তোমার পেছনে কে দাঁড়িয়ে? / রওশন হক
- কুহু তোমার পেছনে কে দাড়িয়ে !
- না কেউ পেছনে নেই ।
- তোমার পেছনে কে?
- নো সামারা ডিয়ার, কেউ নেই।
- হু ইজ বিহাইন্ড ইয়ু?
কুহু আর কোন উত্তর দেয় না। সামারা আজ এমনই বক বক করবে। কুহু চুপ করে থাকে । তার কথায় উত্তর করে না। সে রাতের ডিউটির ফাইল পত্র দেখে নেয় । ফাইল ঘেটে কুহু তার কাজের ডিউটি বুঝে নেয় । সামারার ফাইলে স্পেশাল নোট লেখা আছে সে দিনে তেমন কিছু খায় নি এবং প্রচন্ড আনরেস্টে ছিল। সারাদিন অস্থিরতার মধ্যে ছিল।
দিনের শিফটের নার্স ডোনা সামারার জন্য আলাদা নোট রেখে গিয়েছে। আলাদা টেককেয়ার করবার কথা বলা আছে। কুহু সামনে সিসি টিভির মনিটর চেক করে অন্য সব রোগিদের অবস্থান পরখ করে নেয়। খুশি হয় দেখে যে সবাই খুব শান্ত আছে। অনেকেই এরমধ্যেই ঘুমিয়ে পরেছে ।
কুহু নোট ফলো করে সামারার সিটের দিকে এগিয়ে যায়।
-কুহু হু ইজ বিহাইন্ড ইউ ?
-নো বডি।
-হু ইজ বিহাইন্ড ইউ?
-আরে মা ! আমার পেছনে কেউ নাই
-I can see some one is there behind you. Kuho you are lieing.
-No dear I m not.
আরে দাদী আমার পেছনে কেউ নাই। আজকে আমি একাই তোমাদের কে দেইখা রাখব। কুহু ডোনার নোট পেয়েই বুঝতে পেরেছে সামারা আজ সারারাত এই একই কথা বার বার বলবে। আবারো বলতে শুরু করেছে
-কুহু লিসেন ,হু ইজ বিহাইন্ড ইউ!?
-ইউ লিসেন ,নো বডি উইদ মি । টুডে আই এম দ্য অনলি পার্সন ফর দিস রুম। বাকিরা ছুটিতে।
প্লিজ ডিয়ার ট্রাই টু স্লিপ ।
করোনা বেড়েছে । তাই বেশিরভাগ নার্স অসুস্থ হয়ে ছুটিতে। তাই তাকে একাই সবাই কে দেখতে হবে। অন্য রোগিরা সবাই বেশ শান্ত মেজাজে আছে । তবে সামারাই আজ বেশি অস্তিরতা করছে। গত কয়েক মাসে পরিবারের কেউ তাকে দেখতে আসে নাই।এদেশেও বয়স্ক দের সিনিয়র সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দিয়ে তেমন একটা খোঁজ খবর কেউ রাখে না । সামারা হয়ত আজ তার সন্তানদের দেখতে চাইছে। তাদের কে মনে পরছে তাই এমন অস্তিরতা করছে। হয়ত সন্তান দের চেহেরা মনে ভাসছে। কিন্তু কিছুই তো করবার নাই। কোভিডের জন্য এখন কেউ কে দেখা করবার পারমিশন দিবে না।
কুহু ঠিক করেছে আজ রাতে সামারার পাশেই বসে থাকবে । সামারার বিরাশি বছর বয়স । সে অন্য সময় খুব চুপচাপ থাকে । সে তার ব্লাড প্রেসার এবং টেম্পারেচার চেক করে দেখল । সবই ঠিকঠাক আছে। তবে তার কথা আর ক্রমাগত প্রশ্ন করা শুনে মনে হচ্ছে আজকের রাতে এই বুড়িটা তাকে বেশ প্যারা দিবে ।
বৃদ্ধাশ্রম নামটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয় ক্রন্দনরত মায়ের মুখ, ম্রিয়মান মা বাবার দুর্বল চাহনি। এ যেন জীবনের পরম অভিশাপ। তবে তা আমেরিকার মত উন্নত দেশের জন্য নয়। এখানে তারা খুশিমনে থাকে। সারাজীবন নিজের ছেলে মেয়েদের বড় করে তুলে শেষ জীবনে সন্তানকে অবলম্বন করে এরা থাকে না। সন্তানের উপর আশা করে বাঁচার চেষ্টা যেন সত্যিই এদেশে অন্যায় । এখানে সন্তান আঠারো বছর হলেই পরিবার থেকে দুরে থাকে। এটাই নিয়ম।
