You are currently viewing জোনাকি জ্বলে || রিমি রুম্মান

জোনাকি জ্বলে || রিমি রুম্মান

জোনাকি জ্বলে || রিমি রুম্মান

নিউইয়র্কের বাড়িতে বারান্দা কমই দেখা যায়। বাড়িটি কেনার সময় এক চিলতে বারান্দা আর সামনে বিশাল লন দেখেই মনঃস্থির করে ফেলেছিলাম যে, এ বাড়িটিই কেনার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। সে-ও গত শতকের নয়ের দশকের শেষদিকের কথা। তারপর মেঘে মেঘে অনেক বেলা হলো। পরিবার বড় হলো। বড় বাড়ি কেনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো। কিন্তু এই বারান্দা-প্রীতির জন্যে বাড়িটি ছেড়ে কোথাও যাওয়া হলো না।

সন্তানরা বেড়ে উঠল। নিজেদের মতো করে জীবন গুছিয়ে নিলো। আমরা পাঁচ সদস্যের পরিবার আবার দুইজনে রূপান্তরিত হলাম। হুলুস্থুল ব্যস্ততা কমেছে। অবসর বেড়েছে। বিকেলটা বারান্দার ইজি চেয়ারে বসেই কাটে ধুমায়িত কফির কাপে চুমুক দিয়ে। সামনে সবুজ ঘাসের মনোরম লন। বারান্দা-লাগোয়া বিশাল ম্যাগনোলিয়া, চেরি ফুলের গাছ ও গোলাপ সহ নানান গাছের সমারোহ। এখানে বসলে এক এক ঋতুতে প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য চোখে আরাম দেয়। গ্রীষ্ম-বর্ষায় কেবল সবুজ। ঘন সবুজ, টিয়ের সবুজ। শরৎ-হেমন্তে হলদে কমলাভ, খয়েরি পাতায় পরিবেশটাই রঙিন হয়ে ওঠে। শীতে পত্রপল্লবহীন খড়খড়ে কঙ্কালসার গাছ তুলার মতো শুভ্র তুষারে ঢেকে থাকে। আর বসন্তে গোলাপী ম্যাগনোলিয়া, গোলাপী চেরি-তে চারপাশটা গোলাপী সুন্দরী হয়ে ওঠে। এখানে বসে সুনীল আকাশের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে সন্ধ্যা নামে, রাত্রি ঘনায়, টের পাওয়া যায় না। রাত্রির ঘন অন্ধকারে তাকিয়ে থাকলে বিচ্ছন্নভাবে জোনাকির জ্বলে ওঠা আলো দেখতে পাওয়া যায়। ইদানিং অন্ধকারে শূন্যে জ্বলে ওঠা জোনাকির মতোই জ্বলে ওঠে কতগুলো মুখ। আলমগীর, খুকি, রোকেয়া, হাজেরা, রহিমা। যেন অন্ধকারে এরা সকলে বসে আছে আমার মুখোমুখি। জোনাকির আলো জ্বলে উঠলেই এক একটি অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেউ কী টর্চের বাতি ফেলছে তাদের মুখে? নইলে কেনোইবা এক একটি মুখ দপ করে জ্বলে উঠে ছায়া ফেলে যায় মনের গহীনে? জানি মুখগুলো সব নেই আজ আর। কেউ কেউ আছে হয়ত। থাকলেও কোথায় কেমন আছে জানা নেই।

‘ছোট্টফা, আমি লটারি পাইলে আম্নেরে কিছু ট্যাকা দিমু।‘
-তুই লটারি কিনেছিস? টাকা পেলি কোথায়?
-ওইদিন মেহমান আইছিল যে, হ্যারা দিয়া গ্যাছে।

এক বিষণ্ণ বিকেলে সমস্ত পৃথিবী বিশ্রাম নেয়ার সময় আলমগীরের কথায় আমার ঘুম ঘুম জড়তা ঝেড়ে ফেলে উঠে বসি।

