সায়াহ্নের রাগভৈরবী
সত্যজিৎ সিংহ
১
সন্ধ্যাবেলা ধূপ আরতি দেয়ার পর মুড়ি দিয়ে রঙ চা খেলেই তবে সারাদিনের ক্লান্তিটা ধীরে ধীরে কাটতে থাকে। একলা থাকার নানান ঝায়ঝামেলা- খানি যোগাড় করো, দারু যোগাড় করো, বাতের বেদনার জন্য সরিষার তেলের সাথে রসুন ছেঁচে অল্প আঁচে আগুনে গরম করো। কুঞ্জবতী দেবী সারাদিন ধরে এই সন্ধ্যাবেলা চা খাওয়ার সময়টুকুর জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। রাতের ভাত তিনি দিন থাকতে রেঁধে ফেলেন। একা মানুষের রান্ধাবাড়া – এ আর তেমন কি। ভাতের সাথে দুইটা আলু দিয়ে দাও, আর ঢেড়স থাকলে দুইটা দিয়ে দাও, শীতকাল হলে মুলা কিংবা হাংগাম মাপন ( লাইপাতা) দিতে পারো। এখন ভাদো মাস চলছে। শীতকাল আসতে দেরি আছে। ভাতের সাথে এই সময়ে দুইটা মুখিও দেয়া যায়। শীত আসতে আসতে কুঞ্জবতী দেবী বাঁচবেন তো ! গরম ভাতের সাথে নতুন আলুর ইরনবি খেয়ে যেতে পারবেন তো এবারও ! দাঁত তার ঠিকঠাক আছে। শরিলে বড় বেমার আজারও নাই। শুধু বাতের বেদনাটা রাত হলে হাঁটুর নীচে থেকে একটু মুচরামুচরি করে। ঘুমন্ত সরিসৃপ যেমন শিশিরের ভেজা তরল গায়ে লাগলে ধীরে ধীরে আড়মোড়া ভাঙে – ঠিক সেরকম।
সন্ধ্যা হলেই কুঞ্জবতী দেবী তোড়জোড় লাগিয়ে দেন। রাতের ভাত দেরিতে খেতেই পছন্দ করেন তিনি। কিন্তু রান্ধার কামটা সেরে ফেলতে চান তাড়াতাড়ি। চাল চারটা ফুটিয়ে দাও, তার উপর আলু কিংবা পাতাসাতা যা থাকে ছেড়ে দাও। ব্যস ! সারাদিনের ঝামেলা শেষ। ভাত এখন তিনি অনেক পরে খাবেন। ভাত খাওয়াটা বিষয় নয়। রান্নাটাও বিষয় নয়। বরং এইসব খানিদানিকেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ঝামেলা মনে হয় তাঁর । ভাত রেধে, রসুন ছেচাগুলি আগুনে গরম করা শেষ করে যখন তিনি চা জ্বাল দেবেন, লাল গনগনে চা যখন বড় চিনামাটির মগে ঢালবেন, ধোঁয়া যখন মগের উপর ঘন কুয়াশার জাল তৈরি করবে ,তারপর যখন তার স্টিলের বাটিতে বয়াম থেকে মুড়ি ঢেলে পাশে রাখবেন, ঠিক সেসময় সময় বুঝে বিড়ালটাও অন্ধকার ফুড়ে কোথ্বেকে জানি বের হবে, বিড়ালের জন্য তিনি মুড়ি ছিটিয়ে দেবেন ডাইনে নয়তো বাঁয়ে , তারপর যখন দুই পা টানটান করে শুকনো চটের উপর বসবেন- এবং এক হাতে চায়ের কাপ ধরে ফুরুত করে গরম চা মুখে দেবেন , চোখ রাখবেন ঘরের মাটির বেড়ার উপর কিন্তু মন থাকবে সুদূর কোথায় কোথায় জানি –একমাত্র তখনই কুঞ্জবতী দেবীর মনে হয় মানব জীবন বৃথা নয়। আজ তার বয়স সাতাত্তর নাহলে আটাত্তর। এর চাইতে কম হবে না তা নিশ্চিত। রেবতির বাপের যদি মৃত্যুকালে বয়স হয় সাতাত্তর, তাহলে তারও তাই হবে। দুজনে পিঠাপিঠি, কুঞ্জবতী দেবীর অন্নপ্রাশনের সময় রেবতির বাপের জন্ম হয়েছিল। ছয় মাস বড় তিনি। কারো মৃত্যুর খবর আসলে বুকটা যেন খালি খালি লাগতে শুরু করে ।
মৃত্যু নিয়ে তেমন ভীতি কুঞ্জবতী দেবীর নাই। ভয় কেবল এক জায়গাতেই ,বিছানাতে যেন ধুকে ধুকে মরতে না হয়। সংসারে তার এখন এক বুড়ো মাদী বিড়াল ছাড়া নাই কেউ। যদি মরতে হয়, মরতেতো হবেই। কেউ অমর নাকি পৃথিবীতে ! হঠাত দম বন্ধ হয়ে মৃত্যুই ভগবানের কাছে তার চাওয়া। কিন্তু নিজের মনমরজি মতো সবসময় পৃথিবীতে কিছু হয় নাকি ! এই ডরও মাঝেমধ্যে তাকে কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ করে দেয়। ছটফটানি হয়।
সারাদিনের কামকাজের পর উদযাপনের কিছু সময় তিনি রেখেছেন সন্ধ্যাবেলা, লাল চা খেয়ে খেয়ে। প্রতিটা চুমুক দেবার সাথে সাথে মনে হয় ,ক্ষয়ে যাওয়া ফাটাফোটা হৃদপিন্ডটা দ্বিগুন বেগে হাত পা ছুড়ে উপর দিকে উঠছে, যেভাবে সাইকেলের চাকায় পাম্প দিলে চরচর করে ফুলে ফেঁপে উঠে ,সেভাবে। কত কত স্মৃতি এসময় তার চোখে ভাসে। কিশোর বয়সী কোন প্রেমিকের কথা, কোন এক বৃষ্টিরাতে ধিকিধিক জ্বলতে থাকা কামনার আগুনকে ঠিকঠাক নিভাতে না পারার অসহনীয় যন্ত্রণা, কী এমন হতো যদি বর্ডারের ঐপাড়ের লোকটার সাথে ঘর করতো, লোকটার আগের বউ মারা গেছে – তাতে কি ! ব্যাটামানুষের এইসবে কি এমন আসে যায় ! আজ বিয়ে হলে তিনি নিশ্চই এইভাবে একা একা দীর্ঘ নিঃসঙ্গ জীবনটা বয়ে বেড়াতেন না ! – এইসব এক এক করে মনে আসে। মাঝেমধ্যে এমন হয়, সন্ধ্যাবেলা তার কাছে আসার পরে আর যেতে চায় না বাহিরে । সেদিন অনেক রাত তার নির্ঘুমে কাটে। কিশোরী মেয়েদের মতন –বুকজুড়ে তীব্র ছটফটানি শুরু হয়, বেদনার হাহাকার বুকের চার দেয়ালে আছড়ে পড়ে , ভাজপরা গালের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে অশ্রুর স্রোত ভাঙে , নিজের অজান্তে বালিশ ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যায়। কেউ জানতে পারলে লজ্জার শেষ থাকবে না। এই সাতাত্তর বয়সে এসে বুড়ি প্রেমিকের কল্পনা করে ! কামনার কথা ভেবে পুড়ে পুড়ে যায় !
মাঝেমধ্যে এসময় তার কাছে বেড়াতে আসে অনেকে। কেউ চা’র সাথে খাওয়ার জন্য মুড়ি কিছু নয়তো টোস্ট এক প্যাকেট নিয়ে আসে। কেউ আবার খালি হাতেও আসে। এসময় কেউ আসলে কুঞ্জবতীর ভাল লাগে না। নামক( মিঠাই) আনুক বা না আনুক বিষয় সেইটা না, এসময় যেই আসুক, কুঞ্জবতী দেবী মনে মনে অসন্তুষ্ট হন , মুখে অবশ্য বিরক্তি প্রকাশ করবার মতন মানুষতো নন তিনি। । যতক্ষণ ঐ লোকটা থাকে ,সে বুঝতে পারে না কুঞ্জবতী কিঞ্চিত অসন্তুষ্ট হয়েছেন সে আসায়। তার ব্যবহারে বিন্দুমাত্র ত্রুটি বিচ্যুতি কেউ ধরতে পারলে তো ! এই সামান্য সময়টুকু তিনি একা একা উদযাপন করতে চান। দিনের এই সামান্যটুকু সময় একান্তই তার বলে তিনি মনে করেন। এ সময়ে তিনি নিজের কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া আরেক কুঞ্জবতীকে ধরে এনে মুখোমুখি করান । নিজের চার কুড়ি বছর পাড়ি দেবার পরে এখন তার মনে হয়, সন্ধ্যাবেলা একা একা চা খেতে খেতে শীত / গরম যাই থাকুক- এই সামান্য সময়টুকুর কাছে ধন দৌলত বাচ্চা কাচ্চা সব তুচ্ছ। একবার তার ছোটবোন মারা যাওয়ার কারণে বড়লেখায় মাসখানেক থাকতে হয়েছিল। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা তাকে রঙ চা দেয়া হতো সাথে দামী টোস্ট, মচমচে বিস্কুট । কিন্তু দুই দিন পার হবার পরে শরিলে এক অশান্তি শুরু হয়ে যায় তার। খেতে, ঘুমাতে, আলাপ করতে কিছুই ভালো লাগছিল না। বারবার শুধু তাকে তার বাড়ির সন্ধ্যাবেলার নির্জন একা উঠান, ঝিঁঝিঁপোকার ডাক, উঠানকোণের কলা গাছের সবুজ কলাপাতার উপর চন্নির আলোর পিছলে পড়া- এইসব দৃশ্যগুলি কানের গোড়ায় এসে শব্দ করে ডাকবার মতন ডাকছিল । মরা বাড়ি, সেতো এখানে ঘুরতে আসে নাই। ইচ্ছা করলেও যাওয়াটা শোভন না। কর্ম শেষ না করা পর্যন্ত তাকে থাকতে হবে। তেরোদিনের কর্ম শেষ করার পরেও সে বাধ্য হয়ে থেকেছিল আরো কিছুদিন। কিন্তু যে কদিন ছিল- বারবার মনে হয়েছিল,আর বুঝি কখনো সন্ধ্যা হলে তার মাটির ঘরের বারান্দায় বসে লাল চা খাওয়া হবে না। সেও বুঝি তার বোনের মতন এই দু একদিনের মধ্যে মারা যাবে। সে মারা গেলে তার ভিটা কি জন মানুষ নাই শিয়ালের আস্তানা হবে ! তার প্রিয় বিড়ালটা কি তখন প্রতিদিন সন্ধ্যা হলে মুড়ি খেতে আসবে খা খা করা ভুতুড়ে ঘরে !
