You are currently viewing ফ্রিদা কাহলোর হরিণ> বদরুজ্জামান আলমগীর

ফ্রিদা কাহলোর হরিণ> বদরুজ্জামান আলমগীর

ফ্রিদা কাহলোর হরিণ
বদরুজ্জামান আলমগীর

দশকী হিসাবে বিষ্ণু বিশ্বাস আট দশকের কবি। আশির কবিতায় যে চল, ও উজান ঠেলে এগুনোর ঝিলিকগুলো কবিতার পাঠক- আরও সুনির্দিষ্টভাবে বললে, কবিতার দর্শকশ্রোতার দৃষ্টি ও মনগোচর হয়, তাকে কবিতা আলোচনার প্রাতিষ্ঠানিক পরিভাষায় বলতে গেলে কথাটি দাঁড়ায় এমন- আমাদের আশির কবিতা প্রধানত রোমান্টিক রাজনৈতিক জাগরণের কবিতা; আরও কাছাকাছি ও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে চাইলে রাজনৈতিক জাগরণ শব্দবন্ধের জায়গায় রাজনৈতিক সরবতার কবিতা বললে অধিকতর ন্যায্য হয় বলে ধারণা করি।

কবি হিসাবে বিষ্ণু বিশ্বাসের জন্ম ও স্থিতি সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ভরা কটালের সময়। বিষ্ণুও রাস্তায় আছেন- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহারে আর সকল বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মাতেন, আবুর চায়ের স্টলেও বসেন মাঝেমাঝে- যারা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাস্তা কাঁপায় তাদের আগ্রহে, সখ্যে আছেন কখনও বা ঢাকার তোপখানা রোড মোড়ে, সহসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মধুর ক্যান্টিনে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় তার, শাহবাগে, চারুকলার সামনে, বা বকুল তলায়ও আছেন বিষ্ণু বিশ্বাস- কিন্তু তাঁর কবিতায় স্বৈরাচার নিপাত করা আন্দোলনের আঁচ সেভাবে নেই।

অনেকে আছেন একাডেমিকেলি সাহিত্য পড়েন- কথায় কথায় বোদলেয়ার, টিএস এলিয়েট আর স্যাফোর নিচে নামেন না- পশ্চিমা এনলাইটেনমেন্ট যাদের উন্মোচনের দিশারি- মোটেও বিষ্ণু সেই দলে পড়েন না; বিষ্ণু ঢাকার ধূলামাখা ফুটপাতে বসে চা খায়, শাহবাগ পিজি হাসপাতালের পিছনে দাঁড়িয়ে হিসু করে, ইনফ্যাক্ট বিষ্ণু বিশ্বাসের সঙ্গে আমার দেখা হয় ওই পিজি হাসপাতালের পিছনে মূত্রযজ্ঞ কালে, মনে পড়ে। ওখানেই প্রথম দিনের সূর্য কহে, পরে কতোবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে- তার লেখাজোখা নাই।

এই যে উপস্থিত নিরুপস্থিতি- এখানেই বিষ্ণুর বিশিষ্টতা। এর কারণগুলো নানাদিক থেকে উল্টেপাল্টে দেখা যায়।

১৯৮০-৮১ তো সেদিনের কথা, এর অনেক আগেই বাঙলা অঞ্চলে এই বীক্ষা গৃহীত হয়েছে যে, উন্নীত আধুনিক কবিতা ব্যক্তির নিজস্ব ক্ষরণ থেকে উৎসারিত হয়, জনপদের ওঠানামা কবি’র বোধির সঙ্গে মেশে না- গৃহস্থের সামষ্টিক পাশফেরা কবিতায় বিন্যস্ত করলে তা ক্লিশে হয়ে যায়। তথাপি সবকিছু ছেড়েছুড়ে সম্পূর্ণ আড়ালে আবডালে থাকা সম্ভব নয় বিষ্ণু বিশ্বাসের পক্ষে। কবির ভাগ্য নিচের এই অনুষঙ্গে নিদারুণভাবে দেখতে পাই আমরা :

লুইজ গ্লিকের দ্য মিথ অব ইনোসেন্স কবিতায় একটি অসামান্য প্যারা আছে- যেখানে একজন নারীর গার্হস্থ্য জীবনের সামান্যতার ভিতর একটি গভীর সত্য উন্মোচিত হয়-

সূর্য জলের নিচে- তাকালে মনে হয়, / এই তো সূর্য দূরে নয় মোটে / নাগালের ভিতর। তার জেঠা বুঝি ওর পিছনে লেগে আছে / কাছেই, তাকে চোখে চোখে রাখছে। দিন দুনিয়ার যা কিছু আছে / ধরে নেয় সবই কোন না কোনভাবে তার আত্মীয়। সে ভাবে, আমি কখনই একা নই, / একলা কেন হবো- / আমি সব চিন্তাকেই প্রার্থনায় বসিয়ে দিই, / তার জবাবে মৃত্যু আমাকে তুলে নেবে।

