You are currently viewing স্মৃতির অক্ষর বুননে কথাগুলো রেখে কথোয়ালের যাত্রা শেষ হলো> গৌতম গুহ রায়

স্মৃতির অক্ষর বুননে কথাগুলো রেখে কথোয়ালের যাত্রা শেষ হলো> গৌতম গুহ রায়

স্মৃতির অক্ষর বুননে কথাগুলো রেখে কথোয়ালের  যাত্রা শেষ হলো

গৌতম গুহ রায়

 

   সীমান্তের ‘অন্যদিকে’, বাংলাদেশে যখন জাতীয় সঙ্গীত প্রণেতা রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উদযাপন হচ্ছে সেই সকালেই চিরবিদায় নিলেন সমরেশ মজুমদার, দুই বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাসিক । প্রথমবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে সমরেশ মজুমদার লিখেছিলেন স্মৃতিজাগানিয়া নভেলেট ‘বুকের ভেতর বাংলাদেশ’, ২০০৪-এ । একটি রহস্য উপন্যাসের গড়নে লেখা এই ১১২ পৃষ্টার বইটিতে জড়িয়ে আছে তাঁর ভেতরে থেকে যাওয়া দেশভাগের অনুভূতি, যন্ত্রণা, আক্ষেপ, প্রত্যাশা । গল্পের থেকে বেড়িয়ে গিয়ে অনুভূতির কথা টেনে এনেছেন, সূচনা পর্বে পচাত্তর বছর বয়সী প্রশান্ত  মুখার্জী বলছেন – ‘আমার জন্মভূমি দেখতে চাই । পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার আগে এটাই আমার শেষ ইচ্ছে ।’ এই ইচ্ছাটা এখনো এই খণ্ডিত বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষের অন্তরে উচ্চারিত হয় । সমরেশ মজুমদার বাংলাদেশ দেখে আসার অনুভব এই রহস্যউপন্যাসে স্বপন দত্তের বয়ানে লিখে রাখেন  –“হিন্দু-মুসলমান ব্যাপারটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না । আমি একজন হিন্দু । আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করি । আমার বেশিরভাগ বন্ধুই মুসলমান । কিন্তু আমাদের কথা বলার এত বিষয় আছে যে ধর্ম নিয়ে কথা বলি না । এখানে দুর্গা পূজোর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে । রোজার সময় ইফতারের নেমন্তন্ন খেতে খেতে পেট ভরে যায়। … আপনি হয়তো জানেন না বাংলাদেশের মানুষ রবীন্দ্রনাথকে যে পরিমাণ শ্রদ্ধা করে, তাঁকে যেভাবে স্মরণ করে আপনারা তার শতকরা দশভাগও করেন না । অথচ দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত তাঁর রচনা ।” সমরেশ মজুমদার প্রয়াত হলেন ওপাড়ের ২৫শে বৈশাখ, শেষ যাত্রা হলো এপাড়ের ২৫শে বৈশাখ ।

    ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগান থেকে যে জীবন যাত্রা শুরু করেছিল সেই গোটা জীবন ডুয়ার্সের স্মৃতি বহন করে অক্ষরের বুননে সেই কথা রেখে গিয়ে কথোয়ালের  যাত্রা শেষ হলো নগর কলকাতায় । ২৫শে এপ্রিল থেকে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন । মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে । সোমবার বিকেল ৬টা নাগাদ তাঁর প্রয়াণ ঘটে ।  ১৯৪৪-এর ১০ মার্চ, বাংলার ২৬শে ফাল্গুন ১৩৪৮ সালে জন্মেছিলেন, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী সংঘাতে বিশ্ব তোলপাড় । দেশ জুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার । সমরেশ মজুমদারের শৈশব কাটে জলপাইগুড়ি জেলার চা-বাগান অঞ্চল –  ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে, ডুডুয়া নদী, আংরাভাষা গিলান্ডি নদী, আধো পাহাড় আধো অরন্যের সবুজে । দাদু পূর্ণচন্দ্র মজুমদার ছিলেন চা-বাজ্ঞানের বড়বাবু,  এই দাদুর ভূমিকা তাঁর জীবনে অসীম । বাবা কৃষ্ণদাস মজুমদার ছিলেন গয়েরকাটা চা-বাগানের গুদামবাবু । এই বাগানের কোয়ার্টারেই জন্মেছিলেন সমরেশ মজুমদার ।  পরবর্তীতে ছাত্র জীবন জলপাইগুড়ি,  জেলা স্কুল । তখন তাঁর বাবা কৃষ্ণদাস মজুমদার জলপাইগুড়ি শহরের তিস্তা পারের হাকিমপারায় বসত গেড়েছেন । এরপর ‘উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতা গমন’, স্কটিশ্চার্চ কলেজ । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা । লেখালেখি চলছে। আত্মকথায়, আলাপচারিতায় বলেছেন যে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন যে ‘শুরু করা উচিৎ চুড়া থেকে । তাই তাঁর অভিষ্ঠ ‘চুড়া’ দেশেই গল্প পাঠান । কিন্তু  পিয়নের ভুলে সেটি মনোনিত হয়েও ফিরে আসে ।  ১৯৬৭ সালে সেই গল্প ‘অন্তর আত্মা’ ‘দেশ’এ প্রকাশিত হয় । এরপর ক্রমশ গল্প লেখার নেশা তাঁকে চেপে ধরে । যদিও শুরুতে চেয়েছিলেন নাটক লিখতে, কিন্তু চারপাশের চরিত্র ও ঘটনাগুলোর কথা বলার নেশায় হয়ে উঠলেন গল্পকার ।  কলকাতার নাগরিক জীবনে ক্রমশ অভ্যস্ত হতে থাকা সমরেশের বুকের ভেতর জেগে থাকা তাঁর শৈশব ও কৈশরের ডুয়ার্স, জলপাইগুড়ি, নকশালবাড়ি, ডুয়ার্সের নদী, চা বাগানের মানুষজন,  তিস্তা তাঁর গল্পে রসদ যোগান দিতে থাকে । গল্প বলার জাদুকরি কলম নিয়ে একের পর এক গল্প লিখে যেতে থাকেন, একদিন সেই  কলমই তাঁকে ‘পেশাদার’ সর্বক্ষণের লেখক করে তোলে । সমরেশ মজুমদারে এই প্রবল জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ ছিলো তাঁর অসাধারণ গল্প বলার দক্ষতা । প্রেম বা রহস্যোপন্যাস, সবটাই নিখুঁত সম্মোহনী ভাষায় বলে যেতেন তিনি । এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন যথার্থই শরৎচন্দ্রের উত্তরাধিকারী । গল্প থেকে উপন্যাসে চলে আসতে খুব একটা সময় লাগে না  তাঁর। ১৯৭৫-এ সেই ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’ প্রকাশিত হয় । এরপর একের পর এক উপন্যাস এখানেই প্রকাশিত হতে থাকে । সত্তরের উত্তাল সময়কে তিনি উপকরণ হিসাবে বেছে নেন । ‘ট্রিলজি’ লিখতে শুরু করেন, প্রথমে ‘উত্তরাধিকার’ , এরপর কালবেলা, কালপুরুষ ।  ডুয়ার্সের শান্ত ও সবুজ নিরিবিলি জনপদ থেকে নগর কলকাতা পদার্পনের স্মৃতি ও কষ্ট কোথাও তিনি যত্নে রেখে দিয়েছিলেন । ‘দেশ’ পত্রকায় ‘উওত্তরাধিকা’ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় । এই উপন্যাসের শুরুর কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে সগরময় ঘোষ তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘নিজেকে নিয়ে লেখো । তোমার জীবনী নিয়ে ইন্টারেস্টেড নই, জীবনে যাঁদের দেখেছো, তাঁদের নিয়ে গপ্পো তৈরি করো’ । এই ‘ট্রিলজি’তে আমরা সমরেশ মজুমদার ও তাঁর দেখা মানুষদের, ঘটানাগুলোকে তাঁর মতো করে দেখতে পাই । ‘উত্তরাধিকার’এ যেমন পাই অনিমেষ কলকাতায় পড়তে এসেছেন, সমরেশও তাই ।  শৈশবের আংরাভাষা নদী, জলপাইগুড়ি শহর, গয়েরকাটা চা বাগান ( গয়ের – স্বর্গ । স্বর্গছেড়া) , খুট্টিমারি জঙ্গল , বাস্তবের ডুয়ার্স তাঁর লেখা দখল করে থাকে ।