৩
টিকেন মিস্তরিও সংসারে একা মানুষ। বিয়ের বছর খানেকের মাথায় বউ আরেক ব্যাটার হাত ধরে পালিয়েছে। মা মারা গেছে এর কয়েক বছর পর। মায়ের পরে তার একমাত্র বড় বোন ছিল। এতদিন সে ই রান্ধাবাড়া, লেপাপুছা আর গরুবাছুর এইসব সামাল দিয়ে রেখেছিল । চেহারাও তেমন দেখবার মতন ছিল না। বিয়ের পরে অবশ্য এখন শরিলের গঠনে কিছু পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বাস করা মুশকিল, যে নারীর আগ পিছ সমান তক্তা ছিল-সেখানে ঢেউ দেখা দেবে। মরা গাঙের উপর নতুন বৃষ্টির পানি গড়িয়ে গেলে পুরা গাঙ জুড়ে যে কাঁপা কাঁপা ঢেউ উঠে ঠিক সেরকম। এখন তাকে দেখলে, বেটি মানুষ বিয়ার পরে শরিলের আইর ভাঙে , কথাটার অর্থ আছে -এইটা বিশ্বাস করতে হবে।
গ্রামের অনেকে আগে যেটা বলতো , টিকেনের সাথে তার আপন মায়ের পেটের বোনের শারীরিক সম্পর্ক একটা আছে।কিন্তু শরীর দেখেতো বুঝবার উপায় নেই। অমন ঢ্যাঙা, শরিলে এক তিল মাংস নাই , লাল লাল শক্ত রুখা চুল, সাদা চোখের মণি । যে উদাম গোসল করলে ব্যাটামানুষ উলটা মুখ ঢাকে –খালি রড খাড়া করে রাখলে কি ঘর হয় ! ঘর হতে গেলে থাবা থাবা মাংসল ইট লাগে। দানাদার বালু চামড়াকে মসৃণ করে। ঘন ধূসর রঙের সিমেন্ট ঘরের হাড্ডিগুড্ডিকে সুগঠিত করে। মানুষের শরীরও তাই। রুগা ,হাড়গোড় বের করা একটা যুবতী মেয়ে যদি রাস্তার উপর লেমটা পড়ে থাকে – ব্যাটামানুষ তবু ফিরেও তাকাবে না। প্রেমদার বেলাতেও গ্রামের মানুষ এভাবে ধরে নিয়েছিল। হয়তো সে দেখবার মতন সুন্দর ছিল না বলে মানুষ আগ্রহ দেখায় নি।
সে কি আদৌ তার মায়ের পেটের ভাইয়ের সাথে শোত ! কেউতো দেখে নাই । অবিবাহিত বোন আর বউ ছাড়া ভাই যদি দীর্ঘদিন এক ছাদের নীচে থাকে ,অনেকে অনেক কথা বলতেই পারে। মানুষের মনেরতো কোন ইস্টিশন নাই। এইসব সত্য নাকি মিথ্যা ,এইটা যাচাই বাছাই করার দায়িত্বওতো কারো উপর পড়ে নি। কুঞ্জবতীর দেবীর কাছে এইসব পুরাপুরিই মিথ্যা মনে হয়েছে। ছি ছি । ভাই বোনে কি তা সম্ভব ! মানুষ ভাবল কিরকম করে ! এইসব কল্পনা করলেইতো গা গুলিয়ে উঠে।
প্রেমদার বিয়ের পরে তার শরিলের পরিবর্তন দেখে –অনেকের মনে কি আসতো কে জানে, তবে কুঞ্জবতীর দেবীর মনে হতো এবং এখনো মনে হয়, শরিলের এই পরিবর্তন যদি তার ভাইয়ের সাথে থাকার সময় হতো – তাহলে সেই গোপন কথাটা কাউকে না কাউকে বিশ্বাস করতেই হতো। শরীরের চেয়ে বড় দলিল আর কি আছে পৃথিবীতে। মানুষ সুখে নাকি দুখে আছে, ভালোবাসা নিয়ে আছে নাকি ভালোবাসা ছাড়া একা নিঃসঙ্গ অবস্থায় আছে –এইসব তার শরীর দেখলে বুঝা যায়। কুঞ্জবতী দেবী বুঝতে পারেন।
যাই হোক, বুড়া বয়সে বিয়া হলেও দিনের শেষ বেলার রোদ যেভাবে নিঃসঙ্গ বুড়া তেতই গাছের মাথায় ক্ষণিকের হালকা একটা পরশ দিয়ে যায়, প্রেমদার জীবনেও যৌবন ছেড়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে এসে একটা ঢেউ কাঁপ তুলেছে। বাচ্চা কাচ্চা হয় নি এখনো। বিয়ের চলে প্রায় পাঁচ বছর। সুনারি স্বামী। সিলেট শহরের বাসিন্দা। যৌবনের শেষ হতে আর বেশী বাকী নেই প্রেমদার। তাকে সর্বশেষ গত রথের সময় দেখেছিল কুঞ্জবতী দেবী। মান্ডপে, ভান্দ্রা খাওয়ার সময়। সেদিন এক নজর দেখে কুঞ্জবতী দেবী বুঝেছিল, বাচ্চা কাচ্চা হবে নাকি হবে না -এ নিয়ে প্রেমদার আসলে সেরকম উদ্বিগ্নতা নেই। এটা অদ্ভুত। সচরাচর পঞ্চাশের ধারেকাছে আসা নারীরা বাচ্চা না হলে নানাবিধ চিন্তায় জীর্ণ শীর্ণ হয়ে পড়ে। গালে ভাঁজ পড়ে যায়। মরা মাছের মতন হয়ে যায় শরীর। বুক দুইটা যেন লোহার পাকা পেপে। নিষ্প্রাণ, ধাতব।
বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে টিকেন মিস্তরি কিভাবে একা একা থাকতো এ নিয়ে গ্রামের কারো আগ্রহ ছিল বলে মনে করেন না কুঞ্জবতী দেবী। সবাই নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। কে কাকে সময় দেবে ! আর সে তো দুধের বাচ্চা নয়। দুইটা ভাত ফুটিয়ে খাওয়া, ঘর বাড়ি ঝাঁট দিয়ে রাখা – এইতো কাম । আর কি ! মিসতরি মানুষ। সারাদিন বাহিরে কাম থাকলে সেখানেই খাওয়া হয়ে যায়। মুসলিম বাড়িতে খাসিয়া বাড়িতে পেঁয়াজ দিয়ে মুরুগ দিয়ে খেতে পারে। গরুও খেতে পারে। কে দেখেছে গিয়ে ! আজকাল আর এইসব নিয়ে কেউ লুকালুকি করে না। যার যা মনে চায় খাক- কুঞ্জবতীর তাই মত। শুধু গরু না খেলেই হল। সব ব্যবধান সরিয়ে দিলে বাংগালতো মুখের উপর বলে বসবে – “গরু খায় ,তার আরবার মাংগামাংগি কিতা ! “
আজ সন্ধ্যার দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। ভ্যাপসা গরমটা কেটেছে একটু। উঠানে দাঁড়ালে শিরশির বাতাসে শরিল জুড়িয়ে আসে। টিনের দরজাটা আধখান ভেজানো। ঘরের বর্গায় লটকে থাকা এনার্জি ভাল্বের আলোয় উঠানের পুরোটা ধরতে পারে ভালই। উঠানের চারপাশে জমিন থেকে ব্যাঙের ডাক শুনা যাচ্ছে। বৃষ্টি দেয়ার কারণে ছোট ছোট ব্যাঙের বাচ্চাগুলি উঠানজুড়ে ফালাফালি করছে। কুঞ্জবতী দেবী সন্ধ্যার এ সময় তার মাটির ঘরের দরজাটা হালকা ফাঁক করে রাখেন। সন্ধ্যা হলে মেইতেই ঘরে এভাবে দরজা হালকা ফাঁক করে রাখতে হয়। পুরো দরজা বন্ধ করে দিলে লক্ষী প্রবেশ করবে কিভাবে ! সন্ধ্যার ধূপ ধুনা দেয়ার পরে কিছু সময় দেখে তারপর দরজা বন্ধ করে দাও। বারিষার দিনে এই সামান্য ফাঁক পেলেই গোটা উঠানের ব্যাঙ বাচ্চার দলে ঘর ভরে যায়। মাঝেমধ্যে ব্যাঙ তাড়া করে হলুদ গা ঘিনঘিন করা ঢোড়া সাপও চলে আসে। এ আরেক উৎপাত । তবে ঘরের লাইট বন্ধ করে রেখে দিলে ব্যাঙের দল আর ঘরমুখো হয় না। কুঞ্জবতী দেবী আজ সন্ধ্যাবেলার ধূপ ধুনা দেয়ার পর চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে বারান্দায় বসে আছেন। ভিতর ঘরের লাইট নিভানো। উঠানের কোণের আলো পুরো উঠানতো ধরেছেই সাথে বারান্দার ভিতরটাও খালি রাখে নি। এই মৃদু আলো অন্ধকার সময়টা পুরোপুরি উপভোগের সময়। এসময় কেউ আসলে তিনি স্বভাবতই বিরক্ত হোন। তবে আজ বোধ হয় বিরক্ত হবেন না। গত দুইদিন ধরে টিকেন মিস্তরি তার ঘরে এসে কিছু গল্প উস্কে দিয়ে গেছে।
