ধর্মীয় শাসন ব্যবস্থা বহুত্ববাদের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক
– মোঃ খালেকুজ্জামান
আশা করছি কুশলে আছেন। আপনার কী মনে হয়- ভালো থাকা, না- থাকা একটি রাজনৈতিক ঘটনা?
সন্দেহাতীতভাবেই ভাল থাকা, না-থাকা একটি রাজনৈতিক ঘটনা। রাজনীতিই একটি সমাজ এবং রাষ্ট্রের নির্ধারণী শক্তি। রাজনীতি এবং তার প্রভাব বলয়ের বাইরে কারো জীবন নয়, সেটি এমনকি যারা মনে করে যে তাঁরা রাজনীতিতে জড়িত নয় কিংবা রাজনীতি পছন্দ করেনা তাদের বেলায়ও সমানভাবে প্রযোজ্য। প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই সমাজে বসবাসরত কোন নির্দিষ্ট শ্রেণী, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ, এবং বিশ্বাসের মানুষের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে যায়। তাই একজন মানুষের ভাল থাকা না-থাকা অবশ্যই নির্ভর করে রাজনোইতিক ঘটনা প্রবাহের উপর।
২০২৪-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে আপনি কীভাবে দেখেন? প্রধান উপদেষ্টা্র কথিত “ম্যাটিকুলাসলি প্ল্যানড” সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন?
২০২৪ এর পটপরিবর্তন নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এই ঘটনাটি জনগণের শক্তির একটি মহড়া এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি রাজনৈতিক জাগরণ। প্রাথমিকভাবে স্বৈরাচার এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত এই পরিবর্তনকে আমি খুবই পজিটিভভাবে দেখেছি। অভ্যুত্থানের শীর্ষ নেতৃত্বে নিশ্চয় কিছু প্রস্তুতি ছিলো, কিন্তু শুধু “ম্যাটিকুলাসলি প্ল্যান্ড” করেই এই রকম একটি বড় অভ্যুত্থান ঘটানো সম্ভব নয়, এতে সর্বসাধারণের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহনও প্রয়োজন হয়। বিগত ১৬ বছরে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক দলও নিশ্চয় চেয়েছিল যে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হোক, কিন্তু সেটি তারা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছিল কারণ সর্বসাধারণের অংশগ্রহন সেখানে ছিলোনা যা ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে ছিলো।
জুলাই আন্দোলনের শুরুতে আপনার বিবেচনা কেমন ছিল?
আন্দোলনের শুরুতে একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিলো, কারণ আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বে ঠিক কারা আছে সেটি বোঝা যাচ্ছিলোনা। তাছাড়া, আন্দোলনের প্রাথমিক দাবি ছিলো কোটাপ্রথা বাতিল, যেটি ন্যায্য দাবী হলেও সরকার পতনের দাবী ছিলোনা। কিন্তু রংপুরে আবু সাঈদ এবং ঢাকায় মুগ্ধসহ অসংখ্য মানুষ শহীদ হওয়ার পর আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে। আন্দোলনকারীদের মিছিল থেকে ভিন্নমুখী শ্লোগান শোনা যাচ্ছিলো, যেমন একদিকে “মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় বৈষম্যের স্থান নেই”আবার অন্যদিকে “জাতির পিতা ইব্রাহিম, শেখ মুজিব ঘোড়ার ডিম”। তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আন্দোলনের চালিকা শক্তির অভিমুখ এক নয়।
৫ই আগস্টের রাজনৈতিক রদবদলের পর আপনার ভাবনা, কী দুর্ভাবনা কোন বিষয়ে আবর্তিত হচ্ছিল?