আলমগীরকে যখন ওর বাবা ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচীর মতো করে আমাদের বাসায় দিয়ে যায়, তখনও ওঁর দুধদাঁত পড়েনি। ভালোমন্দ দুটো খেয়ে-পরে বাঁচে থাকার আশা ছাড়া অন্য কোনো বিনিময় চায়নি। বাবা-মা, ভাইবোন ও ভিটে ছেড়ে অচেনা শহরে থেকে যেতে ওঁর কেমন অনুভূতি হয়েছিল, সেটা প্রকাশ করার বা বোঝার বয়সও হয়ে ওঠেনি হয়ত। তবে পিতৃ-বিদায়ের সময় চোখ দুটি ছলছল জলে ভরে উঠেছিল। সে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেয়নি। কিংবা বাবার সঙ্গে গাঁয়ে ফিরে যাওয়ার গোঁ ধরেনি। দরজার আড়ালে বিরস বদনে দাঁড়িয়ে ছিল কেবল।

দুধদাঁতওয়ালা আলমগীর গোলগাল চেহারা আর ডাগর চোখের শিশু। গায়ের রঙ শ্যামলা। পরনে ছেঁড়া হাফপ্যান্ট, ময়লা হাতকাটা গেঞ্জি। এতটুকুন বাচ্চা ছেলে কী কাজ করবে, আব্বা চিন্তায় পড়ে গেলেন। ওঁকে রাখবে, নাকি ফিরিয়ে দেবে এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচলের ভর দুপুরে আম্মা অফিস থেকে ফিরলেন। আম্মা সরকারী চাকুরী করেন। সংসারে একজন সাহায্যকারী প্রয়োজন ছিল। আম্মার কষ্ট লাঘবে এগিয়ে এসেছে বড় খালা। গাঁয়ে বাস করা বড় খালার ফুট-ফরমায়েশ খাটে আলমগীরের মা। তাঁর অনুরোধেই আলমগীরকে শহরে পাঠিয়েছেন বড় খালা। বড় কাজ, যেমন ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, হাঁড়িপাতিল মাজার জন্যে তো ছুটা বুয়া চিনির মা-ই আছেন। এতটুকুন ছেলেটিকে দেখে আম্মা বিস্মিত হলেন না। বললেন, ‘ও থাকুক, কাজ পারুক আর না-পারুক।‘
-‘বাপটা যদি ঠিকভাবে কাজ কর্ম করত, তাহলে এই মাসুম বাচ্চাটাকে মায়ের কোল-হারা হতে হত না।‘
কথাগুলো আব্বার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন আম্মা।
আলমগীরের আগে ‘খুকি’ ছিল এ বাড়িতে। বছর তিনেক কাজ করেছিল। শহুরে বাতাস আর সাবান, শ্যাম্পু, তেলের নিয়মিত ব্যবহারে খুকির ময়লা গায়ের রঙ পরিস্কার হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। বাড়িতে আগত অতিথিদের অনেকেই ধারণা করত খুকি বোধ হয় আমাদেরই বোন। ততদিনে ছোট্ট খুকি ডাঙর হয়ে উঠেছিল। নভেম্বরে শীতের এক সকালে বিনা নোটিশে খুকির বাপ এসে হাজির হয়েছিল।
-খুকিরে নিয়া যাইতে আইছি।
কথাটি বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন আম্মাকে থমকে দিয়েছিল।
-ওঁর স্কুলের কী হবে? তাছাড়া সামনের মাসে তো বার্ষিক পরীক্ষা।
আম্মার চিন্তিত-কণ্ঠ নিঃসৃত এমন আকুতিতে খুকির বাবার কোনো ভাবান্তর হল না। তিনি খুকিকে নিয়ে যেতে এক রকম মনঃস্থির করেই এসেছেন। কন্যার লেখাপড়া নিয়ে তাঁর অবশ্য বিশেষ আগ্রহ নেই।
-পরের ঘরে চইল্যা যাইব, লেহাপড়া শিইখ্যা কী অইব। আগে অনটন আছিল। এহন নাই। আয় রোজগার ভালাই।
দন্ত বিকশিত হাসিতে কথাগুলো একটানা বলে গিয়েছিল খুকির বাপ।
-যার সন্তান সে ফেরত নিতে এসেছে। এখানে আর কারো কিছু বলার থাকে না।
আম্মাকে এত আদিখ্যেতার জন্যে মৃদু তিরস্কারের স্বরে কথাগুলো বলেছিলেন আব্বা। খুকি চলে গিয়েছিল কেননা, তার পরিবারে সুদিন ফিরেছিল। ওর বাবা জুয়ার আসরে যাওয়া বন্ধ করেনি যদিও, কিন্তু ওর মা অর্থ আয়ের এক অভিনব পথ খুঁজে পেয়েছিল। গাঁয়ের মানুষদের তাবিজ, পানি-পড়া, ঝাড়ফুঁক করে রোগের উপশমের দাবি করছিল। গাঁয়ের অক্ষরজ্ঞানহীন সহজ-সরল মানুষেরা তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। তাঁরা আসত দূরদূরান্ত থেকে পানি-পড়া নিতে। বিনিময়ে খুকিদের পরিবার সচ্ছলতার মুখ দেখতে শুরু করেছিল। হু হু করে শীত ঢোকা বেড়ার ঘর টিনের ঘরে রূপান্তরিত হয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতে খুকির আর অন্যের বাড়িতে কাজ করার কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। তবে খুকি চলে যাবার পর অনেকগুলো দিন আমাদের মনে ছায়া ফেলে রেখেছিল।