৪
সন্ধ্যা নামলেই টিকেনের আরেকজীবনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। মানুষ কাজ থেকে ঘরে ফিরবার সময় সারা শরিলজুড়ে ক্লান্তি থাকলেও দ্বিগুন উদ্দীপনা কোথ্বেকে জানি নামিয়ে ফেলে। তাড়াহুড়া লাগিয়ে দেয়। পা জোড়া যেন হাঁসের পা হয়ে যায়। গুটি গুটি পায়ে সুরসুর করে রাস্তা মাঠ বন বাদাড় পেরিয়ে জমিনের আইলের উপর মানুষের বাড়ির উঠানের উপর যন্ত্রের মতন হেঁটে যায়। বিস্কুটের ফ্যাকটরিতে যেভাবে ময়দার গুড়া এক বাক্সে যেয়ে গোলা গোলা হয়ে যায় তারপর আরেক বাক্সে গেলে পিস পিস সেখান থেকে তেলে লবণে মেখে আরেক বাক্সে গিয়ে হয়ে যায় চারকুনি নয়তো তিনকোনি নাহলে গোলমুল। টিকেন মিস্তরি মনে করে কেবল সে বাদে পৃথিবীর আর সব মানুষ বাড়ি ফেরার সময় নির্ভুলভাবে নানান জায়গা ঘুরে ঘুরে ঠিক সময়ে বাড়ি ফেরে। সেও ফিরতে পারতো এরকম। কিন্তু কার জন্য ফিরবে ! ঘর থাকলে ঘরণী থাকতে হয়। মেয়েলোক ছাড়া সে যত বড় দালান হোক মোজাইক পাথরের আলিশান বাড়ি হোক – খা খা করা শ্মশান ছাড়া আর কিছু মনে হবে না। সারাদিন কাজ থাকলে এইসব অত গায়ে লাগে না। এই সমাজে বিয়া না করলে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য একদল যেমন সর্বদা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে প্রস্তুত থাকে। বিয়া করার পরে বউ চলে গেলে সেই এক দল লোকের আবার লেজও গজায়। তারা তখন সামনে দিয়ে দাঁতমুখ খিচায় আর পিছন দিয়ে একজন আরেকজনের লেজে বাড়ি মারে। এইসবের হাত থেকে টিকেন মিস্তরি একা রেহাই পাবে কেন ! তাকেও সামনে দিয়ে দেদারসে দাঁতমুখ খিচানো চলে আর পিছন দিয়ে অবিরত লেজের বাড়ি মারাতো আছেই। দেখতে দেখতে তার এতদিনের গা সওয়া হয়ে গেছে। প্রায় পনেরো বছর আগে সদ্য বিয়া করে আনা ,মাত্র বছর খানেক হওয়া তার নতুন বউ তাকে ফেলে সেই যে চলে গেল , গিয়ে আরেক জায়গায় ঘর বানলো, বাচ্চা কাচ্চা দিল , বেটি এইসব হয়তো কবেই ভুলে টুলে সংসারের গ্যাঞ্জামে পড়ে মাথার চুলে পাক ধরিয়ে ফেলেছে। সংসারতো এরকমই , ঠিক কিনা বলেন, যেখানে দুই দিন গত হলে , সদ্য ছেলেহারা মা পর্যন্ত সব ভুলে গিয়ে কামেকাজে নেমে পড়ে। সেখানে টিকেন এই দীর্ঘ ক বছর ধরে খরায় ধুকে ধুকে জুয়ান শরিলের রসকষ সব মেঘে মেঘে শুকিয়ে ফেলবার মানে আছে কোন !
এর মানে এই নয় যে সে বউয়ের স্মৃতি নিয়ে বাকীজীবন বেঁচে থাকতে চায় ! সেও এইসব ভুলে গেছে সেই কবে। নতুন সংসার করবার জন্য প্রতি বছরই ফাল্গুন আসলে সেও মরা জমিনে বৃষ্টির আশায় বুভুক্ষুর মতন চেয়ে থাকে। জুয়ান ব্যাটামানুষের জুয়ান মেয়েমানুষ দরকার। তেল ছাড়া গাড়ি চলে কি ! বাতাস ছাড়া কি গাঙের ঢেউ ভাজ হয় ! এই পৃথিবীতে পথের কুকুরের জন্য সংগী আছে, সামান্য ইন্দুরের জীবন ! মানুষের চোখের আড়ালে থেকে বিড়ালের নজরের বাহিরে থেকে ধুক ধুকি ধুক ধুকি বুক নিয়ে প্রতি মুহূর্ত যে অনিশ্চয়তার জীবন কাটাচ্ছে, সে যখন রতি কামনায় শীৎকার দিতে দিতে মরে যাওয়ার জন্য প্রায় উন্মাদ হয়ে যায় , রাতের বেলা এইসব দৃশ্যের নির্মম স্বাক্ষী বানিয়েছেন ভগবান টিকেনকে। মানুষ হয়ে জনম নেয়ার এই হল তার শ্রেষ্ঠ উপহার। মাঝেমধ্যে ক্ষোভে রাগে মুখে গনগনে আংরার টুকরা গুজে দিয়ে মরে যাবার দৃশ্য কল্পনা করে মনটাকে স্বান্ত্বণা দেয়ার চেষ্টা করে । ভাতের অভাবে মানুষ মারা যেতে পারে। কিন্তু শরিলের জোয়ারের সময় যদি তার লগি বৈঠা স্রোতের সাথে ছেড়ে না দাও , হি (নৌকা) তখন আথারে পাথারে বাড়ি খেতে খেতে দিশাহীন হয়ে যেতে পারে, মানুষও তাই। সময়কালে যদি তাকে সঙ্গী না দাও , সে পাগল হয়ে যায়। এটা মরে যাওয়ার চাইতে আরো ভয়ানক। প্রতি বছর ফাল্গুন আসলে যখন ঢুলিপাড়া থেকে মালিপাড়া থেকে বিয়ের বাজনা বাজে , টিকেনের তখন এক পৃথিবী বিষাদে মনটা ভরে যায়। তখন মনে হয় তার মতোন একা, এতিম পৃথিবীতে আর কেউ নাই।
সে বিয়ের প্রস্তাবটা দেবে কার কাছে ! মেইতেই যুবতী মেয়েরা দেশে এত পাখাং (যুবক) থাকতে তার মতো বউ পালিয়ে যাওয়া পড়ন্ত বেলার যুবকের কাছে কেন যাবে ! আর এই দেশে বিধবা মেইতেই মেয়েমানুষরা যাও আছে, কেউ দ্বিতীয় বিয়ার ঝুঁকি নিবে না। ভাইয়ের বাড়িতে বান্দিগিরি করতেই তাদের অসীম সুখ। জীবন যে প্রতি মুহূর্তে ভাঙে আর গড়ে এইটা মেইতেই বিধবা কিংবা ভাইয়ের বাড়িতে বাপের বাড়িতে খোঁটা খেতে খেতে চাপাচুপা ভেঙে যাওয়া কুমারী মেয়েরা বুঝতে চায় না। তারা মনে করে, যা হচ্ছে , তা ভাগ্যের কারণেই হচ্ছে। ভাগ্যকে ডিঙিয়ে যাওয়ার অন্তত সাহসটুকু যে মানুষ চাইলে করতে পারে এটাও তারা বিশ্বাস করতে চায় না। অথচ ঘরের বাহিরে এসে বাঙাল মেয়েদের দেখো ! একজনের সাথে বনাবনি না হলে “থো ফালাইয়া “ বলে আরেকজনের ঘরে উঠে। জীবনতো এটাই। তার বউ যে চলে গেল তাকে ফেলে, টিকেন নিজের কথা ভাবে, প্রথম প্রথম তার ভিতর তীব্র জ্বালাপুড়া ছিল, প্রতিশোধের ভয়ংকর দানব যে ছিল তার ঘাড়ের উপর, মনে হতো বউটাকে আবার সল্লা দিয়ে ডেকে এনে ওর পেশাবের রাস্তা দিয়ে আস্ত একটা বাঁশের খাড়ি ঢুকিয়ে দেয় । সিধোখারো কাশুবি ( মরে যা ছিনাল ) – অনেক বছর পর সেইসব মনে পড়লে তার হাসি পায়। বনে না চলে গেছে – এইতো শেষ ! জোর করে কি মানুষ রাখা যায় ! ঘরের কুকুরওতো তোমার খেয়ে তোমার পা চেটে সারা রাত না ঘুমিয়ে পাহাড়া দিয়ে একদিন তোমাকে না জানিয়ে অজানা কোথায় চলে যায় । যায় না ! এ নিয়ে টিকেন এখন আর আফসোস করে না। সেও আর সবার মতো ঘর সংসার করতে চেয়েছিল। তার