্দিষ্ট ভাব প্রণয়ন করতে কবিতায় তিনি ব্যবহার করতেন মাত্রা আর মিত্রাক্ষর। … তাঁর ভাষা মোটেই নীরস নয়, যদি না তিনি নির্দিষ্ট কোনও উদ্দেশ্যে তা করে থাকেন। আর তাঁর শব্দচয়ন কখনও গৎবাঁধা নয়। স্বীকৃত সাহিত্যের সীমা অতিক্রম করে যেতে সবসময়ই খুঁজে চলেছিলেন এমন সব শব্দ যা তাঁর অনুভূতিগুলোকে তাঁর একান্ত ইচ্ছেগুলোকে স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করতে পারবে।”

লারকিনের সেরা কবিতাগুলো বাস্তব অভিজ্ঞতার মধ্যে নিহিত এবং স্থান, পরিস্থিতি, মানুষ আর ঘটনাবলির এক-একটি ধারণা প্রকাশ করে। যা সেই চিন্তাগুলোর সত্যতা জানায়। কবির দৃশ্যের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যা উত্থাপিত। সতর্ক সামাজিক পর্যবেক্ষণের এই শক্তির সঙ্গে সংযোগ মানে হলো স্বর পরিবর্তনের উপর নিপুণ নিয়ন্ত্রণ। এমনকি একটি কবিতার মধ্যে বিকাশমান অনুভূতিরও প্রকাশ। যাকে বলা যায় এক মহৎ শিল্পকৃতির ফসল। প্রকাশিত কবিতাগুলো যতোই প্রপঞ্চময় হোক না কেন, তাঁর ভাষার স্পষ্টতা আর প্রাঞ্জলতা পাঠকের চেতনায় বোধিয় গ্রহণের আমন্ত্রণ জানায়। সাধারণ পাঠকের কাছেও তা বোধগম্যতার বিচারে উৎরে যায়। নিউ লিডার-এর প্রতিষ্ঠাতা পার্ল কে. বেল বলেন, “লারকিনের কবিতা প্রথাগত কাঠামোর মধ্যে অপ্রতিরোধ্য নির্ভুলতায় খাপ খেয়ে যায়…যে কাঠামো ১৯৭০-এর দশকের সংকীর্ণ, অশ্লীল এবং প্যারোকিয়াল ইংল্যান্ডের বাস্তব বিষণ্ণ সত্যে পূর্ণ।” তাহলে, সেই সময়ের লারকিনের শৈলী যদি ঐতিহ্যবাহীই হয়, তবে তো বলাই যায় তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু মানুষের আধুনিক জীবন থেকে একচেটিয়াভাবেই উদ্ভূত হচ্ছিল। বলতেই হয়, যথেষ্ট শক্তি এবং সূক্ষ্মতার সাথে সমসাময়িক সংবেদনশীলতার প্যাটার্নকে চিত্রিত করেছেন তিনি। যেভাবে আমরা আমাদের পরিবেশে প্রতিক্রিয়া জানাই, যেভাবে আমাদের মধ্যে মানসিক প্রবাহের ভাটা এবং জোয়ার চিত্রায়ন করি— সেইভাবে তাঁর কবিতা হৃদয় ও মনের মনোভাবগুলোকে মূর্ত করে তোলে। যা আমাদের সময়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলে মনে হয়: আমাদের সন্দেহ, নিরাপত্তাহীনতা, আমাদের একঘেয়েমি, লক্ষ্যহীনতা আর অস্বস্তি।

 

প্রেমের কঠিন পর্বটি হলো

স্বার্থপর হওয়া,

অন্ধ অটলতায়

শুধুই নিজের স্বার্থে

প্রিয়কে দুঃখ দেয়া।

[প্রেম]

 