    দৌড়-এর উৎসর্গে তিনি লেখেছিলেন – ‘… মাছেরা কি ঝরণার কাছে ঘুরে ফিরে কৃতজ্ঞতা জানায়? / কি জানি । শুধু জানি   #  / ওদের জলজ বলা হয়ে থাকে …’ । সমরেশ মজুমদার নেই এই খবরটা শুনবার পর থেকে এই কথাগুলোই মনের মধ্যে, কানের পাশে, জ্বিহ্বার উপর ঘুরঘুর করছে ।  মনে ভেসে উঠছে ছয় বছর আগের কিছু স্মৃতি, ওই তাঁর শেষবার নিজের শহরে নিজের মর্জিমতো ঘুড়ে বেড়ানো । উপলক্ষ ছিলো ফণীন্দ্রদেব বিদ্যালয়ের শতবর্ষ । তিনি, সমরেশ মজুমদার ছিলেন ফণিন্দ্রদেব বিদ্যালয়ের  চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী জিলা স্কুলের ছাত্র ।   কিন্তু নিজের শহরের আহ্বান ফেলতে পারেন নি । এর  কিছুদিন আগেই তিনি মারাত্মক ভাবে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন  ছিলেন । তবুও এলেন, আমি মজা করে তাঁকে বলেছিলাম – ‘আমরা ঝরণার জলের কলতান শুনতে চাই, আমরা জলজ’ । তিনি রাজি হলেন তাঁর কৌশরের শহরে আসতে । ফণীন্দ্রদেব বিদ্যালয় তার শতবর্ষ উদযাপনের অঙ্গ হিসাবে বইমেলার করেছিলো, তিনি সেই বইমেলার উদ্বোধক ছিলেন । আমরা অবাক হয়ে দেখেছিলাম কিছুদিন আগেই মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা, স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া মানুষটা তাঁর যাবতীয় অসুস্থতা কিভাবে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছেন । এই প্রবল জীবনী শক্তির মানুষটা অবশেষে হেরে গেলেন মৃত্যুর কাছে, ১৯৪৪ থেকে ২০২৩ – ৭৯ বছরের রঙিন যাত্রা শেষ হলো ।  

     গয়েরকাটার বন্ধু বিকাশ, তাঁর ‘কনিষ্কের মাথা’ জলপাইগুড়ি থেকে প্রকাসিত হয়, তখনও সে ও আমি স্কুল ছাত্র । একদিন  বিকাশের গয়েরকাটার বাসায় হাজির হলাম । অনেক টানের একটা ছিলো সমরেশ মজুমদারের শৈশবের, তাঁর আখ্যানের মাটির গন্ধ নেওয়া । বিকাশ তখনই দুর্দান্ত কবি ও সম্পাদক ।  আমাদেরও মাথায়  সাহিত্যের ভুত চেপেছিলো,  তখন সমরেশ মজুমদার কলকাতা নিবাসী, কিন্তু মাঝে মাঝেই আসেন গয়েরকাটা,  জলপাইগুড়ি ।  তাঁদের হাকিমপাড়ার বাড়িতেও বছরে দুই তিন বার আসতেন, বিশেষ করে পূজোর সময় । সমরেশ মজুমদার এই বাড়ির কথা প্রসঙ্গে লিখেছেন, “… আমাদের বাড়ি ছিল তিস্তা নদী থেকে বড় জোর দেড়শো গজ দূরে । বন্যা না হলেও নদীতে জল বাড়লেই তা  ঢুকে পড়ত আমাদের বাগানে । একটা মজা হত তখন, সেই জলে সাঁতরে আসতো বোরলি আর ট্যাংরা মাছ । এই ট্যাংরা মাছগুলোকে আমি এখন পর্যন্ত জলপাইগুড়ির বাইরে দেখিনি । আর বোরলি তো জলপাইগুড়ীর গর্বের মাছ । যেই তিস্তার জল কমতো অমনি আমরা নেমে পড়তাম বাগানে । ঘাসের, গাছে গোড়ায় থাকত কখনও বোরলি আর ট্যাংরাগুলো । … শুধু বাগানের ধরা মাছ নয়, তিস্তার জল বাড়লে বাজার থেকে মাছ কেনা হত না । এসবের পেছনে ছিল ওই খাটা পায়খানার ভূমিকা ।  এখন ভাবি, যেসব কর্মীরা মলের টিন বয়ে নিয়ে যেতেন তাঁরা যদি নারাজ হতেন তাহলে শহরের মানুষদের কি অবস্থা হত ? নাকে গামছা বেঁধে ওই মানুষগুলো কাজ করেছেন বলে শহরটা রক্ষা পেয়ে গিয়েছিল । অভাব কতটা তীব্র ছিল যে তার মোকাবিলা করতে মানুষকে অমন ভয়ঙ্কর কাজ করতে হয়েছে’ ।