ঠিক একইভাবে আলমগীরের জন্যেও মায়া পড়ে গেল আম্মার। তবে কোনো এক বিচিত্র কারণে কঠিন হৃদয়ের আব্বাও আলমগীরকে ভালোবেসে ফেললেন। অফিস-ফেরত আম্মা সেইদিনই শহরের কালীবাড়ি মার্কেটে গিয়ে বেশ কিছু কেনাকাটা করলেন। আলমগীরের জন্যে নতুন শার্ট, গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট ইত্যাদি। সাবান দিয়ে ডলে গোসল করালেন। নতুন জামাকাপড় পরানো হলো। তাঁকে দেখতে সত্যিই শহুরে বাবুর মতো লেগেছিল।

পরদিন ভোরে হৈচৈ এর আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘরময় পেচ্ছাবের গন্ধ। আলমগীর ঘুমের মাঝে রাতের কোনো এক সময়ে কাঁথা ভিজিয়ে ফেলেছে।
-এই জন্যেই কি তুই খাটে ঘুমাতে চাস নি? মেঝেতে ঘুমাতে চেয়েছিলি? বললেই হত তোর ঘুমের মধ্যে পেচ্ছাবের বাতিক আছে।
আম্মার এমন রাগত স্বরে আলমগীর রীতিমত লজ্জা পেল। কোনো কথা বলল না। ছলছল চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল অপরাধী মুখ করে।

সে ভাত খায় বড়দের মতো নুন দিয়ে। আমরা পাঁচ সদস্যের পরিবার খেতে বসি ডায়নিং টেবিলে। আলমগীর বসে রান্না-ঘরে পিঁড়িতে। হাঁটু ভেঙে দুই পায়ের মাঝখানে মেঝেতে থালা রেখে বড় বড় লোকমা দিয়ে খায়। মগ ভর্তি পানি গিলে। ভাতের থালায় আবারও ভাত নেয় পাহাড়ের মতো উঁচু করে। মুখ ভর্তি ভাত চিবোতে চিবোতে বলে ওঠে, ‘খালুজি ইট্টু নুন দ্যান ছে।‘ আব্বা টেবিল থেকে লবন-দানি বাড়িয়ে দেয়। খাবার শেষে সে পরম তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে ঢোল হয়ে থাকা পেট নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আম্মা টেবিল গোছায়। আলমগীর গোছানো টেবিলের ওপর উঠে বসে। ভেজা তেনা দিয়ে ঘর মোছার মতো করে উপুড় হয়ে টেবিল মোছে। মেঝেতে দাঁড়িয়ে টেবিল মোছার জন্যে যথেষ্ট বড় হয়ে ওঠেনি যে। ছোট ছোট হাত সে অব্দি নাগাল পায় না।