অবুঝের পুরাকথা কবিতায় মেয়েটি সংকটে দুর্ভাবনায় কতো সহজে একটি সমাধানের খোঁজ পেয়ে যান- তিনি তার সমূহ ভাবনা, দুশ্চিন্তাকে প্রার্থনার ব্যাকুলতার সঙ্গে মিশিয়ে দেন, কিন্তু একজন কবি’র বেলায়, একজন বিষ্ণু বিশ্বাসের সামনে সেই পথ খোলা নেই; কবিতার সত্য প্রার্থনার জ্যামিতির বেড়ের বাইরে, তার কবিতাবোধির জন্য তাকে অবগাহন করতে হয়, মোকাবেলা করতে হয় ক্ষরণের মধু। ফলে বিষ্ণুর চৈতন্যেও দুঃসময় ধরা দেয় এভাবে-

ক্রোধ ও স্বপ্নের এই সম্মিলন কেন / সিংহ ও সিংহিনীর রতিস্থানে? / কেন মৃত্যু, আরো মৃত্যু? / মৃত্যু, প্রতিটি ঘরের ভিতরে এবং বাহিরে / আমরা বাঁচতে না বাঁচাতে চেয়েছিলাম / আমি জানি না / তবু মৃত্যুর আকর্ষণ প্রতীকী ও বাস্তব / অন্বেষী ও অন্বিষ্ট।
বুলেট- প্রতি মৃত্যু, বহুমৃত্যু / বলো হরি, হরিবোল / চাপা কান্না লজ্জাবনত / মানবিক ও বিবেকহীন / বলো হরি, হরিবোল
পুরাণ- যুদ্ধের মতো অমাত্য / কর্ণ ও অভিমন্যু সংকট  / বলো হরি, হরিবোল / মৃত্যু এখন খড়ের গাদায় / আর ভ্যানে নিত্য পা দোলায়।

বিষ্ণু বিশ্বাসের কবিতাযাত্রার একটি গ্রাফ তৈরি করলে দেখা যায়- তিনি কবিতা বিনির্মাণ বিদ্যায় আরাধ্য করেছেন তিরিশের কবিতা। অবশ্য তিরিশি কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসুর চলন তাঁর মধ্যে নেই, অনুপস্থিত বিষ্ণু দে এবং অমিয় চক্রবর্তী। কাব্যবিশ্বাস ও কবিতা বিন্যাসের চারুবিদ্যায় বিষ্ণু কেন্দ্রে রেখেছেন প্রধানত জীবনানন্দ দাশ, এবং তারসঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে।

জীবনানন্দ দাশ এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত- আলাদা দুই ঘরানার কবি। দুটি বিরোধাভাসকে একান্নবর্তিতার যৌগে মিলানোর চেষ্টা তেমন একটা দেখা যায় না। এক্ষেত্রে বিষ্ণু বিশ্বাসের এই উদ্যোগ একটি মৌলিক প্রেষণা। বিষ্ণু বিশ্বাসের একটি কবিতার অংশ পাঠ করে দেখা যায়- জীবনানন্দ দাশ এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কেমন করে একঘরে বসত করেন।

নিচের কবিতায় আছে জীবনানন্দ দাশীয় রূপগন্ধময় ইতিহাসের চিত্রল অন্তর্লোক, আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক বোঝাপড়া। কবিতাটির বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গে বাক্য, বাক্যবিন্যাস এবং চিত্রকল্পে মন ও মননে যূথবদ্ধতার চিহ্নটুকু বোঝা যাবে-

উড্ডীন, বঙ্গোপসাগর / ঢেউয়ের সংঘর্ষে ঢেউয়ের স্ফূর্তি / নোনতা বালির স্ফুরণ স্ফটিকী / গভীর সমুদ্রঘূর্ণি ঘুরে ঘুরে / উড়ন্ত চাকতির মতো নামে ধীরে ধীরে / সঙ্কটাবর্তে; / জলজ গম্ভীর শব্দে, ঝংকৃত /
মিশ্রিত শব্দের আকাশ এবং আলো / গাজনের ঢোলের রুদ্র নৃত্য / লৌকিক প্রতিবিম্বের যেন বজ্রকন্ঠ : / উঠে পড়ো, / বেঁধে নাও দড়াদড়ি / স্বর্গ মর্ত্য / স্বর্গের মর্ত্যের দেবী ও দেবতা / থাকো জাগ্রত / সময় বুঝে নেবে দুঃসময় দুর্মুক্তি / প্রথানির্দিষ্ট / আমাদের ছেলেরা সাগর সন্তান / মেয়েরা সমুদ্রে চলে নদীর মতন।
বিষ্ণু বিশ্বাস : ভোরের মন্দির ২।

এ-তো দুই ভিন্ন ব্যক্তিত্বের কবি’র বিষ্ণুর কলমের ঝর্ণাতলায় একঘাটে জলপান; অন্যদিকে তিনি এই দুই দিকপাল কবি-কে কী বন্দনায় গাঁথেন- তার নমুনাও দেখা যায় : তিনি একটি কবিতা লিখেছেন জীবনানন্দকে নিয়ে, আরেকটি কবিতা আছে সুধীন্দ্রনাথের জন্য; এবার ওই দুটি কবিতা পাশাপাশি পাঠ করে দেখি- তাঁদের জন্য তাঁর ভক্তির অভিব্যক্তিটুকু কেমন-