মিসতরি কামে যা আসে তা দিয়ে ভালমতই একটা ঘর চালানো যায় । দুজন মানুষের জন্য আর কতটুকুই বা লাগে ! এই দীর্ঘ ক বছর ধরে সে তার মতো করে একটা বউ সাজিয়ে নিয়েছে। ছোটোমোটো, ফর্সা পা , একেবারে ললিতো দোকানদারের নাতনির মতোন। সে একা একা ঐ বউর সাথে কথা বলে। বাজার করে আনবার পর সে শূন্য জায়গার দিকে বাজারের ব্যাগ এগিয়ে দেয়, যেন শূন্য থেকে কোন নারী ভুস করে ভেসে উঠবে। এইভাবে সে মনে মনে কথা বলে , ভাবের আদান প্রদান করে, তার কল্পনার বউ অভিমান করলে যেভাবে ঠোট ফুলাবে সেইটা সে নিজে করে দেখায়, মাঝেমধ্যে কান্দাকাটি করলে তার ইস্পাতের মতোন বুকটা পেতে দিয়ে অস্ফুটে বলে “ এই লেই এই লেই” (আমি আছি আমি আছি )। কিন্তু এই খেলা সব সময় জমে না। সে যদি বিয়া না করতো তাহলে হয়তো অন্য কথা ছিল, দেখা যেতো, এইরকম কল্পনা করে করে বাকীজীবন হেসে খেলে পার করে দিয়েছে । অনেক আগে কার মুখ থেকে সে একটা কথা শুনেছিল, সঙ্গীতশিল্পী লতা মংগেশকর সারা জীবন বিয়া না করার ইচ্ছাপোষণ করেছিলেন , তার কি কোন সঙ্গীর প্রয়োজন নেই ! এমন প্রশ্ন শুনার পর তিনি বলেছিলেন, আমার মন থেকে একজনকে সঙ্গী বানিয়ে ফেলেছি। এখন তার সাথেই প্রতিদিন হাসি আনন্দ, কষ্ট, বেদনা ভাগাভাগি করছি। টিকেন দেখেছে , তার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছে , একেবারে বিয়া না করলে এরকম কল্পনায় কাউকে বানিয়ে পুরা জীবন পার করা সম্ভব ! খুবই সম্ভব । কিন্তু বিয়া করে ফেললে তার হিসাব একেবারে আলাদা হয়ে যায়। যে কুকুর প্রথমবার হাড্ডির টুকরা চিবিয়েছে, তাকে তুমি চিতল কাতলা ইলিশার নানান ব্যঞ্জন দিয়ে লিপ্সা দেখাও না কেন হাড্ডির টুকরা দেখতে পেলে সে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে হাড্ডির স্তুপের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। মাঝেমধ্যে টিকেন অসহায় হয়ে পড়ে। কোন উপায়ান্তর না পেয়ে প্রথম যৌবনে বাচ্চা ছেলেরা হাত দিয়ে যা করে সেভাবে শরিলের পাশবিক ক্ষুধাটাকে দমিয়ে রাখে। সে মানুষ জীবন নিয়েও এত নিঃসংগ আর এতটা অসহায় যে এমনও দিন আছে গাভীর পিছন দিক দেখার পর মাথা ঠিক রাখতে পারতো না। হায় প্রভু ! এইসব যখনই তার মাথায় আসে নিজের জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। এইভাবে যাবে বাকীজীবন ! পাঞ্চায়েতের মুরুব্বি থেকে শুরু করে ইমা ইবেম ( মা খালা ) সবাইকে এতবার স্মরণ করাতে হয় যে তার নিজেরই লজ্জা লাগে। রুটিরুজি করে খাওয়া একটা লোককে যদি বিয়ে করাতে না পারে তাহলে কিসের পঞ্চায়েত ! বাল ছিড়ার জন্য কি তাদের রাখা হয়েছে ! বিয়ে একটা করাতে পারবে না উলটা বদনাম দেবে বউ রাখতে পারে না বলে । আরে তোদের বউকে পাঠিয়ে দ্যাখ, টিকেন পারে কি না !
জংগলে যখন আগুন লাগে তখন দেখবেন, বড় বড় আগুয়ান আগুনের গোলা পানি দিয়ে নিভিয়ে দিলেও ছোট ছোট সরু স্রোত কোন চিপাচুপা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। একটা গ্রাম একটা জনপদ মুহূর্তের মধ্যে ছারখার করে দেয়ার জন্য এক বিন্দু বারুদই যথেষ্ট, ঠিক না ! শরিলের অবদমিত আগুন আটকানোর সাধ্য কি কোন সুস্থ মানুষের আছে ! যে কদিন টিকেন কুঞ্জবতীর দেবীর বাড়ি গেছে সেখানে গিয়ে সে আবিষ্কার করেছে নিজের শরিলের কামনার কথা, অতৃপ্তির কথা , একা একা দুঃসহ রাতযাপনের কথাগুলি কুমারী বুড়িটাকে শুনাতে সে একধরনের রতিসুখ , শিরায় শিরায় নির্বিষ বাচ্চা সাপ দৌড়ালে যেমন লাগতো বলে মনে হয় সেরকম সুখ অনুভব করছে। তার মানে এ নয় যে , সত্তর বছর বয়সী এক বুড়ির সাথে সঙ্গম করার কল্পনা করছে। কখনোই না। । কুঞ্জবতী দেবীর দাঁত এখনো একটাও পড়ে নি। শরিলে চামড়ায় ভাঁজ ধরা শুরু হয়েছে সে প্রায় অনেক আগে থেকে। কিন্তু খুব কাছ থেকে না দেখলে সেগুলো বুঝবার উপায় নাই। চামড়া মসৃণ, পালিশ করা, মেদ নাই এক ইঞ্চি। তরতাজা সুঠাম মেয়েমানুষ। তবু একটা বুড়ি বেটিকে সামনে পেলে কামনা জাগবে – এইটা সহজে মেনে নিতে পারে না টিকেন। শেষ পর্যন্ত কিনা একটা বুড়ি বেটিকে ! এতটা অধঃপতন একটা জুয়ান ব্যাটামানুষের ! লোকে জানলে , বিশেষ করে লেইসাবি নুপিরা ( যুবতী) জানতে পারলে লজ্জায় গ্রামছাড়া হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। তবু সে কুঞ্জবতীর কাছে আসলে শরিলের জ্বালা যন্ত্রণা কিছুটা উপশম করতে পারে, এই কদিনে সে এইটা আবিষ্কার করেছে। শরিলের কামনার ক্ষুধা মিটাতে শুধু বেটিমানুষের উপর সওয়ার হলেই হয় না। নানান তরিকা আছে । সে বুড়ির কাছে এসে তার বউয়ের সাথে তার ভালোবাসার, শরিলের ঘ্রাণের , এমনকি সাহস করে যেদিন সহবাসের কথা বলে ফেলেছিল, সে একটু ভয় পেয়ে গেছিল, যদি বুড়ি হঠাত চিল্লাচিল্লি করে, তাকে কুকথা শুনাচ্ছে বলে যদি পঞ্চায়েত ডেকে বসে , কিন্তু ভগবানের কি লীলা দেখো, বুড়ি এইসব শুনার পর তাকে থামতে বলে নি। টিকেন স্পষ্ট চোখে দেখেছে , এইসব বললে বুড়িও শুনার জন্য কান ধার করে রেখেছে। মেয়েমানুষ ! এটাই হল টিকেনের কাছে বুড়ির পরিচয়। বয়স যতই থাকুক, এটা সে গোণায় ধরে না। মেয়েমানুষের সামনে এইসব অবদমিত শরিলের কামনার কথা বর্ণনা করাটাও একপ্রকার সঙ্গম করার মতো আনন্দের।
৫