রোজ রাতে আম্মা তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার সময় আলমগীরকে ডেকে তোলে।
-আলমগীর, যা পেচ্ছাব করে আয়।
সে ঢুলুঢুলু চোখ কচলাতে কচলাতে টয়লেটে যায়। ফিরে এসে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। তবুও মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ভোরের দিকে নিজেই ভেজা কাঁথা ছাদে শুকাতে দিয়ে মসজিদে যায়। পাড়ার অন্য শিশুদের সঙ্গে আলিফ, বা তা শা শেখে। ফিরে এসে নাস্তা খেয়ে টুকটাক হাতের কাজ সেরেই তৈরি হয়ে নেয়। আম্মার সঙ্গে বেরিয়ে যায়। রিকশায় চেপে বসে। এক হাতে বইখাতা বুকে চেপে ধরে, অন্যহাতে রিকশার শিক ধরে। আম্মা অফিসে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে আলমগীরকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যায়। তাঁকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়েছে। অসংখ্য সহপাঠী, বন্ধু জুটেছে তাঁর। সে আর বাড়ির কথা বলে না। বাপ-মা, ভাইবোনের কথা বলে না। গাঁয়ের জন্যে মন খারাপ করে না। কিংবা পরিবারের কাছে ফিরে যাবার আবদার করে না।

দিন কয়েক যেতেই টের পাওয়া গেল, আলমগীর আসলে শান্ত বাচ্চাটি নয়। বড্ড চঞ্চল, দুরন্ত প্রকৃতির। একদণ্ড স্থির থাকতে পারে না। জগতের তাবৎ কিছুই যেন তাঁর নখাগ্রে। কিন্তু এতে আম্মার তীব্র মন খারাপ হয়। কেননা, স্কুল থেকে উপর্যুপরি অভিযোগ আসতে থাকে। সে আজ একে ঘুষি মারে তো কাল ওকে চিৎপটাং করে, পরশু আরেক সহপাঠীকে শার্টের কলার চেপে ধরে। টিফিনের সময়ে স্কুলের বেঞ্চি একাই টেনে মেঝেতে ফেলে উপুর করে রাখে। নিত্য অভিযোগে আম্মা দিশেহারা। বছর না ঘুরতেই স্কুল কর্তৃপক্ষ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্টের অভিযোগে আলমগীরকে রাখতে অস্বীকৃতি জানায়। অগত্যা নিরুপায় হয়ে ঘরেই তাঁর শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। সন্ধ্যার পর আম্মা আমাদের পাশাপাশি তাঁকেও পড়াতে বসে। আলমগীর মেঝেতে বসে উচ্চস্বরে পড়ে স্বরে-অ, স্বরে-আ, অ তে অজগর, আ তে আম …।

কোনও কোনও দিন সন্ধ্যার পর প্রতিবেশি খালাম্মারা দলবেঁধে বিনা নোটিশে বেড়াতে এলে আলমগীর ছুটি পায়। খালাম্মাদের সঙ্গে গল্প করার এক ফাঁকে আম্মা ভেতরের রুমে এসে আলমগীরের হাতে অর্থ গুঁজে দেন। মোড়ের হোটেল থেকে শিঙাড়া, সমুচা, ডালপুরি আনতে পাঠায়। একটা সময় গল্প শেষ হয়, প্রতিবেশি খালাম্মাদের বিদায়ের সময় ঘনায়। কিন্তু আলমগীর শিঙাড়া, সমুচা নিয়ে ফিরে আসে না। আম্মা ভেতরের রুমে আসেন। আলমগীরের ফিরে না আসায় অস্থির হয়ে ওঠেন। আমরা দোতলার বারান্দার কোণায় দাঁড়িয়ে জিরাফের মতো গলা উঁচিয়ে মোড়ের দোকানের দিকে চোখ পেতে রাখি। অপেক্ষার প্রহর ফুরায় না। এদিকে রাত বাড়ে। খালাম্মারা উঠি উঠি করে। তবু আম্মা বলেন,
-আরেকটু বসেন, ভাবী। কী আর এমন রাত হয়েছে।
অবশেষে কাগজের ঠোঙা হাতে আলমগীর হেলেদুলে ফিরে আসে। তাঁর মাঝে কোনও ভাবান্তর পরিলক্ষিত হয় না। আমরা ছোঁ মেরে ঠোঙাটি নেই। তড়িঘড়ি করে তা প্লেটে সাজিয়ে ট্রে নিয়ে হাসিমুখে ড্রয়িং রুমে যাই। খাবার পরিবেশন করি। যেন বিরাট এক সম্মানহানি থেকে এ যাত্রায় বাঁচা গেল।