পেঁচার সবান্ধব চিৎকার / আয়ুহীন স্তব্ধভূমিতে মৃত্যুর ঘোষণা / প্রান্তিক অঘ্রাণের শীতে, ধূসর জ্যোৎস্নায় /
সবুজ শুয়ে আছে। গ্যাংগ্রিন। সাদা ব্যান্ডেজ জুড়ে রক্তাভ ফুলের কৃকলাস /

চোখে নীল। নীলাকাশ / কারো পদধ্বনি!

হয়তো উজ্জ্বল হয়ে আসে পৃথিবী / কুয়াশার বুকে ভেসে আসে ঝর্ণার সঙ্গীত

কিন্তু ঘুম কানে বধিরতা বোধের অতীত / ঘোড়ার চোখের মতো সবুজ তারার অট্টহাসি দেখে /
নৈঃশব্দ্য।
নির্বেদ : জীবনানন্দ স্মরণে, তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও।

এবার সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-কে নিয়ে লেখাটি পড়া যাক।

মধ্যাহ্নচূড়ার থেকে নেমে আসে সূর্য, / পাথর প্রচ্ছদের ভিতরে হর্ষধ্বনি স্রষ্টার /মৃত্তিকার রস ঊর্ধ্বে উৎসারিত স্বাদে / ( তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে ) / দুর্মর ইচ্ছার ধনু করে রক্তপাত।

যুদ্ধযানে পুরোহিত অধোমুখ মেশিনগান / ছায়ার বৃত্তে গড়ে সূর্য- সূর্যাস্ত /

চৈতন্য নির্বেদের শীতল স্পর্শ / জ্বালে আগুন, জ্বলে ক্যাকটাস।
বিষ্ণু বিশ্বাস : সুধীন্দ্রনাথ।

উপরের ৩টি কবিতার শৈলী, তাদের স্থাপত্য, দার্শনিক বিবেচনা- সবকিছু মিলিয়ে এটুকু বোঝা যায়, বিষ্ণু বিশ্বাস কেবলা করেছিলেন জীবনানন্দ দাশে।

একে তো জীবনানন্দ দাশের রেশ বারবার কবিতার সজ্জায় মনে আসে, তারউপর জীবনানন্দীয় উপমার ব্যবহার দারুণভাবে জীবনানন্দ দাসকে মনে করিয়ে দেয়। সরাসরি জীবনানন্দ দাশ বুঝি পৃথিবী,  কন্যাকুমারী, নির্বেদ, টেলিগ্রাম, রাত্রি, শেষকৃত্য, ম্যুজিয়ম- কবিতার পয়ারে পয়ারে ভর করে আছে।

এ-বেলায় এসে বিষ্ণুর  কবিতায় জননির্লিপ্তির প্রকৃত কারণটি খুঁজে পেতে ইচ্ছা করে। বিষ্ণু বিশ্বাসের অজানা থাকবার কোন কারণই নেই যে, জীবনানন্দ দাশ বিশ্বক্ষমতা রাজনীতির বীভৎস এককেন্দ্রিকতার গণ্ডারিপনা বিষয়ে কতোটা সজাগ ও উদ্বিগ্ন ছিলেন।

জীবনানন্দ দাশ পৃথিবীর রুগ্নতা, তার আগ্রাসনের ভয়ে কতোটাই জড়োসড়ো হয়েছিলেন। কেবল অন্ধকার কবিতাটি পড়লেই তাঁর জঙ্গমতাটুকু হয়তো বোঝা যাবে:

বুঝতে পেরেছি আবার; / ভয় পেয়েছি, / পেয়েছি অসীম দুর্নিবার বেদনা; / দেখেছি রক্তিম আকাধে সূর্য জেগে উঠে / মানুষিক সৈনিক সেজেপৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়ায়াবার জন্য / আমাকে নির্দেশ দিয়েছে; / আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়- বেদনায়- আক্রোশে ভরে গিয়েছে ; /
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি-কোটি শূয়োরের আর্তনাদে / উৎসব শুরু করেছে।
জীবনানন্দ দাশ : অন্ধকার।

জীবনানন্দ দাশে ভয় ও নিমগ্নতা ধারাবাহিক, বিষ্ণু বিশ্বাসে ভয় ও নিমগ্নতা দুই-ই আকস্মিক। বিষ্ণু বিশ্বাসকে অনুধাবন করার ক্ষেত্রে ৩টি বিষয় ঘষেমেজে দেখার কথাটি আমার মাথায় আসে :

১। ভিতরে ভিতরে ইতিহাসের চালচিত্রটি তাঁর বোধের মধ্যে ছিল- সামরিক শাসনবিরোধী যে আন্দোলন হচ্ছিল তার প্রাণভোমরায় বিষ্ণু মানুষের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক মুক্তির প্রকৃত বীজানু দেখতে পাননি, ফলে সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তাঁকে আমূল উদ্বুদ্ধ করেনি।