কুঞ্জবতী দেবী প্রথম দিন ঘটনার সময় বুঝতে পারেন নি ঠিকঠাকমতো। পরে রাতে ঘুমানোর সময় একটু একটু স্মরণ হলে তিনি প্রথমে বিস্মিত হয়ে যান। এটাই বা কি করে সম্ভব ! টিকেন তাকে বলছে , বউ চলে গেলে একটা বিবাহিত পুরুষের জীবনযাপনে কি কি সমস্যা হতে পারে , তার নিজের কথা বলছে, টাকা ধন সম্পদ এইসব থেকে কি লাভ , যদি মেয়েমানুষ সময়কালে হাতের কাছে না থাকে ! কুঞ্জবতী দেবী অবাক হন , এই কথা সাহস করে তার সামনে কিভাবে বলতে পারল সে ! সম্পর্কেতো তার ভাতিজা লাগে। কিন্তু টিকেনের এইসব কথা বলার সময় কুঞ্জবতী দেবীরওবা অবচেতনে কি হয়েছিল কে জানে ! তিনিও কিভাবে বলে ফেললেন, বউ চলে গেলে ব্যাটামানুষের খুব কষ্ট হয় বুঝি ! ব্যস ! দুইজন নিঃসংগ মানুষের মধ্যে এই কথা যেন একটা আগুনের চোরাস্রোত হয়ে এপাড় ওপাড় ভেদ করে চলে গেল । কি অদ্ভুদ মানুষের সম্পর্ক । দুই অসম বয়সী মানুষ , যাদের চিরকালই শ্রদ্ধা আর স্নেহের বাহিরে হালকা কিছু ফাগি ( হাসি তামাশা) তুলে একে অপরে যে হাসাহাসি, মাঝেমধ্যে গ্রামে বছরের নানান কুমেই আর পূজার সময় মান্ডপে দেখা হয়ে গেলে যেরকম ইমা ইবেমদের সাথে ভাতিজা ছেলেরা করে থাকে, সেটাও ছিল না। কিন্তু দুজনের মধ্যে কিছু একটা যেন হয়ে গেল। কুঞ্জবতী দেবী সেদিন রাতে বিচনায় শুয়ে শুয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে সন্ধ্যাবেলার ঘটনাটা উপভোগ করছিলেন। শরিলে উত্তেজিত হওয়ার সে বয়স তিনি অনেক আগে পেরিয়ে গেছেন। কিন্তু মনের ভিতর সে অতৃপ্তি, সে বেদনা , জীবনে কোন পুরুষলোকের বলিষ্ঠ আলিঙ্গন না পাওয়ার যে হাহাকার- এইগুলা কি অতি সহজে মুছে ফেলা যায় ! মুছা সম্ভব ! বরং যতদিন যাচ্ছে নিসঙ্গতার ক্ষমাহীন দীর্ঘ মেয়াদি খরা যেন তাকে তিল তিল করে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। যে নারী জীবনে কখনো কোন পুরুষের আলিঙ্গন পায় নি , আদর পায় নি, চুমু পায় নি, স্তনে লোমশ হাতের চাপ পায় নি ,বিচনায় চূড়ান্ত সংগমের পুলক আনন্দ পায় নি –কুঞ্জবতী দেবী এই শেষ বয়সে এসে ধারণা করেন এমন নারীর পুরা জীবনটাই বৃথা। একটা নারীর জীবনে প্রেমিক আসে, স্বামী আসে, তারপর বাচ্চা আসে, বাচ্চার মা ডাক শুনার অমর মধুরতা আসে , মা না হলে নাকি নারীর জীবন পূর্ণ হয় না । কুঞ্জবতী দেবী অবশ্য অতটা আগ্রহী ছিলেন না এই মাতৃত্ব নিয়ে। একা জীবন তিনি দারুণভাবে উপভোগ করেছেন এ জীবনে , এইটা অস্বীকার তিনি করবেন না। কিন্তু মা নাই হোন, তাই বলে ঈশ্বরের দেয়া শরিলকে সারাজীবন ধরে তৃষ্ণার্ত রেখে দিলেন, তীব্র ক্ষুধার সময় এক ফোঁটা জল পর্যন্ত দিতে দিলেন না, এইটা কি ঠিক হলো ! শরিলে কামনা আসলে তাকে দমিয়ে রাখাটা তার জীবনের মস্ত বড় ভুল ছিল। তিনি সেইটা চল্লিশের পরেই বুঝেছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তিনি চাইলে যৌবনের পূর্ণ সদ্বব্যবহার করতে পারতেন। পারতেন না ! বেটিমানুষের কোন সুযোগ লাগে নাকি ! একটু ঈশারা দিলে যে কাউকে দিয়ে সহজে নিজের কামনা হাসিল করতে পারতেন। কত পরিবারে এরকম হয় ! পরিবারের কথা বাদই দিলাম। অনেক বৈষ্ণবী বয়স্কা মহিলাকে তিনি দেখেছেন যারা মাছ ,পেঁয়াজ , রসুন জীবনে ছুঁয়েও দেখে নি অথচ গোপনে কারো না কারো সাথে শরিলের কামনার সুখ ভাগাভাগি করছে। পাপ পূণ্যের কথা তার একবারও মাথায় আসে নি। কিন্তু এত পবিত্র হয়ে এই মরার বয়সে কি লাভ হল ! ডর ছিল শুধু পাঞ্চাইত আর ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে থাকা। অতটা যে সাহস করতে পারবেন না সেটাও তিনি জানতেন। মনকে বুঝ দিয়ে চলেছিলেন। কিন্তু এত বছর পর টিকেনের কথাটা শুনার পর তার ভিতর কি যেন গোলমাল হয়ে গেল ! অথচ তিনি যে টিকেনের জন্য এতদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলেন এমনও না। টিকেন তার ঘরে এর আগে যে আসে নি এমনতো না। কত বার আসে তার কি ঠিক ঠিকানা আছে । কিন্তু এর আগে এইসব কথা কোন দিন সে তুলে নি। তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে কুঞ্জবতী দেবী এরকম কারো আশায় বসে বসে দিন গুনছিলেন। হতেও পারে। বলাতো যায় না । তিনি নিজেও নিশ্চিত নন। মানুষ কি আর তার নিজেকে পুরোপুরি জেনে ফেলে ! এবং শুধু এইটা নয়, টিকেনকে দেখা মাত্র তার মনে হয় , আগেও হয়েছে এরকম, তবে সেইটা কদাচিত, কিন্তু এই সেদিনের পর থেকে যেন বেশী করে পিছন থেকে কেউ তাড়না করছে – টিকেন বোধ হয় তার বোনের সাথে কামনার সম্পর্ক করেছে। টিকেন যে তাকে তার পালিয়ে যাওয়া বউয়ের বিশদ বিবরণ দিচ্ছিল, কুঞ্জবতী দেবীর সেসময় একবারও টিকেনের বউয়ের কথা মনে আসে নি। তিনি দেখছিলেন টিকেনের বউ নয় তার বোনই সারাদিন ধরে কাম কাজ ফেলে স্নো পাউডার মাখছে যে মাখছেই। টিকেনকে তার বউ নয় তার বড় বোনই বলছে তার খোলা পিঠে পাউডার ছিটিয়ে সেইটা মিলিয়ে দেবার জন্য। টিকেন বলছে সন্ধ্যাবেলা , ঝুপ করে নেমে আসা অন্ধকারে কলপাড়ে সে যখন কাম থেকে এসে স্নান করতে যাবে তখন তার বউ বলছে সেও নাকি তার স্বামীর সাথে তখন স্নান করবে, এই কথা যখন উদাস হয়ে টিকেন বলছে তখন কুঞ্জবতী দেবী দেখছেন টিকেনের সাথে তার বড় বোন প্রেমদা কলপাড়ে এসে স্নান করতে বসে পড়েছে। টিকেন বলছে, তার বউর ধবধবে খোলা ফর্সা পিঠ আজো ভুলতে পারে নি, এসময় কুঞ্জবতী দেবী টিকেনের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে কেন মুচকি হাসি দিবেন। তাহলে তারও সামান্য প্রশ্রয় ছিল তাহলে ! কিন্তু তিনিতো কলপাড়ে টিকেনের বউকে দেখেন নি। টিকেন অতদূর হয়তো লজ্জা পেয়ে বলতে চাইছে না। কুঞ্জবতী দেখলেন টিকেন হয়তো বড় কিছু একটা বলার অপেক্ষা করছে। কুঞ্জবতী দেবী কিভাবে সাড়া দেবেন, হয়তো এ নিয়ে কিছুটা দ্বন্ধে আছে। কিন্তু কুঞ্জবতী দেবী তাকে চোখের প্রশ্রয় দিয়েছিলেন নিশ্চই । নাহলে সে কিভাবে বলতে পারল তার বউ নাকি ভরসন্ধ্যাবেলা কলপাড়ে তার হাত টেনে নিয়ে বুকের উপর রেখে বলছে , এইখানে একটু চুলকে দাও। কিন্তু কুঞ্জবতী দেবী তখন কোন দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছেন ! তিনি কেন দেখবেন টিকেন তার বউ নয়, তার বড় বোন প্রেমদার বড় দুইটা স্তন হাতে নিয়ে তার বোনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। প্রেমদাও তাহলে মেনে নিল ! মায়ের পেটের ভাইয়ের সাথে ! এও কি সম্ভব ! কিন্তু তারা যে অনেক দূর চলে এসেছে ! কুঞ্জবতী দেবী কল্পনা করলেন, এখন এখান থেকে তাদের আর ফেরার কোন পথ নাই।