কখনো আচমকা নুন ফুরিয়ে গেলে, কিংবা পেঁয়াজ, আলমগীরকে নিকটস্থ দোকানে পাঠানো হলে সেইদিন সে ফিরে না আসা অব্দি রান্না বন্ধ রাখতে হয়। আলমগীর নুন আনতে গিয়ে রেললাইনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে চলন্ত ট্রেন দেখবে বলে। সে অপেক্ষায় থাকে। দীর্ঘ অপেক্ষা। যেন ট্রেনের জন্যে অপেক্ষার মাঝে এক জনমের আনন্দ। আলমগীর রেল লাইনে উপুড় হয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে দূর-বহুদূর থেকে ট্রেন আসার সংকেত পাওয়া যায় কিনা। অবশেষে কুউ ঝিক ঝিক শব্দে ছুটে আসে ট্রেন। এক ঝলক ঝোড়ো হাওয়ায় ধুলো উড়িয়ে অতিক্রম করে যায় ট্রেন। আলমগীরের চুল ওড়ে। চোখ বুজে আসে দমকা হাওয়ায়। সে ছুটন্ত ট্রেনের পিছু পিছু ছোটে। কিছুদূর দৌড়ে বড় বড় শ্বাসপ্রশ্বাস আর বুকের ওঠানামা নিয়ে ফিরে আসে। যেমনটি এই উত্তরের দেশে হেমন্তের ঝরাপাতারা ছুটন্ত গাড়ির চাকার সাথে কিছুদূর ছুটে গিয়ে মুখ থুবড়ে পাক খেতে থাকে পিচঢালা সড়কে, ঠিক তেমন।

কোনও কোনও দিন সে পাশের ‘ছায়াবানী’ সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। তন্ময় হয়ে দেয়ালের পোষ্টার দেখে। শাবানা-জসিম, রাজ্জাক-কবরির ছবি। পোস্টারের দিকে তাকিয়ে তাঁরও হয়ত নায়ক জসিমের মতো মার-মার কাটকাট জীবনের স্বপ্ন জাগে। কিংবা একদিন হিরো হয়ে নাচে-গানে ভরপুর স্বপ্নিল জীবন হবে তাঁর, ভাবে। কে জানে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। সন্ধ্যায় গুটিসুটি পায়ে ফিরে আসে ঘরে। তারপর একাকি দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে ঢিসুম ঢিসুম ঘুষি ছুঁড়ে মারে শূন্যে। যেন অব্যর্থ লক্ষ্য। নিজের ভেতরে এক স্বপ্নের জগৎ তৈরি করে রাখে সে।
‘কী করছিস রে?’ জিজ্ঞেস করলে সে বাক্যহীন তাকিয়ে রয়। সেই দৃষ্টির গভীরতা বলে দেয় সেখানে ভেসে বেড়ানো অগণ্য স্বপ্নের কথা।

শরতের এক নিঝুম দুপুরে নিস্তব্ধতার বুক চিরে শহর জুড়ে মাইকিং-এর আওয়াজ ভেসে আসে। রিক্সার টুংটাং শব্দের মাঝে সন্ধানী নামের সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ঘোষক বিরামহীন বলে চলছে, ‘প্রিয় ভাই ও বোনেরা, লটারি, লটারি, লটারি…। দশ টাকা দিয়ে জিতে নিন দশ লক্ষ টাকা …।‘ আলমগীর দুপুরের খাবার শেষে সিমেন্টের শীতল মেঝেতে শুয়ে ছিল। হুড়মুড় করে উঠে বসে। দৌড়ে বারান্দায় যায়। পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর করে উঁচু হয়ে রেলিং ধরে নিচে দেখার চেষ্টা করে। তারপর দৌড়ে আম্মার কাছে সঞ্চিত রাখা দশ টাকা চেয়ে নেয়। ভোঁ দৌড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। ধীর গতিতে চলমান রিকশার ঘোষকের কাছ থেকে একটি টিকেট কিনে নেয়। বিজয়ীর উচ্ছ্বাসে ফিরে আসে। তাঁকে এত উত্তেজিত, উচ্ছ্বসিত আগে কখনো দেখিনি। সে যেন শূন্যে ভাসছে, মর্ত্যের কেউ নয়।