২। পারিবারিকভাবে, তাঁর ডিএনএ-তে আত্মহননের সাকল্য ঘূর্ণাবর্ত ছিল। তাঁর জন্মদাতা বাবাও আত্মসংহারের পথ বেছে নিয়েছিলেন। ফলে কখনোই তিনি পরিকল্পনামাফিক নিজেকে কোনকিছুতেই স্থির করে উঠতে পারেননি।

৩। দেশভাগের পরম্পরায় বিষ্ণু বিশ্বাস নিজের দেশেই উদ্বাস্তু ছিলেন, কখনোই নিজের জন্মভিটায় সাতপুরুষের দৃঢ়, নির্বিঘ্ন নোঙর পুঁতে বসতে পারেননি- জীবনভর নামহীন গোত্রহীন কচুরিপানা হয়ে ভাসছিলেন।

এভাবেই আমাদের কবিতায় একটি নতুন প্রবণতা তৈরি হয়। বিষ্ণু বিশ্বাস একা নয়, আশির কবিতা একটি প্রবণতা। আশিতেই কবিতা একপ্রকার তীর্থযাত্রায় আগুয়ান হয়- হয়তো আমাদের কবিতায় গাম্ভীর্যের অনড় একটা ভঙ্গিমা গঠিত হতে থাকে, কিন্তু ওখান থেকেই কবিতা সাধারণ পাঠকের আঙিনা পেরিয়ে বিশেষজ্ঞ পাঠকের সরু টানেলের ভিতর ঢোকে পড়ে।

আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখি, বিষ্ণুর কবিতায় চকিতে খানিক রবীন্দ্রনাথ আসেন, আছে তিরিশের আধুনিক কবিতার মুন্সিয়ানা- কিন্তু ওখানে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ নাই, নাই শহীদ কাদরী, বা মোহাম্মদ রফিক- তাঁরা যে পূর্ববাংলার একটি নিজস্ব স্বর বিম্বিত করেছিলেন তা আশির কবিদের কাছে তুল্যেমূল্যে উবে যায় ; খুব নজর করে দেখলে হয়তো আবুল হাসান অতি সামান্য চোখে পড়ে।

বাংলাদেশের কবিতায় আবুল হাসান শেষ কবি যিনি শৈল্পিকভাবে রাজনৈতিক সামাজিক আর্তির কথাটি কবিতায় বিন্যস্ত করেন। তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতি অভিমানের কবিতা আবুল হাসানও পুরো জনপদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়টি যেন বিবৃত করে:

সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র, / মায়াবী করুণ / এটা সেই পাথরের নাম নাকি?  এটা তাই? /এটা কি পাথর নাকি কোন নদী? উপগ্রহ? কোন রাজা? / পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্নাভেজা চোখ? মহাকাশে ছড়ানো ছয়টি তারা? তীব্র তীক্ষ্ণ তমোহর /কী অর্থ বহন করে এইসব মিলিত অক্ষর?
আবুল হাসান : আবুল হাসান।

আশির ভিতর দিয়ে আমাদের কবিতার বাঁকান্তরটি ঘটেছে এভাবে- বাংলা গানের গভীর সাত্মিক ধারাটি রবীন্দ্রনাথে এসে শেষ নোঙরটি ফেলে- যে সাঙ্গীতিক মোড় থেকে আধুনিক গানের ধারার শুরু- যার উদ্বোধক সাঁকো কাজী নজরুল ইসলাম। কবিতায় রাজনৈতিক আর্তির শেষতম কবি আবুল হাসান, আর সেই কবিতাকে জনপদের বাইরে এনে ব্যক্তির নিজস্ব অভিব্যক্তির ধারায় উন্নীত করার সাঁকো খোন্দকার আশরাফ হোসেন।

সব হাওয়ার ভিতরেই অদৃশ্য তীর আছে- কবিতার ভরা কটালে সে-ই সৌভাগ্যবান যে ওই অদেখা তীরের ফলায় বিদ্ধ হবার মহীয়ান দুর্ভাগ্য অর্জন করে- বিষ্ণু বিশ্বাস সেই বিরলপ্রজ কবিদের একজন। কিন্তু আমরা কিছুটা কুন্ঠিত হয়ে উঠি, যখন দেখি বিষ্ণু বহুলাংশেই ব্যক্তিগত দুঃখের মর্মের কাছে মুহ্যমান হয়ে থাকেন। কবিতার ইতিহাসে অনেক কবি-কে আমরা পাই- যাঁরা নিজের জীবন বাজি রেখেও ধারালো তরবারির উপর দিয়ে হেঁটে যান, আর তাঁরা রচনা করেন কী অসামান্য হীরক জ্যোতি।  রাশিয়ান কবি আন্না আখমাতোভা তাঁদের একজন- একের পর এক ক্ষমতাজান্তার পাশবিকতার মুখের উপর তাঁর পয়ার লিখে গ্যাছেন- তিনি মৃতদের নিয়ে শীতার্ত তারাবাতি লেখেন- তারা নয়- মৃত মাছেদের অবিসংবাদিত চোখ লেখেন- যে মৃত্যুর পরও চোখের পাতি ফেলে না।