     আমার সেই কিশোরকালে অনিমেষ মাধবীলতার প্রেমে পড়া অনেক কিশোরের মতো আমার কাছে সমরেশ মজুমদার এক উজ্জ্বলতর তারকা । পূজোর লেখলেখি শেষ করে এই ছিলো উত্তরভূমি ছিলো তাঁর বিশ্রামকাল ।  ১৯৭৮-৭৯, আমি তখনো স্কুল ছাত্র, সদ্য একটা লিটলম্যাগাজিন বের করি আর কবিতা যাপনের নেশায় আক্রান্ত হয়ে বুঁদ হয়ে আছি ।  জানিনা কেনো সেই স্কুল ছাত্রটিকে স্নেহ করতেন তিনি,  রাকেশ-অনিমেষ-মাধবীলতা-অর্জুনের শ্রষ্ঠা ।  টাউনক্লাব স্টেডিয়ামের উত্তরের সাদা রঙের সেই বাড়িটার বারান্দায় একটা বেতের ‘ইজি চেয়ার’ ছিলো । তিনি এসে চায়ের কাপ নিয়ে বসতেন,  একের পর এক জিজ্ঞাসা ছুড়ে দিতাম তাঁকে ।  তিনি হাসতে হাসতে তাঁর উত্তর দিতেন । অনেকটা জায়গা নিয়ে ছিলো ‘উত্তরাধিকার’এর চরিত্ররা । অনিমেষ, তার প্রেম, সাইকেলের ঘন্টি থেকে স্বর্গছেড়া চা বাগান । একদিন সকালে হাটতে হাটতে জিলা স্কুলের সামনের বাঁকটা পার হয়ে একটা বাড়ির সামনেটা দেখিয়ে বললেন, ‘ধরো এই পথ দিয়েই অনিমেষ সাইকেল নিয়ে ঘুরছে, ওখানে বিরাম করের বাড়ি, ওইখানে সেই মেয়েটির বাসা’।  কথায় কথায় গয়েককাটা চা বাগানের কথা উঠে আসতো, স্বর্গছেড়া তো তাঁর গয়েরকাটাই । ডুয়ার্স, চা বাগান তাঁর চেতনার গভীরে ঢুকে ছিলো । উত্তরাধিকারের নানা যায়গায় তার চিহ্ন রয়ে গেছে । শুরুতেই তিনি টেনে নিয়ে যান তাঁর ‘জায়গা জমিনে’ । ‘শেষ বিকেলটা অন্ধকারে ভরে আসছিল । যেন কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে, বাতাসে একতা ঠান্ডা আমেজ টের পাওয়া যাচ্ছিল । অবশ্য ক’দিন থেকেই আকাশের চেওহারাটা দেখবার মত ছিল । চাপ-চাপ কুয়াশার দঙ্গল বাদশাহী মেজাজে গড়িয়ে যাচ্ছিল সবুজ গালচের মত বিছানো চা-গাছে ওপর দিয়ে খুটিমারীর জঙ্গলের দিকে । বিচ্ছিরি, মন খারাপ করে দেওয়া দুপুরগুলো গোটানো সুতোর মত টেনে টেনে নিয়ে আসছিল স্যাঁতসেঁতে বিকেল – ঘষা সেলেটের মত হয়েছিল সারাদিনের আকাশ । বৃষ্টির আশঙ্কায় প্রত্যেকটা দিন যেন সূচের ডগায় বসে থাকতো এই পাহাড়ী জায়গাটায়, কেবল বৃষ্টিটাই যা হচ্ছিল না। ”  আসলে ডুয়ার্স, চা বাগান, ডুয়ার্সের নদী তার মজ্জ্বায় ঢুকে ছিলো । তাই তার প্রকাশ গোটা ‘সমরেশ সাহিত্য’ জুড়ে। তাই ‘নদী বন্ধহয়ে যাওয়া’র কথা পাই, ডুডূয়া, কালবোস মাছ তার সাহিত্যে ঢূকে থাকে । তিস্তা সেতুর আগে, ১৯৬৮র বন্যার আগে তিস্তার চর দিয়ে পারাপারের ভর্সা ছিলো চর ট্যাক্সি । সেই চর