৬
আজ সন্ধ্যার আগে এক পশলা বৃষ্টির পর চ্যাপচ্যাপা গরমটা কেটে গেছে । উঠানে দাঁড়ালে ঝিরঝির বাতাসে শরীর বিভোর করে দেয়। তারা দুজনে বারান্দায় বসে একে অপরকে কিভাবে প্রলুব্ধ করা যায়, তার পায়তারা করছিল। টিকেন বাংলা খেতে খেতে সময়টা উদযাপন করতে চায়। মাল খাওয়ার পর অনবরত মুখ দিয়ে কথা বাহির হয়ে আসে। মুড়ি ভাজার মেশিনের মতোন। ফরফর ফরফর করে যত কথা বলবে তত বেশী নেশা জমে। এখনো নেশা পুরামতো ধরে নাই। আস্তে আস্তে ধরছে কেবল। কুঞ্জবতী চা খেয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছেন। তিনি যে খুব বেশী উত্তেজিত বা কিছু শুনবার জন্য বুভুক্ষুর মতোন বসে আছেন, তা কিন্তু না। টিকেনের বয়স যদি হয় বিয়াল্লিশ কুঞ্জবতী দেবীর আটাত্তর । প্রায় দ্বিগুণ। বয়সের একটা ব্যাপার স্যাপারতো থাকতে হয় , তাই না ! কুঞ্জবতী দেবী যত সহজে নিজেকে সামলাতে পারেন টিকেন সেইটা পারবে না। তিনি বুঝেশুনে খেলতে চান। অত তাড়াহুড়ার তার দরকার নাই। তিনি জানেন, টিকেন একটু পরে তার আদি রসের অতৃপ্ত কামনার কথাগুলি একটার পর একটা তোলে আনবে। সেই একই নারী ,তার পালিয়ে যাওয়া বউ। থরাইমচা ( ভাদাইম্যা) বউকে ধরে রাখতে পারে না আবার তাকে নিয়ে রসের কত আলাপ দ্যাখো ! আহা ! এমন রসের কথা তোলে যেন তার বউ রস খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে তৃষ্ণায় কাতর পুরুষ মৌমাছির ঠাপ সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যাওয়া কোন রানী মৌমাছি। মুখের কথাটা যদি কাজে প্রমাণ হতো তাহলে কি তার অমন সুন্দর বউ আরেকজনের হাত ধরে চলে যায় । তার এইসব খেজুরে আলাপ শুনার একদমই রুচি নাই কুঞ্জবতী দেবীর। তিনি শুধু শুনতে চান প্রেমদার কথা। বিয়ার পরে প্রেমদার শরিলের পরিবর্তন তাকে অস্থির করে দিয়েছে। একটা নিস্তেজ, প্রায় মরামরা অবস্থা ,পাতাসাতা শুকিয়ে এমন যেন তেলে ভাজা কড়কড়া পাপড়, হাত দিলে গুড়াগুড়া হয়ে ঝরে যাবে –এরকম রোগেসুগে ভুগা গোলাপগাছটা দক্ষ মালীর হাতে পড়তেই রাতারাতি যেন পালটে গেল। মেয়েমানুষের শরিল যে আসলেই একপ্রকার ফুলের গাছ এইটা কুঞ্জবতী দেবী প্রেমদার বিয়ার পরে প্রেমদাকে দেখে জীবনে প্রথম জানতে পারলেন। তিনি যে প্রেমদাকে দেখে হিংসায় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছেন, তা কিন্তু না। বরং সিজনের প্রথম বৃষ্টি পেলে মরাগাছের পাতাগুলি ডালগুলি যেভাবে ঘন সবুজ আর পুষ্ট হয়ে চোখের পলকে বদলে যায় ,সেইটা দেখতে কার না ভালো লাগে ! সেইরকম একধরনের অনুভূতি হচ্ছে তার। এইটাতো গেল মানুষ হয়ে সবকিছুকে ভালোবাসবার হিসাব। যেকোন বয়সের লোক এমন করতে পারে দেখাতে পারে। কুঞ্জবতী দেবীর কাছে এর চাইতেও আরো অন্যরকম একটা জিনিস সেইটা। দুই রোগীর মধ্যে এক রোগী যখন দেখে তার পাশেরটা ধীরে ধীরে আদর পাচ্ছে সেবা পাচ্ছে ভালোবাসা পাচ্ছে- তখন সে আর কিন্তু ঈর্ষার চেয়েও বড় কিছু দেখায়। তার তখন ভালো লাগে তাকে দেখে। তাকে নিয়ে সে নানান জায়গায় গল্প করে । পৃথিবীতে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা এইটা। কিন্তু কুঞ্জবতী দেবীতো প্রেমদার সমবয়সী নয়। দুজনের ব্যবধান প্রায় মা মেয়ের মতোন। আর প্রেমদার তবু যৌবন শেষ বিন্দুতে ছিল । এ বয়সে বিয়া করলে খুব যে কথা উঠবে এমনও না। তার সাথে আটাত্তর বয়সী কুঞ্জবতী দেবী কিভাবে তুলনা আসে ! যে শুনবে সে বিশ্বাসই করবে না। বুড়াকালে রতিভ্রম হল নাকি তার শেষ পর্যন্ত । কিন্তু কুঞ্জবতী দেবী বিষয়টা এইভাবে ব্যাখা করতে চান নি। এইভাবে তিনি ভাবেনও নি। তিনি যেইটা ভাবছেন এইগুলা জানতে পারলে মানুষ চমকে যাবে। মানুষের মনের ভিতর কি আছে মানুষ কি তা জানে ! কার ভিতর কি তোলপাড় হচ্ছে কেউ কি বলে সেইটা ! মুখে মানুষ রাম নাম জগদীশ। কিন্তু ভিতরে যে কে শকুনি আর কে কৈকৈয়ী – তা কি বাকী মানুষ জানে ! তিনি প্রেমদার বিয়ার পর তার শরীরের পরিবর্তন যেদিন থেকে দেখেছেন সেদিন থেকেই তার মনে বিকৃত চিন্তা ঢুকে গিয়েছিল। প্রেমদার জন্য তার স্বামী আছে । ঐ লোক তাকে গড়বে ভাঙবে । কিন্তু এতে তিনি মানে কুঞ্জবতী দেবী খুশি ছিলেন না। তিনি কল্পনায় সাজালেন প্রেমদার সাথে তার ভাই টিকেন মিস্তরির শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে। গ্রামে এরকম কথা উঠেছিল বটে একসময়। কিন্তু মানুষ তা পাত্তা দেয় নি। যেদিন টিকেন কুঞ্জবতী দেবীর ঘরে আসল সেইদিন কুঞ্জবতী দেবী টিকেনের আদি রসের আলাপ করার সময় কি বুঝে যে টিকেনের জায়গায় প্রেমদাকে ঢুকিয়ে দিলেন। এইভাবে একই মায়ের পেটের ভাই বোনকে নিয়ে শরিলের কামনার কথা চিন্তা করতে যে কি পরিমাণ শিরশিরানি তীব্র সুখ তিনি পান , সেইটা কাউকে বুঝানো কঠিন। তার জীবনের অতৃপ্ত কামনাগুলি, বিনিদ্র নিশির যন্ত্রণাগুলি যেন এদের দিয়ে তিনি নিংড়ে চুষে পুরণ করতে চান।
৭