‘খালুজি, লটারি জিতলে আম্নেরে অর্ধেক টেকা দিয়া দিমু।‘
সন্ধ্যায় টেলিভিশনে মনোযোগ দিয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতা শোনা আব্বার পা টিপে দিতে দিতে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলে ওঠে আলমগীর। ভলিওম কমিয়ে আব্বা কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বলে,
-ক্যান, পুরাটা দিবি না?
আলমগীর ঘন-কালো পাপড়ির চোখ দুটো নামিয়ে নেয়। কিঞ্চিৎ লজ্জিত হয়ে বলে, ‘দিয়াম খালুজি, আম্নের লাগলে সব লইয়া যাইয়েন।‘
আব্বা আবারও টেলিভিশনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে আলমগীরের দিকে তাকায় আনন্দ খেলে যাওয়া অনুভবে। তাঁরা দুইজনই বিশ্বাস করেছিল যে, দশ লক্ষ টাকার লটারি নিশ্চিতভাবেই জিততে যাচ্ছে। পরবর্তী দিন কয়েক আলমগীর যেন অচিন কোনও এক পাখির ডানায় ভর করে উড়েছিল।

রাতে ঘুমের আগে বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিলাম। এটি আমার পুরনো অভ্যাস। ঘুমে চোখ লেগে এলেই বইটি শিয়রে রেখে ঘুমিয়ে পড়ব।

‘ছোট্টফা, আম্নেরে যে ট্যাকা দিমু, হেই ট্যাকা দিয়া কী করবেন? বই কিনবেন? আম্নের ত আবার খালি বই কিননের নেশা।‘
আলমগীর লাল রঙের শীতল মেঝেতে শুয়ে ঘাড় তুলে প্রশ্ন করে আমায়।
‘তুই একটু চুপ করবি?’
সস্নেহে ধমকের স্বরে বলি আমি। সে অর্থহীন কথা বলা থেকে বিরত থাকে না। বইয়ের মনোযোগ উধাও হয়ে যায়। বলি, ‘তোর বাপ-মা’কে দিস। আমার লাগবে না।‘
এই সাড়ে তিন বছরে আলমগীর অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছে। তাঁর দুধদাঁত পড়েছে। নতুন দাঁত গজিয়েছে। একবারও বাবা-মা’র কথা বলে না। সে কি তাদের ভুলে গেছে? নাকি তাঁর শিশুমন দু’বেলা পেট ভরে খেতে পায়, আদর-স্নেহে থাকে বলে এ জীবনই ভালোবেসে ফেলেছে? কিন্তু তাঁর বাবা-মা? তাঁরাও তো খোঁজ নিচ্ছে না। মাসিক মাইনেও নিতে আসছে না! নাকি আলমগীরকে বিদেয় করে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে, কে জানে! আমি শিয়রে বই রেখে বাতি নেভানোর আগে একবার বিছানা থেকে উপুড় হয়ে মেঝের দিকে তাকাই। ততক্ষণে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমন্ত মুখ জুড়ে এক চিলতে হাসি লেগে আছে তখনো। তাঁর কল্পনায়, স্বপ্নে রঙধনুর বিবিধ রঙ ছড়িয়ে পড়েছে হয়ত।