ট্যাক্সির কথা তিনি ভুলেন নি । আজীবন তিনি স্মৃতি নিয়েই তো গল্প বলে গেছেন, গল্পবলাটাই ছিলো মূখ্য, সাহিত্য কতোটা ধুপদী হলো তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা ছিলো না । ‘দৌড়’ তাঁর প্রথম উপন্যাস, সেখানে কেবলই নাগরিক জীবনের আর্তনাদ, কিন্তু তিনি যখন ‘নিজের দেখা মানুষগুলো ও ঘটনা’র আখ্যন লিখতে বসলেন তখন তাঁর যাপন জুড়ে থাকা ডুয়ার্স, জলপাইগুড়ি কথার মাঝে স্থায়ী আস্থান করে নিলো । ‘উত্তরাধিকার’এ আমরা বারংবার দেখি গয়েরকাটা-জলপাগুড়ি-তিস্তা-ডুডুয়া । “শীতকালে জলপাইগুড়িতে হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি আসে ।  এসে ঠান্ডাটাকে বাড়িয়ে দিয়ে যায় । যে সমস্ত মানুষ জরায় থিতোচ্ছিল তারা টুপটাপ চলে যায় এ সময় । তিস্তার তখন টানের সময় । শীতের দাপটে ক্রমশ কুঁকড়ে যাচ্ছে নদীটা । তবুও জল এখনও টলটলে । স্রোতের ধার নেই, যোউবন ফুরিয়ে যাওয়া মহিলার মত শুধু জাবর কেটে যাওয়া । বাঁধ প্রায় সম্পূর্ণ ।ওপাশে সেনপাড়া ছাড়িয়ে তিস্তার বুকের ওপর পুল বানাবার কথাবার্তা চলছে । কলকাতা থেকে সরাসরি ট্রেনে বাসেয়াসাম যাওয়া যাবে । পক্ষিরাজ ট্যাক্সিগুলো গা-গতর ঝেড়ে মুছে এই কটা বছর কিছু কামিয়ে নেবার জন্য কিংসাহেবের ঘাটের দিকে আসবো আসবো করছে । এই সময় সন্ধ্যে থেকেই আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি নামল ।” (পৃঃ ২০৬) বুকের গভীরে এটুট স্মৃতি ও ভালোবাসা না থাকলে এভাবে লেখা যায় না । যে বুক অনন্ত রোমান্টিক । ‘সমরেশ মজুমদার আর নেই’ এই খবর পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য সেই এলাকাটা ঘুরে আসার ইচ্ছে করছিলো, যেখানে তাঁদের বাসা ছিলো, এখন আমারই এক বন্ধু তিনতলা বাড়ি করেছেন। সেখানে দাঁড়িয়ে যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই ‘উত্তরাধিকার’ –“তারপর আঁচল দিয়ে জিমির লালা বুক থেকে মুছে বললেন, ‘তোমরা কোথায় থাকো?’ ‘টাউনক্লাবের কাছে ।’ অনিমেষ বলল । ‘ওমা তাই নাকি ! একই পারায় আছি এতদিন তোমাকে দেখিনি ! তোমারা কয় ভাই বোন?’ ‘আমর ভাই বোন নেই, দাদু পিসীমার কাছে থাকি ।’ ‘কেন, তোমার বাবা মা ?’ ‘বাবা স্বর্গছেড়া চা-বাগানে আছেন ।’ … এরপর অনিমেষের মন উথালপাথাল করা ‘দর্শন’ ।  সমরেশের পাঠককুলের একটা বড় অংশ ছিলো তরুণ-তরুনী, যারা এই ভালোবাসার গল্পের টানে তাঁকে বানিজ্যিক ভাবেও সাফল্য এনে দিয়েছিলো ।