জীবন যে বিস্মৃতির একটি সীমিত সূচনা তা লারকিনের অনেক কবিতারই অন্তর্গত। কিং বলেন, “তাঁর কবিতা হচ্ছে হতাশার কবিতা, রোমান্টিক বিভ্রম ধ্বংসের কবিতা, সময়ের দ্বারা মানুষের পরাজয়ের এবং তার নিজের অপ্রতুলতার কবিতা, সেইসাথে কীভাবে স্বপ্ন, আশা এবং আদর্শ বাস্তবতার মাধ্যমে নিরলসভাবে হ্রাস পাচ্ছে তার পাঠই হচ্ছে লারকিনের কবিতা। এইসব কবিতা জীবনের কবিতা।” তাঁর কাছে জীবন কখনই অন্ধ উদ্ঘাটন, রহস্যময় অন্তর্দৃষ্টি, প্রত্যাশার উজ্জ্বলরকম পূর্ণ হওয়ার বিষয় ছিল না। জীবন, লারকিনের জন্য, এবং, স্পষ্টতই, আমাদের সকলের জন্য, এমন কিছু একটা ব্যাপার যেটা আমাদের জাগতিক বেঁচে থাকাটুকুই বোঝায়। বোঝায় নিশ্চিতভাবেই যে এর লোভনীয় পুরস্কারগুলি নিছক বিভ্রম। লারকিনের দৃষ্টিতে প্রেম হল মানবজাতির সর্বোত্তম প্রতারণাগুলির মধ্যে একটি। যদিও মানুষ তার সহজাত বিশ্বাসে আঁকড়ে ধরে শুধুমাত্র প্রেমই তাকে সান্ত্বনা দেবে। সান্ত্বনা দেবে এবং টিকিয়ে রাখবে। লারকিন মনে করতেন এই ধরনের আশাকে অস্বীকার করতে হবে। প্রেমিকের প্রতিশ্রুতি একটি শূন্য প্রতিশ্রুতি। প্রেমের মাধ্যমে দুঃখকষ্ট নিরাময়ের শক্তি একটি দুঃখজনক বিভ্রম। তাই তাঁর কবিতা মরিয়া রকম স্পষ্ট এবং সংযত। সাধারণতম জ্ঞানেও আবিষ্ট। তাই লারকিন তাঁর কবিতায় অকপটে জীবনের অনেক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারেন। জীবনের ফাঁকিগুলোকে প্রকাশ করে দিতে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। যেন পাঠক তার জীবন ও মৃত্যুর বাস্তবতার সামনে নগ্ন কিন্তু সৎ আর অপেক্ষাকৃত কম প্রতারিত হয়ে দাঁড়াতে পারেন। লারকিন নিজেই তার কৃতিত্বের একটি রূঢ় বর্ণনা দিয়েছিলেন—যা এমন এক মূল্যায়ন, উচ্ছৃঙ্খলতা সত্ত্বেও, তাকে তাঁর কাজের সঙ্গে আবেগময় করে তোলে। ১৯৭৯ সালে অবজারভারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় অসুখীতা নিয়ে লেখাই আমার জনপ্রিয়তার উৎস। যদি কিছু থাকে আমার… ওয়ার্ডসওয়ার্থের জন্য যা ছিল ওই ড্যাফোডিল, আমার জন্য তা বিয়োগবেদনা।”

One shivers slightly, looking up there.

The hardness and the brightness and the plain

Far-reaching singleness of that wide stare

 

Is a reminder of the strength and pain

Of being young; that it can’t come again,

But is for others undiminished somewhere.

[Sad Steps]