আজ আকাশে চন্নি উঠেছে। ঝলমলে রুপালী রাত। বৃষ্টির পর আকাশ যেন তার ভেজা শরিল মুছে মাটির দিকে নেমে আসছে , মুখি ইলিশ দিয়ে কারো বাড়িতে দাওয়াত খেতে। বৃষ্টিধোয়া গাছের ঘন সবুজ পাতারা এমনভাবে চন্নিতে ছিলকে উঠছে যেন গাছ থেকে রুপালি মাছেরা গাঙের জলে টপকে পড়ছে। মাল খেলে এমন অদ্ভুত খেয়াল আসতে আছে যে , টিকেনের মনে পড়ে যায় গাঞ্জুরি ওসমানের কথা। একদিন রুপচানের বাড়িতে গাঞ্জা খেয়ে ওসমান এমন টাল হয় যে বলে কিনা , সে একদিন ভইষ রাখতে পাহাড়ে গিয়েছিল। দুপুরের রোইদে যখন সে পাহাড়ে বড় গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিল, ঝিরিঝিরি মোলায়েম বাতাস পেয়ে সে ঘুমিয়ে ঢুলুঢুলু প্রায়। এমন সময় সে খেয়াল করে ছর ছর পাতার আওয়াজ। চারিদিক থেকে ছর ছর শুকনা পাতার আওয়াজ একসাথে কানে এসে বারি মারতেছে। ধুরো ! হয়তো বাতাসের কারণে এমন হচ্ছে। কিন্তু শুকনা পাতার রুক্ষ আর কর্কশ আওয়াজ এত বেশী কানে লাগছে যে সে আর চোখ না মেলে পারে না। চোখের সামনে সে দেখে হাজারে বিজারে নানান রঙের মাছে মাছে গোটা পাহাড় ভরে যাচ্ছে। যেন গোটা উঠানজুড়ে বিছানো পাটিতে একটার পর একটা লেঐরের ঝাঁকা খুলছে আর ছোট ছোট আঙুরের মতোন লেঐর ফলগুলি টপাটপ ডাইনে বায়ে উত্তরে দক্ষিণে ছুটছেতো ছুটছেই। টিকেন ভেবেছিল এই কাহিনী শুনলে কুঞ্জবতী একটু বিস্মিত হবে, হয়তো বলবে , লাইতিন ( অপদেবতা) ধরেছে নিশ্চিত। কিন্তু এইসব কিছুই বলল না। ভূত প্রেতের কাহিনী শুনার বয়স কি আর কুঞ্জবতী দেবীর আছে ! টিকেন যেন একটু হোচট খেল। সেও এইসব ভুতপ্রেতের গল্প করতে নিশ্চই কুঞ্জবতীর কাছে আসে নি । সে চেয়েছিল মালের বাদামটা আরো একটু মাথার গভীরে যাক। এত তাড়াতাড়ি রসের আলাপ করে ফেললে বাকী সময় কি নিয়ে কাটাবে। কুঞ্জবতী দেবী চা খাওয়া শেষ করে ফেলেছেন। তার হাতে অনেক সময় আছে। বারান্দায় চাটি পেতে বসেছেন। ছোট্মোটো বারান্দা । দুই পাশে বাঁশের তরজা। টিনের চাল। দূর থেকে তিকং কাকং পাখি ডাকছে। এই পাখি ডাকলে টিকেনের বুকটা হু হু করে কানতে চায়। এমন করুণ এর গলা ।বুকে এসে ছাঁৎ করে বাজবে। আর একটা পাখি হচ্ছে লামখুনু (ঘুঘু)।যখনই ডাকবে টিকেনের মনে হয় তার বুকের তলটা ছিঁড়েখুঁড়ে নিতে আসছে পাখিটা। একটুক্ষণের জন্য যেন সে উদাস হয়ে যায়।
“ নুঙাইতে নেনে নুঙাইতে ! ঈশা সে পিরিক পিরিক চা ঈ “
(সুখ নাই পিসি সুখ নাই । শরিলে শুধু অশান্তি )
কুঞ্জবতী দেবী নিরুত্তর।
“ আহিং তুমবা নমদে “
( ঘুমাইতে পারি না )
“ নুপি থিও ইয়াদ্রো । পাখাং মচা নি “
( ঘরে বেটিমানুষ নিয়া আয়। জুয়ান বয়স) কুঞ্জবতী দেবী উঠানের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেন। বাহিরে ধবধবে জোছনা। তিকং কাকং পাখি ডাকছে এখনো।
“এই বু কনা না নুপি পিদইগে !”
( আমারে কে বেটি দিবে গো !) । টিকেনের দীর্ঘশ্বাস ভারী হয়ে আছড়ে পড়ে বারান্দার শূন্য মাটিতে । তারপর সেখান থেকে সেইটা ধাওয়া করে যেন ছুটে যায় তিকং কাকং পাখির দিকে ।
“ উদারো, প্রেমদা লুহংবেই মতুংদা কমাইনা ফাজাখারে ! ঞারি অইনা লেইরাম্বা নুপিদো হৌজিক মপুম ফানা ইয়ুম পালিদো “।
( প্রেমদাকে দ্যাখ, বিয়ার পরে কেমন বদলে গেল। শুটকি হয়ে ছিল ,কিন্তু এখন কী ডবকা যুবতী হয়ে ঘর করছে। ) কুঞ্জবতী দেবী শিরশির করে কাঁপছেন যেন। প্রেমদার কথা উঠলেই তার শরীরের মধ্যে অমন উত্তেজনা হয় কেন !
“ আ …… হয় নে। ইয়াম নুঙাইনা লেইরি ইনে মাক “।
( আ…… হ্যা হ্যা ! সে এখন খুব সুখী ) । মালের ঘোরে এখনো আটকে আছে টিকেন। কথায় জড়তা স্পষ্ট।
“ প্রেমদার মশাদো উরাগা ইংয়াক ঞাই হে । পামবমগাদো লিরিলিরি তানা ক্যায়ামুক ফাজাই হাইরাদি “
(প্রেমদার শরিলটা দেখলে তাজ্জুব বনে যাই। হাতের ফনাগুলি কীরকম ডগমগ ডগমগ করে উঠতেছে। )
“ অদুমাইনা পামবম এইগি মৌগিছু লেইরাম্মি “
( এমন হাতের ফণা আমার বউয়েরও ছিল )
“ এ……! আনদোক না তুকাচ্চা খরেদা। কশুবি গি দুগি উয়া হাইরুনু। থুগাকপি নি দো “
( আ……! ঘিন্না করে ঘিন্না করে ! ওর নাম মুখে নিস না। ছিনাল একটা । ) বউয়ের কথা উঠামাত্র কুঞ্জবতী দেবী এমন চেতল কেন টিকেন সেইটা বুঝতে পারে। তার গ্রামের কেউই তার বউয়ের নাম মুখে নিতে চায় না ।
“ মাক গি লানবা নাত্বে হে মাক গি লানবা নাত্বে ! “
( তার দোষ নাই গো ! তার দোষ নাই ! )
এসময় গ্রামের দক্ষিণ দিকের শেষ মাথার বদোমন খুড়ার বাড়ি থেকে পুঙের চাটি ভেসে আসতে থাকে ট্যাং টেটেং টেং ! ট্যাং টেটেং টেং । খুড়ার নাতি রিংকু আজকাল তালিম শিখছে। জুয়ান ছেলেতো । পুঙের বোলে হাত পড়লে দূর গ্রাম পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায় সে আওয়াজ। এর আগে একদিন টিকেন আর কুঞ্জবতী দেবী এ নিয়ে আলাপ করেছিল। পুং আর ঢোলক এক নয়। ঢোলকে যত দূর শব্দ দৌড়াইতে পারো ,অসুবিধা নাই কোনো। কিন্তু পুঙ হল সম্পূর্ণ আলাদা একটা বাদ্য। এইটা মিহি হয়ে কানে লাগে। যত শুনবে তত বুকের তলায় সুরের উঠানামা হবে। ভরা পিতলের কলসীর ভিতর লাল শিং মাছেরা যেভাবে ঘাই মারে , ঠিক সেভাবে। চুপ্পুরু চুপ ! চুপ্পুরু চুপ ! কুঞ্জবতী দেবী পুঙের বোলে বেসুরো কাঁচা হাতের শিশুতোষ ভুল্গুলি মাপ করে দিলেন। আজ প্রেমদার শরীরের ঘ্রাণ যেন তিনি বাতাসে টের পাচ্ছেন।
“ নুংশিনবা মতমদা এই নুংশিহৌদরে ! “
( ভালোবাসার সময় আমি ভালোবাসিনি ! এটাই ছিল আমার ভুল )
“ লেওড়া ওয়া ঙাঞিরো ! প্রেমদাবু নংমা লাকসাল্লু “
( ধুর …… সেই তখন থেকেই ভালোবাসা ভালোবাসা ! লেওড়া ! প্রেমদাকে দেখিস না ! একদিন সুযোগ বুঝে তাকে লাগিয়ে দ্যাখ !)
“ মাক তি এই গি ইচে নি !”
( সে যে আমার বোন !) আবারও বড় একটা দীর্ঘশ্বাস টিকেনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। কুঞ্জবতী দেবীর সামনে মাটির খোলা মেঝেতে টিকেনের দীর্ঘশ্বাসটি আছড়ে পড়ে পুনরায় আগের মতো বারান্দার সামনা অংশ দিয়ে খোলা উঠানভরা চন্নির আলোর মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে শূন্যে মিলিয়ে যেতে চায় , একটু আগে যে তিকং কাকং পাখি ডাকছিল , সেইটা আর ডাকছে না । টিকেনের দীর্ঘশ্বাসটা সেই পাখির দিকেই উড়ে যেতো, কিন্তু পাখির ডাকটা না পাওয়ায় সেইটা উঠানজুড়ে শূন্যে দমবন্ধ ঘরের মতো পাক খেতে লাগল। টিকেন যেন তার ছেড়ে দেয়া দীর্ঘশ্বাসটা হাতের মুঠোয় ধরতে চায়।
“ নুংশিনবা সে খুয়াই পুনামাক কা ইয়াদে হে নেনে ! খুয়াই পুনামক কা ইয়াদে ! “
( ভালোবাসা সবার সাথে হয় না গো পিসি ! সবার সাথে হয় না !)