৫ই আগস্টের রাজনৈতিক পালাবদল সারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতোই আমাকেও ব্যাপকভাবে আশান্বিত করেছিলো। এই ঘটনাটি “প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করা”র প্রতীক হিসাবেই আমার কাছে অনুভূত হয়েছিলো। শেখ হাসিনা এবং তার সমর্থকদের যে দৌর্দন্ড প্রতাপ, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং দম্ভ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে তাতে প্রাথমিকভাবে আমার মনে হয়নি যে আন্দোলন করে তাঁর পতন সম্ভব।
অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারীদের যেহেতু দৃশ্যমান কোন পূর্ব পরিচয় ছিলোনা তাই আমার ভাবনায় ভবিষ্যত বিষয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ঝেঁকে বসেছিলো। আন্দোলনের নেতৃত্বের একাংশ ছিলো প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছাত্র-জনতা, আবার একটি বৃহত অংশই ছিলো মৌলবাদি তৌহিদি জনতা। অন্যদিকে, প্রথাগত আওয়ামী লীগ বিরোধী মধ্যপন্থিরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো। তাই শেষ পর্যন্ত কোন ঘরাণার শক্তি আন্দোলনের চালকের সীটে স্থান করে নেবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে তা ধুঁয়াসাচ্ছন্নই ছিলো। প্রধান উপদেষ্টাসহ বেশ কয়েকজন উপদেষ্টাই যেহেতু সমাজে অধিকার কর্মী, পরিবেশবাদী, এবং বিভিন্ন বে-সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ছিলো তাই সুনির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত হয়ে দেশ চালানোর বদলে বরং এনজিওর কর্পোরেট কালচারে দেশ চলবে বলে প্রাথমিভাবে ধারণা হচ্ছিলো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অন্তর্বতী সরকারের পিছনের চালিকা শক্তি এবং রাজনৈতিক আদর্শের জায়গাটি দৃশ্যমান হতে শুরু করে। একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় উগ্রবাদীদের আস্ফালন সমাজের সর্বস্তরে দৃশ্যমান হতে শুরু করে।
জুলাই অভ্যুত্থানকে আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নিরিখে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
বায়ান্ন, উনসত্তর, এবং একাত্তরের গৌরবগাঁথা বাংলাদেশের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার ভিত্তি এবং পাটাতন গড়ে দিয়েছে, যার আদর্শ এবং মূল্যবোধই হবে সমস্ত প্রকার নিপীড়ন, শোষণ, এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের দিক-নির্দেশনাদানকারী জাতীয় ইস্তেহার ও শক্তির উৎস। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে জুলাই অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শেরই একটি বর্ধিত রাজনৈতিক ঘটনা বলে আমি বিবেচনা করি। মুক্তিযুদ্ধই আমাদেরকে সমস্ত অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে একটি সাম্য, বৈষম্যহীন, মানবিক মর্যাদাপূর্ণ, এবং ন্যায় বিচার-ভিত্তিক একটি সমাজ গড়ার শিক্ষা দেয়। ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান একাত্তরের মুক্তির সংগ্রামেরই একটি সর্বশেষ অধ্যায় বলে আমি বিশ্বাস করি।
এতো রক্তপাতের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট শক্তির পতন হলো। মানুষ আশাবাদী হলো। প্রধান উপদেষ্টার বলা “রিসেট বাটন চেপে দিয়েছি” প্রচারিত হবার পর থেকে দেশে ব্যাপকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য, স্থাপনা, স্মৃতিস্তম্ভ ধ্বংস করা হলো। মুক্তিযোদ্ধার কবরে আগুন দেয়া হলো। এসব ঘটনাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
“রিসেট বাটন চেপে দিয়েছি”র ঘটনাটি পুরো আন্দোলনের গতিমুখ পরিবর্তনের একটি মাইলস্টোন বলে আমার মনে হয়। কারণ এই কথাটির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের অতীতের সমস্ত ত্যাগ-সংগ্রাম-অর্জনকে অবজ্ঞাভরে বাতিল করে দিয়ে একটি নতুন যুগের সুচনার কথা বলা হয়। এর মাধ্যমে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২.০ এবং নতুন স্বাধীনতার কথা বলা হয়। এই নতুন বাংলাদেশে অতীতের আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবময় ইতিহাস থেকে নিজেরদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ঘোষণা দেওয়া হয়। অতীতকে পরিত্যাগ করেই থেমে থাকে নাই, নতুন সরকারের পিছনে থাকা শক্তি বরং অতীতের অর্জনকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার কাজে ব্রতী হয়। ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত ভাস্কর্য, স্থাপনা, এবং স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার এক বিধ্বংসী খেলায় একটি গোষ্ঠি মত্ত হয়। ইতিহাস-ঐতিহ্য বিধ্বংসী কাজগুলি ঘটেছে সরকারের চোখের সামনে, তাই এর দায়ভার তাদেরকেও নিতে হবে। এসব ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার এক নগ্ন প্রয়াস।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনীতির মাঠে একটা বল ক্রিয়াশীল আছে-সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, এরা কট্টর ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী- যারা বলছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ছাড়া গণতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হতে পারে না। এই বয়ানকে আপনি কীভাবে দেখেন?