    সমরেশ মজুমদারকে নিছক সাহিত্যিক হিসাবে দেখলে তাঁর গোটা ছবিটা পাওয়া যাবে না । অনেকেই বলেন যে ডুয়ার্সের বাতাসে ‘রোমান্টিক আলো’ ঘুরে বেড়ায়, এখানে যারা বড় হন তাদের গায়ে সেই আলো মাখামাখি হয়ে থাকে । এই রোমাটিসিজমে সামাজিক শোষণের থেকে বেড়িয়ে আসার বার্তা থাকে, বিপ্লবের গল্পকথা থাকে । সমরেশ মজুমদার একজন যুবকের স্মৃতি নিয়ে দেখেছেন সত্তরের নকশাল আন্দোলন, তার সেই দেখা তাঁর মতো করে, তীব্র এক রোমান্টিকতায় এঁকেছেন । এই আখ্যান তার অন্তর থেকে আসা। পক্ষে বিপক্ষের যুক্তি পাল্টা যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে যান নি । অনেক বার এই নিয়ে খোলামেলা কথা হয়েছে। বিপ্লবের ওই পথকে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনকে বিশ্বাস করতেন ।

তাঁর ‘ট্রিলোজি’র অনেকটা জুড়েই তাঁর দেখা সত্তরের রাজনৈতিক ঘটনাবলী, নকশাল আন্দোলন । সমরেশ মজুমদারের নিজের কথায়, “আমি সেই জীবন-যাপন করিনি, তবে দেখেছি ।  আমার সেই বন্ধুরা প্রবল দম–পীড়নের মধ্যে ছিলো । অনেকেই দেশ থেকে পালিয়ে যায়, অধিকাংশ জেলে, একাংশ আত্মগোপন করে ছিলো । জীবনে প্রেম  একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু এই বন্ধুরা পিছুটান মুক্ত থাকার জন্য প্রেমের ডাককে এড়িয়ে যেতো । এমন পরিস্থিতির মধ্যে ‘কালবেলা’ লিখি আমি । নকশালবাড়ি আন্দোলনটা  কি ছিলো?  এই বিষয়ে আমি অনেক বিখ্যাত নকশাল বাড়ি নেতার সঙ্গে  আলোচনা করেছি । কিন্তু তাঁরা আমাকে তৃপ্ত করতে পারেনি । কারো সাথে কারো কথা মিলছে না, আমি কথার গড়মিলে ধন্দ্বে পড়েছি । শুরুর দিকে সাধারণ মানুষের একটা সমর্থন ছিলো । একসময় তারা ভেবেছিলো  – এই দামাল ছেলেগুলোই মুক্তি আনবে, দেশ ও দশের । কিন্তু এঁদের পথ হঠাৎ ব্যক্তি হত্যা, পুলিশ হত্যার দিকে ঘুরে গেলো, বিদ্যাসাগর সহ মনীষাদের মূর্তি ভাঙতে লাগলো । মানুষ আস্থা হারিয়ে দড়জা বন্ধ করে দিলো ।  কালবেলায় দেখি সেই কথারই প্রতিধ্বনি – “ অনিমেষের ভুল ভাঙল একসময় । যেটা করেছে সেটার জন্য দেশ তৈরি ছিল না । আন্দোলনের সময় যে বন্ধুক নিয়ে লড়াই করতে যাচ্ছে, জানি না সে বন্দুকের ভিতর গুলি ছিল কিনা । এমন একটা পরিবর্তনের জন্য  দেশ তৈরি নয় । আমাদের মধ্যে কয়েকজনের ভেতরে যে আগুন আসছে সেটা সারাদেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারব না । এই ভ্রান্তিটা তো, এক সময় ভাঙল ।” 

   রাজনৈতিক বিশ্বাসে ছিলেন নিজের প্রতি প্রবল আস্থাশীল । এখানে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক দলিয় রাজনীতি বা ক্ষমতার কাছে প্রণত হন নি । সে বাম জামানায় হোক বা মমতা জামানায় হোক, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়েছেন । ২০১১-এর ফেব্রুয়ারীতে ঢাকায় আসেন তিনি । সেই সময় ফরিদ কবির ও সাখাওয়াত টিপু সমরেশ মজুমদারের একটি সাক্ষাৎকার নেন । সেখানে তিনি পরিস্কার ভাবে বলেন যে ‘মানুষকে ভাগাভাগি করা হয় রাজনৈতিকভাবে । এটা তো হওয়ার কথা ছিলো না । এই যে বন্যা হয়, সেখানেও ত্রাণ নিয়ে রাজনীতি হয় । … এই রাজনৈতিক দ্বিচারিতার কারণে তখন বিরূপ ভাবনা এলো । পশ্চিমবাংলা জুড়ে খাদ্যাভাব চলছে । আন্দোলন হচ্ছে । পুলিশ লাঠি চার্জ করছে । পুলিশ বলছে, “জাতীয় সম্পদ রক্ষা করতে, জান-মাল  বাঁচাতে‌ যারা ট্রাম-বাস পোড়ায় তাদের গুলি করা হবে ।”  যার ফলে সেদিন পুলিশের গুলিতে লাশ পড়ে । আমিও ছিলাম সেদিন । আমি বেঁচে গিয়েছিলাম ।  লাশ নিয়ে টানাটানি হল । মিছিলকারীরা ভাবল তাদের দলের লোক । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ছেলেটা কে? আমি কে? এটা একটা গ্রেট প্রশ্ন । ওই যে ছেলেটা রাজনীতির শিকার হয়ে সতের বছর বয়সে জীবন দিয়ে দিল, এটা একটা মারাত্মক ঘটনা । সে কে ? এই প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমি ভাবলাম, ছেলেটা বেঁচে গেছে । ’