বিষ্ণুর গোটা কবিতার কাল থেকে গেল এক প্রকাশিত আড়াল হিসাবে, কোনদিনই তাঁর লেখালেখির অঙ্গনে নিজের স্বত্ব তৈরি হয়ে ওঠেনি- তার চেয়ে পরিতাপের বিষয় আর কী-ই বা হতে পারে! দুনিয়ায় সফল ডায়াস্পোরা সাহিত্যের এন্তার নমুনা আজ হাজির করা যায়, কী বলা ভালো- একবিংশ শতাব্দী ডায়াস্পোরা সাহিত্যে ভাসমান, ডুবোডুবো। কিন্তু বিষ্ণু বিশ্বাসের মানসিক সঙ্কট হয়তো কেবল আমাদের বাঙলা অঞ্চলেই পাওয়া যাবে : একজন লেখক নিজের দেশেই আছেন, কিন্তু আসলে উদ্বাস্তু, এ এক নতুন ঘরানার ডায়াস্পোরা।

বিষ্ণু বিশ্বাস চুঁইয়ে পড়তে থাকা এক রক্তফোঁটার নাম- যা থাকতে চায় অন্য স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহের সঙ্গে, কিন্তু তার উপরে চামড়া কেটে আলাদা, দুইভাগ হয়ে গ্যাছে।
হি ইজ ইন হোমল্যান্ড, বাট ফেইসিং অল বিটারস অব আদারনেস। মহাকালের এমনই এক খাঁড়ার নিচে আতঙ্কে ঘামছিলেন বিষ্ণু বিশ্বাস- ঘরে তার বাড়ি ছিল না, বাইরে ছিল না উন্মুক্ত দিগন্ত ও বাহির। বিষ্ণু ফ্রিদা কাহলোর হরিণ যার পিঠে বিদ্ধ হয়ে আছে তীরের ফলা, কিন্তু মুখখানি পবিত্র আর মিনতি মায়ায় ভরা।

তাঁর প্রতিটি ক্ষণ শ্বাপদে সংকুল, পুরো প্রতিবেশ এক গায়েবানা জানাজা- লাশ হারিয়ে গ্যাছে, কী মিলে গ্যাছে কালের প্রবাহে, কিন্তু অদৃশ্য লাশ সামনে রেখে সবাই জানাজায় শরিক। বিষ্ণু সম্মুখেই আছেন, কিন্তু সম্মুখবর্তী নন- তিনি ভিড়ের মধ্যে একা, বাবরি মসজিদ দখলের, ভাঙনের দায়ও তাকেই নিতে হবে- তার নাম যে বিষ্ণু বিশ্বাস।

সামরিক শাসনের ত্রাসমহলে বিষ্ণুর উত্থান। কিন্তু কোথাও সামরিক শাসনের উচ্ছেদে একটি লাইন বিষ্ণুর নাই- যা আবুল হাসানের সমকক্ষ। রাস্তার অগ্নিকম্পনের মধ্যেও বরং প্রকৃতির অজস্র সুন্দর বিষ্ণুকে যুক্ত করে সৃষ্টির আদি ওঙ্কারের সাথে, তার প্রাণচূর্ণ রৌদ্রকণার বিচ্ছুরণে একান্নবর্তী হয়ে ওঠে অন্তর্মুখী পথযাত্রায়।

ছন্দের কাঠিন্যে না বেঁধে মুক্তছন্দে কবিতা লিখেছেন বিষ্ণু বিশ্বাস, কখনও পয়ারে লেখেননি।

কবি জানেন তার কবিতার ঝরাপাতা ক্ষমতার, রাজনীতির, উন্নয়নের খরা বাতাসে উড়ে যাবে- কিন্তু কবি ক্ষমতার কাছে জোড়াত করবে না, বলবে না- তাকে আলাদাকরে বাঁচিয়ে রাখা হোক, একথা বলবে না কবি।

ভোরের মন্দির কবিতায় এমনই এক মন্ত্রবোধি শিমূল তূলার অঙ্কুরে ফাটে-

আদি পিতা, তোমার আদ্যধ্বনিকল্লোল / অবিনশ্বর শব্দের আজ চাঁদের হাট, দ্যাখো / স্বর্গত্যাগী ফুল ঝরেছে বকুলের বনে / ধূসর মেহগনি ফাটিয়েছে সমস্ত ফল / আমরা মাটি খুঁড়ি, তুলি বালি, তুলি জল / মাটির গভীর থেকে সমলয় নৃত্যে আসে / বালির আড়ালে ধ্বনি, / মুক্তি৷ সাধনা, শক্তি।