আলমগীরের বয়স তখন বারো ছুঁই ছুঁই। বাইরে সেদিন উদাস অপরাহ্ণ বেলা। মোড়ের দোকান থেকে সদাই আনতে পাঠিয়েছিল আম্মা। ভাংতি না থাকায় বড় নোট দিয়েছিল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। রাত্রি ঘনায়। শহরের ল্যাম্পপোস্টের সব কমলা বাতি জ্বলে ওঠে। আলমগীর ফিরে আসে না। রাত বাড়ে। আমরা সকলে অন্তহীন উদ্বেগ, আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত পার করি। রাত্রি তখন ভোরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। চারপাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মাঝে পুব আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল শুকতারা। সহসাই কাকের ঝাঁক কলরব করে ওঠে। মফঃস্বল শহরের ঘুম ভাঙে। লালে লাল হয়ে ওঠা পূর্বাকাশ থেকে কোমল এক আঁচ এসে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত চরাচরে। আলমগীর ফিরে আসে না। দিনভর কতখানে খোঁজা হল। কেউ বলল, তাকে ট্রেন স্টেশনে দেখেছে। কেউ বলল লঞ্চঘাটে। জটিল এই পৃথিবীর যুদ্ধক্ষেত্রের রূপ জানে না যে বালক, সে কোথায় যাবে একাকি? সে কি স্বপ্নের খোঁজে কোনও বড় শহরে তরী ভিড়িয়েছে? নাকি ট্রেনের পিছু ছুটতে ছুটতে ট্রেনেই চড়ে বসেছে? সে কি সিনেমার পোষ্টার দেখে দেখে নায়ক হওয়ার বাসনা নিয়ে রাজধানী পাড়ি জমিয়েছে? এই সকল বাসনা তাঁকে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় কোথায় টেনে নিয়ে গেল? তাঁর অপরাধ তো ক্ষমার্হ ছিল। কেনো সে ফিরে এলো না? এমন অগণন প্রশ্ন বয়ে বেড়িয়েছি দীর্ঘদিন আমরা।

একদিন সব প্রশ্নের উত্তর মেলে। দুই দশক বাদে। জানা গেল সে সদরঘাটে এক ভাতের হোটেলে বয়ের কাজ করে। আমি বিদেশ থেকে দেশে বেড়াতে গিয়েছি জেনে দেখা করতে এসেছিল। দুধদাঁতের আলমগীর ফিরে এসেছিল অন্য এক মানুষ হয়ে।

‘ছোট্টফা, আম্নের লগে দেহা করতে আইছি।‘
বুকের ভেতর ঝপাৎ করে চাবুক মারার মতো করে চমকে উঠি। পেছনে ফিরি। সিঁড়ির ধারে দাঁড়িয়ে আছে এক হৃষ্টপুষ্ট যুবক। সবুজ সোয়েটারের ওপর গলায় হাল্কা বেগুনী মাফলার ঝোলানো। মুখ জুড়ে পশ্চিমের অস্তগামী সূর্যের কোমল আলো। মুখে ম্লান হাসি। দেশে একমাসের ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসার ঠিক আগেদিন বিকেলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যুবক আত্ম-পরিচয় দিলো,
‘ছোট্টফা, আমি আলমগীর’।
আমার আড়ষ্ট মুখ অস্ফুটে উচ্চারণ করে ‘আআলমগীরর …’। জলের সঙ্গে বৈঠার রসায়নে যে ছলাত ছলাত শব্দ হয়, ঠিক তেমন।

আরও অনেক কথা। পা ছুঁয়ে সালাম করে বিদায় নিয়ে আলমগীর চলে গিয়েছিল। আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তাঁর চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে ছিলাম। জনমানুষের কোলাহলের ভিড়ে ভেসে গিয়েছিল সে। যেন স্রোতস্বিনী নদীর স্রোতে ভেসে চলেছে সবুজ কচুরিপানার ওপর এক বেগুনী ফুল।

নিউইয়র্কের বাড়ির বারান্দার সামনের বিশাল লনে গাছে গাছে আঁধার নেমে এসেছে কখন টের পাইনি। রাত্রির অন্ধকার চোখে সয়ে যাওয়া আমি তাকিয়ে থাকি সেইদিকে। জ্বলে ওঠে একটি জোনাকি। জ্বলজ্বল করে জ্বলে ওঠে আমার শৈশব, কৈশোরের স্মৃতির মতো। কিন্তু যে শৈশব, কৈশোর একদিন হারিয়ে গিয়েছিল জীবন থেকে, তা আর কোনদিন ফিরে আসবে না জানি। জীবন কখনও কখনও বাউলা বাতাসের মতো। সেই তীব্র বাতাসের ঘূর্ণি এসে ঘোরাতে থাকে আমার বেদনা সকল।

রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
******************************

Leave a Reply