   জলপাইগুড়ি শহরে সমরেশ মজুমদারের আপনজন,  প্রিয় বন্ধুরা ছিলেন অশোক গঙ্গোপাধ্যায় অনুপ ঘোষ, কল্যান সিকদার । সেই সময় এঁরা বের করতেন ‘উত্তপ্তদেশ’ । ‘উত্তরদেশ’এর সাহিত্য আড্ডায় তিনি হাজির থাকতেন এই শহরে এলে । কিন্তু জলপাইগুড়ির সাহিত্য ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটোনাটি ঘটে ১৯৮৩র শীতে । সেবার ‘শক্তি সঙ্ঘ’ একটি বড় আকারে সাহিত্যানুষ্টান আয়োজন করেছিলো ।   রবীন্দ্রভবনে আয়োজিত সেই সাহিত্যানুষ্টানের পেছনে সমরেশ মজুমদার ছিলেন প্রধান পুরুষ । এসেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সঞ্জীব চট্টোপাধায়, দিব্যেন্দু পালিত, বিমল দেব প্রমুখ । টিকিট বিক্রি করে সাহিত্যানুষ্ঠান এই শহরে হয়েছিল, সফল আয়জনে । এরপর আবার এমন আয়োজনের  কথা ভেবেছিলেন তিনি, কিন্তু দ্বিপাক্ষিক ব্যাস্ততা, তাঁর অসুস্থতায় আর হয়ে ওঠে নি ।

   ২০১৩-তে দ্যোতনা’র ‘ভাষাচর্চা’ সংকলনের প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন । সেদিন আলাপচারিতায় বলেছিলেন – প্রবন্ধ খুব একটা পড়ি না, লিখিও না, লিখলে নিজের লেখা ক্ষতিগ্রস্থ হতো । তবে এই কাজ আমার শহরে বসে তুমি করছো এটা আমাকে অবাক করেছে । কলকাতায় এসো, আমি যথাসাধ্য সহযোগিতা করবো তোমাদের । কিন্তু সেই যাওয়াটাই আর হয়ে ওঠেনি ।

   গত কয়েকদিন তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়েছেন, আমাদের আফসোস তাঁর অন্তিম ইচ্ছা পুরণ হওয়ার আগেই তিনি চলে গেলেন । তাঁর খুব ইচ্ছে ছিলো এই জলপাইগুড়ি শহরে এসে সাইকেল রিক্সায় ঘুরে বেড়ান, যেমন শেষবার এসে ঘুরেছিলেন, বা আগেও এলে ঘুরে বেড়াতেন – রামদার চৌধুরী ম্যাডিক্যাল, গ্রন্থভারতী, রামঘোষের মিস্টির দোকান,  একবার অবশ্যই তাঁর ঘুরে যেতে হতো অন্তরের বন্ধু অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের কদমতলার বাসায় ।  সময় করে ঘুরে আসতেন বৈকুন্ঠপুর জঙ্গল, তিস্তা নদীর পার । গত মাসে একবার ফোনে তার সঙ্গে কথা হল, বারে বারে বলছিলেন এই ডিসেম্বরে আসবেন তিনি । কদিন নিরিবিলিতে ডুয়ার্সে কাটাবেন, এরপর দুদিন জলপাইগুড়ি শহরে । দিন পনের আগে অশোক বাবুকেও টেলিফোনে সেই কথা জানান বলে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে জানালেন সমরেশ মজুমদারের অশতিপর এই প্রিয় বন্ধুটি । আমাদের যাবতীয় স্বপ্ন ও ইচ্ছেগুলোকে নিয়ে তিনি চলে গেলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে ।

===================================

গৌতম গুহ রায়: কথসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

মোহন্তপাড়া, জলপাইগুড়ি

===================================