“ ধুর লেওড়া ! নংবু কনানা নুংশিনৌ হাইগে ! নচেবু তুমিন্না তৌথোও। “
( ধুর লেওড়া ! সেই একই ঘ্যান ঘ্যান ! তোরে ভালোবাসতে কে বলেছে। প্রেমদাকে একদিন লাগিয়ে নে। কেউ জানবে না। )
তিকং কাকং পাখিটা বোধ হয় চলে গেছে। এর ডাকটা শুনতে শুনতে হঠাত থামিয়ে দিলে বুকজুড়ে আরো বেশী নিসঙ্গতা নেমে আসে। টিকেনকে আজ মালের বাদাম বারবার ঘুরপথে নিয়ে যাচ্ছে। মাল খেলে মাথা আর কনট্রোলে থাকে না। সে যে এখনো বউকে মনে করে কান্দাকাটি করে তা কিন্তু একবিন্দু সত্য না। সে চাইছিল বুড়ির সামনে বউয়ের শরীর নিয়ে নানান রসের কথা তুললে বুড়ি নিশ্চই ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইবে অনেক কিছু। সেতো এখানে ভাব ভালোবাসার কথা বিনিময় করতে আসে নাই। বুড়ির কথাতো ঠিকই আছে। “বালের ভালোবাসার টাইম আছে নি”। কিন্তু বুড়ি বারবার প্রেমদার কথা তোলে তাকে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। এও কি সম্ভব ! ভাই বোনে কি এইসব করা যায় ! হালা ! বুড়া হলে মানুষের মতি গতি ঠিক থাকে না, কথাটা আসলে ঠিকই।
৮
এইগুলা জীবনের ছোট্ট একটা অংশ। যাকে বাংলায় বলে টাইম পাস। বুড়ির বাড়িতে কি হয় নাহয় এইসব টিকেন বুড়ির বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে আর মনে রাখে না। যেদিন মাল খায় সেদিন সারা রাত সে বিন্দাস থাকে। বাড়িতে যেয়ে সে ঐদিন দুইটা ডিম একসাথে আলু দিয়ে রান্ধে। ঝাল ঝাল আলু শখ। তারপর পেটপুরে খেয়ে বাবুসানাদের সাংগইতে (গোয়ালঘর) চলে যায়। সেখানে প্রায় প্রতিদিনই জুয়ার আসর বসে। টিকেন রেগুলার কাস্টমার নয়। তবে যেদিন মাল খায় সে সেখানে যেয়ে খেলে। অনবরত বকবক বকবক করতেই থাকে। জোশ নেয়ার জন্য খেলা আর কি। আর কিছু না। মাঝেমধ্যে মনে হয় ,এইভাবে বউবাচ্চাকাচ্চা ছাড়া সে অনেক সুখে আছে। যখন ইচ্ছা বাড়ি ফিরছে। মন চাইলে মুরুগ রেঁধে খাচ্ছে। যেদিন মন মানে না, সেদিন কামে যাচ্ছে না। এইতো জীবন ! তাই না ! কিন্তু ঘুম থেকে পরদিন উঠার পরই আবার সেই নিসঙ্গতা তাকে জেঁকে ধরে। এইটা এমন একটা অসুখ যাকে ধরে তার পিছু আর সহজে ছাড়ে না। হাই ইশকুলে থাকার সময়ে বাংলা ব্যকরণে সে পেয়েছিল- অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। কথাটা দেখা যাচ্ছে তার জীবনে এসে ফলে যাচ্ছে। যতক্ষণ একা থাকো ততক্ষণ খালি বেটিমানুষের শরিল নিয়ে কল্পনা । অমুকের বউ তমুকের বউ অমুকের মা তমুকের নেনে ( পিসি) –কল্পনায় মাথাটা বেদিশার মতো হয়ে যায়। আর দেশটা এত সতী সাবিত্রীতে ভরে গেছে যে এলাকায় একট মাগি নাই এখন। এইগুলা দু একটা থাকলে কিছুটা আরাম পাওয়া যেতো। হাজার হোক, জুয়ানকি শরিল, তুমি তাকে খাবার সময় খাবার দেবে না পানি দেবে না যতন নেবে না – তাই কি হয় ! শরীরতো একটা পোষা কুকুরের মতোন । ঠিক না ! উপাস থাকতে থাকতে কুকুর যেমন ঘাউ করে তার মনিবকে ধরে ফেলে ,জুয়ানকি শরিল কি ঠিক সেরকম নয় ! মানুষ কুকুরকে গরুকে পিছনদিক থেকে লাগায় কেন ! এইটা যারা বুঝবে না তাদের বুঝানো যাবে না কখনো। শরীরে জলন্ত লাভা থাকলে তাকে কোন না কোনভাবে চোরাস্রোতের মধ্যে দিয়ে যাবার রাস্তা দিতে হয়। নাহলে বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে। টিকেনকে বাধ্য হয়ে আবার কুঞ্জবতীর কাছে যেতে হয়। বুড়িটা যে আছে সেটাই একটা রক্ষা।
৯
জীবনের বড় একটা অংশ কুঞ্জবতী দেবী রেডিও শুনে শুনে কাটিয়েছেন। দুপুরবেলা ভাত খাওয়ার পরে উঠানে বসে সবাই মিলে শুনছেন ইম্ফল রেডিওর অনুষ্ঠান। খবর বলার পরে গানের প্রোগ্রাম শুরু হতো। কুঞ্জবতী দেবীর মনে আছে , সেই শিল্পীর নাম ছিল লাইশ্রাম সারদা দেবী। কি দরদ নিয়ে ঐ মহিলা গান গাইতেন। তার গলাটা কারো সাথে মিলে না। জীবনে কম বেশী অনেক গান শুনেছেন। তবে সারদা দেবীর গলাটা প্রথম স্বরেই চিনে ফেলতেন কুঞ্জবতী দেবী। সে এমন দরদ মিশিয়ে গাইতো যে মনে হতো কলিজার দেয়াল টুকরা টুকরা হয়ে মাঘ মাসের দুপুরবেলা কুঞ্জবতী দেবীদের বাড়ির সামনের উঠান ,উঠান থেকে থংগানে ( বাড়ির গেইট) যাওয়ার পাতাবাহার ফুলগাছের ছায়াঘেরা সরু রাস্তা তারপর বিনোদিনীদের বাড়ির বটগাছের ছায়া , সবুজ ফেনাভরা পাড়ভাঙা পুকুর, বড়ই গাছতলা, ধান শুকানোর গোবরনিকানো খালি খলা – এইসবগুলাতে আছড়ে পড়তো। যারা ভালোবাসে নি কোনদিন তারা সারদা দেবীর গান শুনলে বুক ফেটে আর্তনাদ করে কাঁদবে। বারান্দায় জাল বাইন করা কুঞ্জবতী দেবী রেডিওতে গান শুনলেই কী অব্যক্ত এক বেদনায় তার দু হাত স্থবির হয়ে যেতো। কেউ দেখে ফেললে লজ্জার কথা হয়ে যাবে। কিন্তু শত চেষ্টা করেও বুক থেকে উথলে ওঠা কান্না কুঞ্জবতী দেবী থামাতে পারবেন না। বহুদিন পর আজ শেষ আশ্বিনের এক সন্ধ্যাবেলা নিজের বাড়ির বারান্দায় বসে লাল চা খেতে গিয়ে সেইসব স্মৃতির কথা মনে পড়ে যায় তার। প্রায় কয়েক বছর হলো সারদা দেবীর গান কোথাও আর তিনি শুনতে পান নি । তার বোনের বড় মেয়েটা গান ও মহাভারতের কাহিনী শুনবার জন্য একটা মোবাইল ফোন দিয়েছিল। তিনি যদি ভাগনিটাকে বলতেন সারদা দেবীর গান মোবাইলে দেয়ার জন্য, নিশ্চই সে দিতো, কিন্তু তিনি ভাবলেন আজকালকের বাচ্চারা সারদা দেবীকে চিনবে তো ! যদি না চিনে , তখন বলবে ইন্দমচার (খালা) মাথা ঠিক নাই, এমনওতো বলে ফেলতে পারে, বিয়া না করে ইন্দমচা না জানি কোন স্মৃতির ঘোরে আটকে আছে। মহাভারতের বিশাল লম্বা কাহিনী তাকে ক্লান্ত করে দেয়। এখনো মাঝেমধ্যে শুনেন তিনি। গান্ধারীর পার্টটা তার সবসময় ভালো লাগে। গান্ধারী যখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার শত পুত্র মৃত্যুর জন্য অভিশাপ দেন ,কুঞ্জবতী দেবীর সেসময় আপনা থেকেই রক্তের ভিতর খলবল শুরু হয়ে যায়। মনে হয় তিনিও জীবনে স্নেহ প্রেম ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত বলে গান্ধারীর দুঃখে সমব্যথী হোন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে অভিসম্পাত দিলে তারও যেন বুকটা জুড়িয়ে আসে। কিন্তু আজকাল আর এটা শুনতে গেলেও ক্লান্তি আসে । আজ সারদা দেবীর সেই গানগুলি এই ভর সন্ধ্যাবেলা কারেন্টের ভালবজ্বলা ছোট্ট উঠানের এক কোণায়, শিউলিগাছের তলায় ন্যাতানো ল্যাপ্টানো পড়ে থাকা শিউলি ফুলগুলির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কেন যে মনে আসল। এই বয়সে কেন যেন এতটুকু ভালোবাসার জন্য তার ভিতরটা ,শুকনো গাতায় আটকে পড়া মাছের মতোন শূন্যে খাবি খাচ্ছে। আজ সারদা দেবীর সেই গানগুলি কেন যে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে তার ! তিনি কি একটু কেