You are currently viewing দহন শেষে > পিওনা আফরোজ

দহন শেষে > পিওনা আফরোজ

দহন শেষে

পিওনা আফরোজ

 

বাবা মারা যাওয়ার পর এক ঝড়ের রাতে কে যেন আমার মায়ের ঘরের দরজায় কড়া নেড়েছিল। আমি তখন মায়ের পাশেই শুয়েছিলাম। বয়স আমার তখন কত হবে, ঠিক মনে নাই। মা চৌকির নিচ থেকে দা নিয়ে দরজার কাছে গিয়ে বলল, ‘কে রে? এত রাইতে কি চাস?’
‘দরজা খোল। কাম আছে।’
‘এত রাইতে কি কাম? আপনে কেডা?’ গলার স্বরটা মায়ের পরিচিত মনে হলো। তাই সম্বোধনও বদলে গেল।
‘তোর অতো কিছু জানার দরকার নাই। দরজা খুলতে কইছি, খোল! তোরে মেলা কিছু দিমু। কতা বাড়াইস না আর। নাইলে খুব খারাপ অইবো কইলাম।’
‘আপনার কাম থাকলে দিনে আইবেন। অহন আমি খুলুম না।’
‘কুই কিন্তু কামডা ঠিক করতাছোস না।’
মা কী জানি কী ভেবে তখন বলেছিল, আপনে যাইবেন, না আমি চিল্লায়া মানুষজন ডাকুম! তখন অন্ধকার রাতে বিছানায় বসে ভয়ে আমি কাঁপছি।
পরদিন সকালেই আমার মায়ের নামে শালিস বসল। চেয়ারম্যানের কাছে বলা হলো, মা নাকি ঘরে পরপুরুষ নিয়ে ছিলেন। সবাই তাকে বলল অসতী, চরিত্রহীন। মা সেদিন গ্রামের চেয়ারম্যানের কাছে হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমি নির্দোষ। আমি এসবের কিছুই জানি না। কিন্তু আমার মায়ের গগনবিদারী কান্না চেয়ারম্যান সাহেবের মনে একটুও করুণার উদ্রেক করল না। তিনি বললেন, এরকম চরিত্রহীন মহিলার এই গ্রামে কোনও ঠাঁই হবে না।
সেদিনই এক কাপড়ে আমার হাত ধরে মা গ্রাম ছাড়লেন।
কিন্তু এতগুলো বছর পর এতকিছু ঘটে গেছে তবুও কেন এভাবে চলে এলাম, জানি না। সেই পুরনো ঠিকানায়া! কিসের আশায়?