অনেক কবির মধ্যেই মৃত্যুচিন্তা একটি বড় অনুষঙ্গ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে, জালালউদ্দিন রুমির ধ্যানে মৃত্যু এক সখাপ্রাণ, জীবনানন্দ দাশে মৃত্যু নির্বাণ, এমিলি ডিকিনসন মৃত্যুকে মোকাবেলা করেন একটি ল্যাবরেটরিতে জান্তব সংহারের অভিব্যক্তি হিসাবে। তাদের সবার কাছে মৃত্যু কাল ও প্রকৃতি নির্ধারিত, চিরায়ত; কিন্তু বিষ্ণু বিশ্বাসের কাছে মৃত্যু আকস্মিক, আততায়ী, অনির্ধারিত ও আতঙ্কজনক।

মৃত্যুচেতনা কথাটির মধ্যে একটি আয়েসি ও স্বস্তির বিস্তার আছে, মৃত্যু অনেক কবির মর্মে এক আশ্রয়ের আলিঙ্গন, সামিয়ানা- বিষ্ণু বিশ্বাসে ঘুরে ঘুরে মৃত্যুর কথা আসে, কিন্তু তার মৃত্যুর মধ্যে গোলাপজল মিশানো নেই, নেই চন্দনকাঠের গুঁড়া। মৃত্যু তার কাছে ওঁৎপাতা সংহারের কল। মৃত্যুমগ্নতার কয়েকটি কবিতা একসাথে মিলিয়ে পড়ে দেখি, তাতে বিষ্ণুর জীবনের জন্য কাঙালপনাটুকু হয়তো বোঝা যাবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : গান।

জীবন যখন শুকায়ে যায় / করুণাধারায় এসো / সকল মাধুরি লুকায়ে যায় / গীত সুধারসে এসো/ জীবন যখন শুকায়ে যায় / করুণাধারায় এসো।

কর্ম যখন প্রবল আকার / গরজি উঠিয়া ঢাকে চারিধার / হৃদয়প্রান্তে হে নীরব নাথ / শান্ত চরণে এসো /

জীবন যখন শুকায়ে যায় / করুণাধারায় এসো।।

জালালউদ্দিন রুমি : মৃত্যুর গুমর।

মৃত্যু এক অনন্ত যাত্রার সঙ্গে বিবাহ।
এ কিসের গুমর? পরমেশ্বর তো অখণ্ড।

সূর্যালোক জানালা গলিয়ে ঘরে ঢোকার বেলায়
ভেঙে চিলতা হয়।
আঙ্গুর ফলের বাকল বহুবিধের যৌগ,
কিন্তু আঙুরের রসে কোন ভাগ নেই।

যে ঈশ্বরের আলোর নিরিখে বাঁচে
মৃত্যুর ফলে তার আত্মা আরেক বর্ধিত উদযাপনে
অধিষ্ঠিত হয়।

যে চলে গ্যাছে তাকে আর ভালো-মন্দের তকমায় বেঁধো না,
বরং তোমার চোখ একাগ্র করো ঈশ্বরে;
যে অদৃশ্য তাকে নিয়ে বেহুদা কথা বলো না-
সে হয়তো তোমার দৃষ্টির অতলে ভর করে আছে।।

এমিলি ডিকিনসন : মরণকালে আমি মাছির গুঞ্জন শুনেছিলাম

আমি যখন শেষবারের মত চোখ বুজি
শুনি চারদিকে মাছি ওড়ে, ঘোরে ভনভন।
ছোট ঘর নৈঃশব্দ্যে থমথম,বাইরের বাতাসে নীরাগ;
ঝড়ো তাণ্ডবের মাঝে এক ফোকর নীরবতা-

ঘরে ঠাসাঠাসি হৃদজনের চোখে নিরাশা-
বুকের ভিতর জমতে থাকে ভারী শ্বাস,
উদ্বেগে নিরাশ্রয় জোড়াজোড়া চোখ-
কখন এ-ছোট্ট ঘর থরথরিয়ে কেঁপে উঠবে
নিরঙ্কুশ রাজার পদভারে-

আমার যে সব দিতে হবে সে-তো আমি জানি
পথ চেয়ে নিজের সবটুকু অঞ্জলি করেছি সমর্পণ-
পসরা হাতে আমি একপায়ে খাড়া
কোত্থেকে এলো এক যাত্রাভঙ্গের মাছি!

আমি ও আমার মাঝখানে দ্বিধার পর্দা
অন্ধকারে ভেঙে পড়ে আলোর সাঁকো-
আমার সব দেখা অধিগ্রহণ করে
অদেখার পাষাণ।।

বিষ্ণু বিশ্বাস: ভয় শেষে।

মাঝে মাঝে ভয়ে থাকি বিপুল আঁধার মাঝে এক
মেশার সংশয় থাকে আগামীর অন্ধকারে জেগে।
কেবল মৃত্যুর দূতী গাছ থেকে চুপি চুপি নেমে
আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকে, থাকে শুধু দাঁড়িয়ে, ডাকে না।
পরিচিত বন্ধুদের শব কোন্ শ্মশানের ঘাটে
পুনর্বার মরতে দেখি- নিহত ছুরিকাঘাতে। কী যে
বিষন্ন বিপদে রাত্রি,রাত্রি শুধু রাত্রি চতুর্ধার।।