এটা সত্যিই সত্য যে তাঁর অনেক পাঠকই লারকিনের কবিতার আপাত সহজবোধ্যতার জন্য এবং ছন্দ ও মাত্রার ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদী না হয়ে আশ্বাসদায়কভাবে ঐতিহ্যবাহী বলে মনে করা শ্লোক ফর্মের চর্চার জন্য আনন্দ খুঁজে পান। আগ্রহ খুঁজে পান। সিমাস হ্যানি একবার অবজারভারে লিখেছিলেন, “লারকিনের সেরা কাজের মধ্যে যা প্রশংসনীয় তা হচ্ছে তাঁর দৃঢ়তা এবং সূক্ষ্মতা; তাঁর সুনির্দিষ্ট ভূগোল। এবং ভাষা বলতে যা বোঝান তিনি, আর তা সঙ্গীতে যা মূর্ত করে তোলে তার মধ্যে এক পারস্পরিক শক্তিশালী সঙ্গতি।” তাঁর প্রথম জীবনের স্কুল বয়সের কবিতা এবং মৃত্যুর আগের শেষ দিকের কবিতাগুলোয় আমরা কিছুটা কবি অডেনের মতো শৈলী আর সমাজমনস্কতা দেখতে পাই। শিকাগো ট্রিবিউন বুকস-এ লিখতে গিয়ে অ্যালান শাপিরো উল্লেখ করেছেন, “সামগ্রিকভাবে পাঠ করলে আমরা দেখতে পাবো লারকিন তাঁর জীবনের প্রথম আর শেষের রচনায় দুর্দান্ত আর জটিল অনুভূতিময় এক কবি।” লারকিন তাঁর কবিতায় প্রাত্যহিক জীবনের সাধারণ বস্তু আর উপলক্ষগুলো শীতল কিন্তু মর্মস্পর্শী বর্ণনায় ছেঁকে তোলেন। পরিমাপ করে দ্যাখেন দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত ক্লান্তির গভীরতা। যাচাই করেন সমস্ত সংকীর্ণতার বোধ। তিনি আমাদের বহুর মুড ঠিকঠাক ধরে ফ্যালেন তাঁর কবিতায়। আমাদের সবচেয়ে বাজে রকম ভয়কেও প্রকাশের উপযুক্ত ভাষা খুঁজে পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। যে ভাষার স্বরটিকে বলা যায় একগুঁয়ে দেশজ। প্রাথমিকভাবে তাঁর রচনার আবেদন অনেকটাই ব্রিটিশ সংবেদনশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। এজন্যই হয়তো তাঁর কবিতার বই ইংল্যান্ডেই বেশী বিক্রি হয়। তাঁর পাঠক সর্ব স্তরের। আর তাই হয়তো ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৫ সালে অকাল মৃত্যুর পরও তাঁর পাঠকপ্রিয়তা কমে নি। আজও তিনি ইংল্যান্ডে সমানভাবে জনপ্রিয়। লারকিন ইংরেজদের সঙ্গে এমন একটি ভাষায় কথা বলেছেন যেন তারা ‘এই শতাব্দী যে তাদের গভীর আত্ম-সন্দেহ দিয়েছে’ তা সহজেই বুঝতে পারে। তিনি, সমস্ত ইংরেজ কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন, তাঁর জন্য সরকারী কোনও স্বীকৃতির প্রয়োজন ছিল না।

জীবনানন্দের হারিয়ে যাওয়া একটি সুটকেস আর পাওয়া না গেলেও, চুরি যাওয়া সেই সুটকেসের ডাইরির টুকরো কিছু কাগজ পরে পাওয়া গিয়েছিল ফুটপাতের এক খাবার বিক্রেতার কাছে। ঠিক তেমনি এক আজব ঘটনা ঘটেছিল ২০০২ সালে ইংল্যান্ডেও। লারকিনের অপ্রকাশিত কবিতার পুরো একটা নোট খাতা পাওয়া গিয়েছিল আবর্জনার স্তুপে। কবির প্রয়াণের প্রায় ১৭ বছর পর এমন একটা ঘটনা বিস্ময়ের জন্ম দেয় ইংরেজি কবিতার জগতে। কীভাবে ঘটতে পারে এই ঘটনা! যিনি খাতাটি খুঁজে পেয়েছিলেন, পরে তা বিক্রির জন্য অকশনে তোলেন। লারকিনের কবিতা সংগ্রহের ২০০৪ সালের সংকলনে এর কবিতাগুলো যুক্ত করা হয় অগ্রন্থিত কবিতা হিসেবে। ড্যানিয়েল টোর্ডে লিখেছিলেন, “কবির মৃত্যুর ২০ বছর পর এই নতুন পরিমার্জিত কবিতা সংগ্রহের সংকলনটি এসে আমাদের মনে করিয়ে দেয় লারকিন চার্লস বিউকোওস্কি কিংবা জ্যাক কেরুয়াকের চেয়েও অধিক ও কাছের জন-মানুষের কবি।” টোর্ডে আরও লিখেছিলেন, লারকিন “নিজেকে ছাড়া যে কোনও শ্রোতাকেই উপেক্ষা করতে পেরেছিলেন… সেই একগুঁয়ে, অনুভূতিশূন্য এবং এখনও অনিবার্যভাবেই প্রেমময় ও নীরস মানুষ তিনি… সবচেয়ে অপ্রীতিকর সময়েও নিজেকে উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা রাখেন।” তাই লারকিনের মৌলিকত্ব হয়তো সংযোগের মাধ্যম পরিবর্তনের ভেতর নয়, বরং  ভিন্ন কিছু সংযোগের মাধ্যমেই তিনি স্বকীয়।

 

ঋতো আহমেদ: কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

=======================