সামারা উচ্চ শিক্ষিত একজন ইন্জিনিয়ার। তরুন বয়সে অনেক ডলার কামিয়েছে। তার চাকুরির ইন্সুরেন্স তার আজীবন খরচ বহন করবে। যখন তিনি আর কোন কাজ করতে পারছিলেন না, তখন আর আবেগি না হয়ে নিজেই চলে এসেছেন এই সিনিয়র সেন্টারে। সামারা বৃদ্ধাশ্রমে আছেন প্রায় তিন বছর। এই দেশে বৃদ্ধাশ্রমে তাদের চব্বিশ ঘণ্টা ডাক্তার দেখেছে। পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা তাদের খাবারের চার্ট তৈরি করে। নিয়মিত শরীর চর্চা থেকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া ও বিনোদন সবই ঘড়ি ধরে করানো হয়।
তবুও কুহুর কাছে এমন পরিবারবিহীন থাকা নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে সামারাদের কাছে তা স্বাভাবিক । তবে এদেশের সমাজ সংস্কৃতি বৃদ্ধাশ্রমের পক্ষে যত যুক্তিই দেখাক না কেন কুহুর এত বছরের কাজের অভিজ্ঞতা বলে এখানেও বৃদ্ধরা পরিবার কে মিস করে ।
গত মাসে সামারার জন্মদিন গিয়েছে। করোনার সংক্রমনের জন্য তার সন্তানেরা কেউ দেখতে আসতে পারেনি । ভিডিও কলে নানান জায়গা থেকে মা কে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।
-কুহু প্লিজ কাম বাই মি
-আই এম হিয়ার ।
কুহু সামারার হাত ধরে পাশের চেয়ারে টেনে বসে।
-হু ইজ বিহাইন্ড ইউ ?
কুহু এবার আর পাত্তা দেয় না । সে তার হাত ধরে থাকে । লোশন নিয়ে হাত দুটোয় হাল্কা মালিশ করে আর গুন গুন করে গান ধরে ,”বড়লোকের বেটি লো লম্বা লম্বা চুল, এমন মাথায় বেঁধে দিব লাল গেন্দা ফুল”
-কুহু নাইচ সং বাট হু ইজ বিহাইন্ড ইউ।
-লিসেন সামারা দাদি, আমার পেছনে বা ডানে বায়ে কেউ নাই । তুমি ঘুমাও সোনা পাখি ।
-কুহু নাইস সং । কেন ইউ সিং দ্যা আদার ওয়ান ?
-কুহু গাইতে শুরু করে ,
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে । একলা চলো একলা চলোরে ।
এই গান টা এখানের সবার পছন্দ ।
কুহু তাদের কে ইংরেজী অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছে।
If they pay no heed to your call walk on your own.
Walk alone, walk alone, walk alone, walk all alone.
If none speaks, o wretched one,
If all turn their face away and cower in silence—
Then open out your heart
dear one, speak out your mind, voice alone.
গান শুনতে শুনতে সামারা ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে। এক সময়ে ঘুমিয়ে পরে। কুহু তার অন্য রোগীদের একবার দেখে নিয়ে ব্রেক নিতে যায় ।
কুহু ছোট বেলায় কিছুদিন গান শিখেছিল তাই সব সময়ই গুন গুন করে গান গায় । রুগিরাও খুশি হয়। রুগিদের সাথে সে মাঝে মাঝেই সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে । তাদের কে সিলেটে বিয়ের গীত শুনায়। আইলারে নয়া দামান শুনে তারা হাসে আর হাতে তালি দেয়। তাদের কে খুশি করতে কুহু ধামাইল নাচ থরে। তাই দেখে তাঁরা এমন ভাব করে যেন সবই তারা বুঝে। এখানে এদের বয়স এতটা বেশি যে অনেকেই মেশিন ছাডা কানেও শুনতে পায় না। তাই এদের কাছে কুহুর মুখের ভাষা তেমন জরুরী না। তার হাতের ছোঁয়াটাই তাদের কাছে জরুরী। কুহুর হাতের স্পর্শ এদের সবার কাছে পরিচিত । এখানের রুগিরা কুহুর গায়ের গন্ধ চেনে। একদিন কাজে না আসলে এরা অন্য নার্সদের কুহু কুহু বলে অস্থির করে তোলে ।