অথবা পুষ্পদম্পতি কবিতাটি এমন:

মাঝে মাঝে মনে হয় কখনও নিশ্চয় / খুন হবো আমি / লাল রক্তধারার বলিষ্ঠ এক স্রোত / আলতার আল্পনায় রাঙাবে একখানা পাতা / যার রঙ মূলত হলুদ, / যে মূলত ঝরা। এইখানে / একটি গল্পের শুরু এবং সারা-ও হতে পারে।

শেষপর্যন্ত একটি হাহাকারের সাথেই সামিল হলেন বিষ্ণু বিশ্বাস। অনিকেত প্রতিবেশকে জেরা করে, কবিতার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত করার প্রবল অধিকার বিষ্ণুর ভাগ্যে জোটেনি, ফলে অশ্রুপাতের নিয়তিতে পাই, চাক্ষুষ রক্তমাংসে তেমন করে পাই না। প্রাকৃতিক মৃত্যুর বাতাবরণ তো আদতে একটি অধিকারেরই প্রশ্ন, একজন ভাবদুনিয়ার মননশীল মানুষ তা নিজের একান্ত আনন্দ-বেদনার সঙ্গে মেলাবেন তাই তো স্বাভাবিক। নিজগৃহে আগন্তুক বিষ্ণু বিশ্বাস তা পারেননি, পল সেলান হয়তো পেরেছিলেন।

পল সেলান তাঁর ডেথ ফিউগ কবিতায় জীবন, মৃত্যু, বন্দী শিবির, পরাবাস্তববাদিতায় তুলে এনেছেন তা সত্যি অনন্য। জার্মানদের ইহুদি নিধন, তাদের উপর সীমাহীন নির্যাতন এক অনবদ্য রাজনৈতিক ও শৈল্পিক উচ্চতায় উঠে এসেছে। একচ্ছত্র ক্ষমতার দাপট, ধর্মীয় মিথ্যাচার,সাদা দুধ বনাম নিকষ কালো দুধ, মুখোমুখি সূর্যালোক ও রক্তের মেঘলাল, সোনালি চুলের মার্গারেট আর ইহুদি পুয়াণের চিহ্নমাখা ধূসর চুলের শুলামিথ, মাটিতে কবর না হয়ে হাওয়ায় ভাসতে থাকা কবরের মর্মন্তুদ- সব স্তর, লৌকিক আর পারলৌকিকতার সীমানা ডিঙিয়ে ডেথ ফিউগ কবিতার অঙ্গনে এক বিরল দিশা।

বিষ্ণুকে বলা হয় বাংলাদেশের বিনয় মজুমদার। তাদের মধ্যে কোন সাযুজ্য সত্যিই আছে কী? একটি সাত্মিক কথা বলতে গেলে যেভাবেই বলা হোক তা রবীন্দ্রনাথের মত লাগে, মহাকালের অসীমের তলে ব্যক্তির প্রাণের অসহায় আকুতিটুকু বলতে গেলে তা জীবনানন্দ দাশের কথা মনে করিয়ে দেয়, নাগরিক জীবনে হয়রান ও বিধ্বস্ত হয়ে খিস্তি পাড়লে মনে হয়, আরে, এ-তো চার্লস বুকোভস্কি।

দুনিয়ার লাঞ্ছনায় বিস্রস্ত হয়ে কেউ যদি কবিতার পয়ারে তা চয়ন করে তাহলে হয়তো কোন না কোনভাবে তা জীবনানন্দ দাশের মত লাগে। বিনয় মজুমদারের মনোলোক মননভূমি জীবনানন্দ দাশের রূপবর্তী নয়, কিন্তু কোথায় যেন ফিরে এসো চাকায় জীবনানন্দ দাশের একটা পোঁচ লাগানো আছে। হতে পারে এটিই বাঙলা অঞ্চলের কেন্দ্রীয় আকুতি। বিষ্ণু বিশ্বাসের অয়দিপাউস কবিতাটা একবার পড়ে দেখা যাক।

আদিঅন্ত, পূর্ব-পশ্চিম, অতীত বর্তমান কালের হামানদিস্তায় ছেঁচে বিষ্ণু বিশ্বাসের এই কবিতা পাতালভেদী, মৃত্যুর খয়েরি রঙের লালে চোবানো।

অয়দিপাউস :

ওই পারে হাট বসে জামের ছায়ায় গোধূলিতে
ওখানে কুমারী মেলা লাল শাড়ি হলুদ পাঞ্জাবি
কোন জঙ্গলের দিকে ওরা চলে গেছে কামস্বাদে
শুকনো পাতার পর। ফিরবে না কোনদিন তারা।
এদিকে বিস্তর ঢাক সানাই কাঁসরঘন্টা বাজে
যুবক যুবতী সব বাজারের শোরগোল গড়ে।
যারা গিয়েছিল চলে, মনে হয়, ওর সন্ততিরা
মেরে রেখে সবান্ধবে এসেছে জয়ের লাল স্রোতে
আবার এ কোন হাটে? এখানে ছাগল বাঁধা, নীল।
প্রভাত হয়েছে, পাখি? তুমি ডাকো দেখি প্রাণ খুলে
চিনতে পারি না আমি এ উজ্জ্বল সূর্যগোলক,
তোমার সন্তান, ওরা আমাকে দিয়েছে অন্ধ করে
মাথায় কুমারী মেলা লাল শাটি হলুদ পাঞ্জাবি,
জোকাস্তা, আমার বউ, অ্যান্তিগোনি বোন, ও তনয়া।।

ওরা আমাকে দিয়েছে অন্ধ করে- এই লাইনের ভিতর এক মহাকাব্যিক দ্যোতনা বিন্যস্ত করতে পেরেছেন বিষ্ণু।

বিষ্ণুর আরও বহুদূর যাবার কথা ছিল। সাকল্যে তাঁর একটিমাত্র কবিতার বই পাই আমরা- ভোরের মন্দির; তা-ও তাঁর কবিতা থেকে নির্বাসিত হবার অনেক পরে। এটা ঠিক, বিষ্ণু কবিতায় আরও সংসারী হলে, অনায়াস হলে অয়দিপাউসের মত, ভোরের মন্দিরের উচ্চতায় আরও অনেক কবিতা পেতাম, হয়তো পেতাম কোন মহাকাব্য,  কিন্তু বিষ্ণুর আতঙ্কের ভিতরে আমরা দেখতে পাই- সুন্দরবনের আতঙ্কগ্রস্ত হরিণ মতিহার চত্ত্বরে আছে, আছে শাহবাগের মোড়ে।

বিষ্ণু বিশ্বাসের নিজের গুটিয়ে নেয়াকে, দেশান্তর হওয়াকে আমাদের সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার হার বলি আমি। সরিষার মধ্যেই ভুত আছে- অনেক ক্যামোফ্লেজ আছে ঢাকার বুদ্ধিজীবিতায়, যাদের ভাবি অশোকতরু আসলে তারা গাবগাছ; যাদের মনেহয় ধর্মনিরপেক্ষ নিরঙ্কুশ- তারা আদতে ক্ষমতার স্থাবক, তল্পিবাহক মাত্র- বিষ্ণু বিশ্বাসের জন্য, বিষ্ণু বিশ্বাসদের জন্য আমরা নির্ভীকচিত্ত ভরসাসুন্দর একটি পাটাতন গড়ে তুলতে পারিনি।

এ-বেলায় ঘোর লাগে, অমীমাংসা হয়, ধন্দে পড়ি। দিনশেষে, আমার নিজের লেখা একটি কবিতায় অবগাহন করি প্রিয় কবি, মেঘের কুমার, বনগাঁয়ে নক্ষত্রের ঘ্রাণের নিরলে মন্ত্র বলে যে বিষ্ণু বিশ্বাস- তাকে।

বনগাঁ :

ট্রেনে বিহার থেকে, কোলকাতা, বশিরহাট থেকে /
পাগল আসে, হেঁটে হেঁটে আসে, ট্রাকে এসে নামে, /
তারা বনগাঁ স্টেশনে এসে এমনি এমনি ঘোরে / পাগলেরা ট্রেন থেকে ঝরে পড়ে।

এমন নয় যে সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে বনগাঁ আসে / কেউ আসে বিড়বিড় করে- তাদের হাতে থাকে পুতুল- / পাটের পুতুল, লাল মাটির সরা।

ঝড়ের ঘোড়াধ্বনি কোথাকার গাছ / কোথায় উপড়ে নিয়ে ফেলে- সে খবর ডাকহরকরা / কাকেরাও কী জানে?

বনগাঁয় পাগলেরা খোলা আকাশের অবহেলার / নিচে জটলা পাকায়। / তারা পাতালে, সুরঙ্গ পথে মিঠাপানির মাছ হয়, / পদ্মা গাঙের ডিমওয়ালা ইলিশের হাটে মেশে।

তারা মনের অজানায় পুবদিকে শুঁকে দেখে- / এখনও কী সন্ধ্যা নামে লেবুঝাড়ের তলে!

আর কী-যে বান্নি, বান্নি জুড়ে গানের বৈঠকে নাচে /
কৈশোর, কাটা ঘুড্ডি, গিমাই শাকের দেশে-

উজান মাটি ভাটির দেশে উজানিয়া গাঙে /
কালিবাউশ পানির তলে ফজলি আমের রঙে /
মরতে আসে ধরতে আসে কালো কৃষ্ণের নামে!

নাচে আর মাছ হয়- মিঠাপানির মাছ, / চরে আটকা পড়ে লাফাতে থাকে নানচিল কোরাল।

একসময় বড় বড় ট্রেনের হুইসেলের নিচে গলাকাটা / ফোঁপানিগুলো / কোথায় হারায় বিদ্যুতি কৌশলে,

বনগাঁ স্টেশনে পাগল এসে নামে হাম্বা রবের ঢলে!

বদরুজ্জামান আলমগীর
কবি, নাট্যকার ও অনুবাদক