গতকাল রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। ছায়ায় ঘেরা একটা পুরনো বাড়ি। সেখানে কেউ একজন বসে কাঁদছে। গোঙানির মতো শব্দ। অনেকটা ভুতুড়ে কান্নার মতো কানে বেজেছে। তখনি ঘুম ভেঙে যায়। কে কাঁদছে? কান্নার শব্দটা পরিচিত মনে হয়েছিল তখন। কিন্তু, কার কান্না? ঘুম ভাঙার পর কিছুতেই মনে করতে পারিনি।
ভাবছি সামান্য একটা স্বপ্ন আমায় এতদূর নিয়ে এলো! মনের আলপথে কত শত কথা উঁকি দিতে দিতে পথ প্রায় ফুরিয়ে এলো। স্টেশনে যখন নামলাম, তখন রাতের ঘন অন্ধকার সরিয়ে সকালের আলো উঁকি দিচ্ছে। কতদিন পর এই শহরে এলাম! সেই চেনা দোকানপাট, সিনেমা হল, গার্লস স্কুলের গেইট, বাস কাউন্টার সব ঠিক আগের মতোই আছে। মতি কাকার মিষ্টির দোকান ‘মামণি মিষ্টান্ন ভান্ডার’ এখনও আগের জায়গাতেই আছে।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। পরিচিত ক্ষতবিক্ষত রাস্তায় এদিক ওদিক দুলতে দুলতে ভারসাম্যহীন হয়ে রিকশা চলছে। রাস্তার দুপাশ জুড়ে কড়াইগাছের সারি। সামনেই একটা খাল। হেমন্তের ঠান্ডা বাতাস যেন শীতের আগাম বার্তাই দিয়ে যাচ্ছে। শরীর জুড়ে তখন দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি। রিকশা ধীরে ধীরে বাড়ির কাছের মেঠোপথ ধরে এগোচ্ছে। ডানদিকের পথে বাড়ির সামনেই একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছ। এখনও আগের মতোই আছে। কী সুন্দর ফুল ফুটেছে গাছে! দেখতে দেখতে রিকশা একেবারে ঘরের সামনে এসে থামল। কাঁধের ব্যাগটা সামলাতে সামলাতে বাড়ির ভিতর এসে ঢুকলাম।
বাড়িতে ঢুকেই বড় চাচাকে দেখলাম জলচৌকিতে বসে উঠানে রোদ পোহাচ্ছেন। সময়ের সাথে সাথে বয়স বেড়েছে বড় চাচার। আগের চেয়ে শুকিয়েও গিয়েছেন। গলার নিচের হাঁড়গুলো বের হয়ে আসছে। চোখেও ঠিকভাবে দেখেন না মনে হলো। আগের মতো শরীরের সেই জোরও আর নেই। সেই দরাজ গলাও নেই। একসময় গ্রামের লোকজন তাঁর ভয়ে কাঁপতো।
তিনি চোখ বুঁজে তসবি গুণছেন। আমি তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম। ডাকলাম, চাচা, চাচা।
বড় চাচা চমকে উঠলেন। আমাকে দেখে চিনতে পারেননি। বললেন, ‘কে তুমি? কোত্থেইকা আসছ?’
‘বড় চাচা আমি রুমেল । ঢাকা থেকে আসছি।’
‘তুই রুমেল?’
‘জি চাচা।’
‘কত বড় হয়ে গেছিস! এতদিন পর মনে পড়ল আমাগো কথা!’
‘মনে পড়ে চাচা। বাবা, দাদা, দাদি সবার কথাই খুব মনে পড়ে।’
‘তোর মা ভালো আছে তো?’
‘হ্যাঁ চাচা। মা ভালো আছে। আমি বাবার কবরটা দেখতে আসছি। জানেন চাচা, সেদিন আমি স্বপ্ন দেখেছি ছায়ায় ঘেরা একটা পুরনো বাড়ি। সেখানে কেউ একজন বসে কাঁদছে। দরজা-জানালা সব বন্ধ। ঠিক তখনি ঘুম ভেঙে যায়। কান্নার শব্দটা পরিচিত মনে হয়েছিল তখন। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর আর কিছুই মনে করতে পারছি না।’
কথা শেষেই বড় চাচা জলচৌকি থেকে উঠে আমার হাত ধরে বাবার ঘরে নিয়ে গেলেন। একটি চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। তিনি আমার পাশেই চকিতে বসলেন। জানতে চাইলাম,
‘চাচা, ঘরে আর কেউ নেই?’
‘না, পোলাপাইন সবাই যার যার কামে ব্যস্ত। যার যেখানে সুবিধা সে সেইখানে থাকে। আমার খোঁজ নেওয়ার সময় তাগো নাই। যাও তোমার চাচি খোঁজ খবর নিত, সেও আমারে থুইয়া গোরস্থানে যাইয়া হুইয়া রইছে। তাও মেলাদিন অইয়া গেছে।’ বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
আচমকা আমার হাতটি ধরে চাচা বললেন, ‘তোদের সাথে আমি অনেক বড় অন্যায় করছিরে বাপ।’ বলতে বলতেই চাচার চোখ থেকে পানি ঝরছিল। ধীরে ধীরে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে বড় চাচার গায়ে পরা পাঞ্জাবির বুকের কাছটা ভিজে উঠছিল।
‘চাচা আপনি কাঁদছেন কেন? কী হয়েছে? অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
চাচা দুহাতে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘অনেক বড় অন্যায়রে! অনেক বড় অন্যায়। লোভে পড়লে মানুষ আর মানুষ থাকে না। তোর বাবা মইরা যাবার পর ভাবছিলাম, তোর মারে সরায়া দিলে তোদের এতগুলা জায়গা-জমিন ভোগ করবার মতো কেউ আর থাকব না। তুই তখন অনেক ছোট। তোর মা না আইলে তুইও আর আইবি না ভাইবা লোভে পইড়া গেলাম। নিজের সন্তানদের সুখ শান্তির কথা ভাইবা তোর মার নামে মিথ্যা বদনাম দিয়া তারে বাড়ি থাইকা বাইর কইরা দিছিলাম।’
বড় চাচা একটু থামলেন। খানিক দম নিয়ে আবার বললেন, ‘তোদের ওপর এত বড় জুলুম করা ঠিক হয় নাই। একসময় মনটা আউলা ঝাউলা হইয়া গেল। মনে অইলো-কামটা ঠিক করি নাই। অনেক বড় গুণাহ করছি। তোর মারে আইতে কইলাম। আইলো না। আর আইবোই বা ক্যান? অরে কি কম কষ্ট দিছি? নিজে যে যামু তাও পারি নাই। বয়স অইছে। একলা একলা গাড়িতে উঠতে পারি না। রাস্তাঘাটও চিনি না। ঠিকমতো চোখে দেখি না। আমার কোনো উপায় ছিল না তোগো লগে যোগাযোগ করার। কোনো উপায় না পাইয়া তখন প্রত্যেকদিন নামাযের বিছানায় বইসা আল্লার কাছে ফরিয়াদ করছি, তিনি যেন একটাবার তোর মায়ের লগে দেখা করার সুযোগ কইরা দেন! অন্তত একবার তোদের কাছে মাফ চাইতে পারি। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করছেন, তিনি তোরে আমার কাছে পাঠাইছেন।’
আমি বিস্ময়ভরা চোখে চাচার দিকে তাকিয়ে তার সব কথা শুনলাম। জীবনের গল্পগুলো যে নাটকের চেয়েও অধিকতর নাটকীয় আজ কেবলই তাই মনে হচ্ছে। চাচা আমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে ট্রাঙ্কের ভিতর থেকে একটা লাল কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা বের করলেন। আবারও কাছে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। চৌকির উপরে কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটি রাখেন। তারপরই হাত দিয়ে লাল কাপড়টি সরিয়ে আমার সামনে মেলে ধরলেন কয়েকটি দলিল। বলেন, ‘এইগুলা তোদের সম্পত্তির দলিল। দেইখা নে। আর এইগুলা নিয়া তোর মা’র হাতে দিস। কইছ, আমারে যেন মাফ কইরা দেয়।’
কথাগুলো বলেই বড় চাচা ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির পিছনে পারিবারিক কবরস্থানের দিকে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখছিলাম… ।

==================