দশ মিনিটের ব্রেক নিয়ে ফিরে এসে কুহু সামারার পাশে বসে আবারো তার হাত ধরে বসে গুন গুন করে গান গায় । “বড়লোকের বেটি লো লম্বা লম্বা চুল, এমন মাথায় বেঁধে দিব লাল গেন্দা ফুল। কুহু ভাবে এই গান কত পুরানো অথচ এত দিন গান টা ভালো মত শুনে নাই কেন কে জানে । যেই রিমিকস হলো এখন সবার মুখে মুখে ।
কুহু আঠারো বছর ধরে এই সিনিয়র সেন্টারে কাজ করে। সে শুরু থেকেই রাতের শিফটে কাজ করে। রাত দশটা থেকে ভোর সাতটা পর্যন্ত কুহুর ডিউটি । কোন দিন কেউ মারা গেলে কুহু ঘন্টা দুয়েক বেশি কাজ করে। কুহুর স্বামী রাহাত দিনে কাজ করে । রাহাত ও রেজিস্টারড নার্স । কুহু রাহাতের সতের বছরের সংসারে অনেক চেষ্টা করেও কোন সন্তান হয় নি । তাদের সন্তানবিহীন জীবন বড়ই একাকীত্বের । তবে তাদের এ নিয়ে কোন অশান্তি নেই। এই হাসপাতালের বৃদ্ধ মানুষগুলি তার কাছে সন্তানের মতই মনে হয় । তাই সে যত পারে বেশী সময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। রাহাত প্রতি বছর দেশে যায়। তখন কুহু দুই শিপটে কাজ করে। অন্য নার্সদের ছুটিতে পাঠায়। কুহু এই সিনিয়র সেন্টার ফেলে দেশে যেতে চায় না। রাহাত আগে একা দেশে যেতে মন খারাপ করত এখন সে খুশি মনেই দেশে যায়। কুহুর দেশে আপন কেউ নেই । একজন একজন করে সবাই মারা গেছেন। একবার মা বাবার কবর আর বৃদ্ধ শাশুড়ি কে দেখতে যাবার ইচ্ছা পোষণ করে । তবে রাহাত এখন আর তাকে দেশে নিতে চায় না। রাহাত সন্তানের বাবা হতে চায় । অভিজ্ঞ নার্স হয়ে সে জানে তাকে দিয়ে বাবা হবার সম্ভাবনা নেই তবুও সে এক তরুণী কে বিয়ে করেছে। কুহু থেকে বলেকয়ে তার সম্মতি নিয়ে বিয়ে করেছে। মাঝ বয়সে এসে রাহাত তাকে অসম্মান করেছে। কুহু তবুও গায়ে মাখে নি। সে তার কাজ করতে পছন্দ করে। আপন মনেই গান গাইতে গাইতে রোগীর সাথে কথা বলে। সে সময়ে রাহাত তার মাথায় থাকে না। তাঁরা ও কখনো হাসে কখনো কাঁদে । কুহুর এই এক অন্য জীবন । যা সে খুবই উপভোগ করে।
কুহুর ডিইটি রুমের পাশেই আছে হিমায়িত লাশ রাখার ঘর । এটা লাশ ঘর নয় বিশাল আকারের ড্রয়ার সম্বলিত ডিপ ফ্রিজ । প্রতিদিনই কেউ না কেউ কে কুহু ও তার কলিগরা গোসল দিয়ে ফ্রিজের ড্রয়ারে রেখে আসে। কুহু লাশ ধোয়ানোর সময় কখনো মনে মনে কখনো সশব্দে দোয়া পরে । দেশে তার নানীর মৃতদেহ গোসল দেয়ার সময় সে পাশে ছিল । মুসলিম নিয়ম মতে নারীদের মৃতদেহ গোসল করানোর কিছু নিয়ম সে তখন শিখেছে । সেই থেকে মৃতদেহ তার শেখা নিয়ম এদেশে এখানে এদের উপর প্রয়োগ করে । শুরু শুরুতে এরা একটু অবাক হলে ও কুহু যখন বুঝিয়ে বলেছে তারা এখন অনেকেই মারা গেলে লাশ ধোয়ানোর জন্য কুহুর জন্য অপেক্ষা করে। তাদেরকে সে বুঝিয়েছে মানুষ মারা যাচ্ছে দেখলে দোয়া দরুদ পড়তে হয়। এদের অনেকেই বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বলা শিখেছে। সে কাউকে বলে না তারা খুশি মনে বিসমিল্লাহ বলে মৃতের গায়ে পানি ঢালে। অন্যরা খুব খুশি হয় । কুহু বিশ্বাস করে মানুষ মারা গেলে সবার আত্মা একই জায়গায় যায় । কাজেই সবার জন্য একই দোয়া পড়তে অসুবিধা নেই।