কোন একটি ধর্মের মূল্যবোধ অন্য সব ধর্মের মানুষের কাছে সার্বিকভাবে অগ্রহনযোগ্য। সেটি না হলে যেকোন দেশে কিংবা সমাজে একটিই ধর্ম বিদ্যমান থাকতো। সেই অর্থে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের মূল্যবোধই একটি দেশের সমস্ত জনগণের জন্য ন্যায্যতা, সমতা এবং বৈষম্যহীন সমতল তৈরি করতে পা্রেনা। গণতান্ত্রিক সমাজের মূল ভিত্তিই হচ্ছে সব মানুষের জন্য সমান নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কোন একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা একটি রাষ্ট্রের কাজ হতে পারেনা, কারণ রাষ্ট্রের চোখে সব নাগরিকের অধিকার সমান। রাষ্ট্রের ধর্ম থাকতে পারেনা। রাষ্টকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন না করে সব নাগরিকের জন্য সামাজিক ন্যায় বিচার, মানবিক মর্যাদা এবং সমতা কখনোই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
ইসলাম একত্ববাদী। ইসলামিস্ট দলগুলোর বহুত্ববাদের শ্লোগানকে আপনি কিভাবে দেখেন?
এইটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল বলেই আমার মনে হয়। ইসলামিস্ট দলগুলো নিজস্ব সাংগঠনিক কাঠামো দেখলেই সেটি বুঝা যায়। সেইসব দলে শীর্ষ নেতৃত্বে অন্য ধর্মের কোন মানুষের স্থান নেই, এমনকি নারীদের স্থানও নেই। রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীদের শীর্ষস্থানে থাকা তারা বিধিসম্মত মনে করেনা। বহুত্ববাদ হচ্ছে একটি আধুনিক সেকুলার ধারণা, তাই রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে ইসলামিস্ট দলগুলো নারী নেতৃত্বের অধীনে কিংবা অন্য ধর্মাবলম্বীদের নেতৃত্বের আওতাধীন কোন রাজনৈতিক জোটে কৌশলগত কারণে যোগ দিলেও নিজেরা কখনোই বহুত্ববাদ কিংবা জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা ব্রতী হবেন না, কারণ এটি তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের পরিপন্থি। সমাজের একটি ধর্মীয় গোষ্ঠির নেতৃত্বে পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা বহুত্ববাদের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক।
বাংলাদেশকে দ্বিতীয় রিপাবলিক হিসাবে দেখতে আপনি আগ্রহী, নাকি আতঙ্কিত?
বাংলাদেশ বিরতীহীনভাবে মানুষের নাগরিক অধিকার এবং জীবনমানের উন্নতি সাধনে ব্রতী হবে এটাই আমার চাওয়া। অতীতের ব্যর্থতা এবং সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে প্রগতির পথে দেশ ধাবমান থাকুক সেইটিই আমি চাই। বাংলাদেশের সংবিধান, আইন এবং রাষ্ট্র কাঠামোতে অনেক একনায়কতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী উপাদান রয়েছে। সেইগুলি দূর করার জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন যাতে করে পুরোনো বন্দোবস্থ এবং ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা আর ফিরে আসতে না পারে। রাষ্ট্রের মালিকানা যেন সত্যিই জনগণের হাতে থাকে। সরকার এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা যেন নিশ্চিত হয় সেই লক্ষ্যে রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করে একটি জনগণতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠা করাই গণঅভ্যুত্থানের অভিষ্ট ছিলো। সেই ধারায় রাষ্ট্র সংস্কারকে দ্বিতীয় রিপাব্লিক বললে আমার আপত্তি নেই।
দেশের বর্তমান নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে মানুষ শঙ্কিত, সন্ত্রস্ত। এমন বাস্তবতায় সামগ্রিকভাবে আপনি কেমন বাঙলাদেশ দেখতে চান?
নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কোনভাবেই কাম্য নয়। আইনের শাসন এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে বিভিন্ন মতাদর্শের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র দেশে বিদ্যমান থাকবে সেইটিই আমার প্রথম চাওয়া। তাছাড়া, মানুষের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে জনকল্যাণকর অর্থনৈতিক নীতিমালার বাস্তবায়ন করে নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্যে বলিয়ান হয়ে, জ্ঞান-বিজ্ঞান ভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক, গনতান্ত্রিক এবং বৈশ্বিক পরিসরে সন্মানের আসনে অধিষ্ঠিত একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এটাই আমি দেখতে চাই।
********************************
মোঃ খালেকুজ্জামান
ভূতত্ত্ববিদ ও বৈশ্বিক সমন্বয়কারী, বেন
********************************