মাঝে মাঝে কুহুর কাছে তার রোগীদের নিথর দেহ মৃত জীবিত সমানই মনে হয়। যাদের নিশ্বাস আছে তারাও কথা বলে না । চুপচাপ শুয়ে থাকে। শুধু শ্বাসনালী টা উঠানামার কারনে বুঝা যায় কোন জন জীবিত । শরীর অবস্হা ভেদে তাদের রুম আলাদা করা হয়। শরীর যাদের বেশি খারাপ তাদের কে লাশ ঘরের পাশের রুমে রাখা হয়। আর কুহু আঠারো বছর ধরে এই সিরিয়াস রোগীদেকেই দেখাশোনা করে।
আজ এই রুমে সব রুগীরা সিরিয়াস । কেউই ভালো হয়ে উঠবে না। এ যেন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষায় থাকা । কেউ মারা গেলে পরিবারকে একটা কল দিয়ে কর্তৃপক্ষ জানায় , সাথে ফাইলে রাখা ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠায়। দশ পনের দিন পর কারো ছেলে মেয়ে বা ভাই বোন আসে । অনেকেই না এসে ক্লিনিকের বিল পাঠায় । সিনিয়র সেন্টার থেকেই কবর দেবার ব্যবস্থা করা হয়।
এই সিনিয়র সেন্টারের রুগিদের বয়স পঁচাত্তর থেকে একশ’র উপরে । কুহু এখানে সবার প্রিয় নার্স । কুহু ছাড়া এখানখার বয়স্কদের কেউ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করতে পারে না। রুগিরা রাজি হয় না । এমনিতে এরা কথা কম বলে । কিন্ত কেউ গায়ে হাত দিলে কুহু কুহু করে ডাকা শুরু করে । তাই এদের গা পরিস্কার চুল আচঁডানো , নোখ কাটা সবই সে কুহু খুশি মনে করে যায় । তারা হাসি দিয়ে জানান দেয় তারা অনেক হ্যপি। জীর্ণ শীর্ণ দুর্বল রগতোলা হাত তুলে কুহুর মাথায় হাত রাখে। তারা বিশ্বাস করে কুহুর হাতে যাদু আছে। সে তাদের শরীরের হাত দিলে তাদের ক্লান্তি দুর হয়ে যায়। কুহুর নিজের মায়ের জন্য মন খারাপ হয় । কুহুর ছোট বেলায় বাবা মারা যায় আর মা মারা যায় একা ঘরে নানার বাড়িতে ।কুহু সেই থেকে আর দেশে যায় না ।
সেদিন “তোর ডাক শুনে” গান শুনতে শুনতে সামারা ঘুমিয়ে পড়েছিলো । তার সেই ঘুম আর ভাঙেনি । সামারা আর জেগে উঠে নি । তাহলে কি সত্যিই সামারা কাউকে কুহুর পেছনে দেখতে পেয়েছিল? কুহুর মাথায় আসে না। তাহলে সত্যিই কি আজরাইলকে মৃত্যুর সময় দেখতে পাওয়া যায়? কুহু ভাবতে থাকে ,সেদিন কুহু দশ মিনিটের ব্রেক না নিলে কি সামারাকে আরো কিছু দিন সে গান শুনাতে পারতো ? কুহুর ব্রেক টাইমে সামারাকে একা পেয়ে আজরাইল তার জান কবজ করেছে ।
সেই থেকে কুহু এখন নিজেই নিজের পেছনে কাউকে টের পায়। মনে হয় কেউ যেন তার পিছু পিছু হাঁটে । সে টের পায় তার পেছনে পেছনে কেউ তাকে ফলো করে। কেউ যেন এখন তার ছায়া সঙ্গি হয়ে চলে। কুহু তার সাথে কথা বলে । সে ছায়ার সাথে নাচ করে গান শোনায়।
ইদানিং সে রাহাত কে দেখলেই বলে,
হু ইজ বিহানড ইউ?
রাহাত আর দেশে যায় না। রাহাত তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে । সে রাতদিন হাসপাতালে কুহুর পাশে বসে থাকে । কুহু এখন নাচে গানে মুখর করে রাখে হাসপাতালের অন্য রোগীদের।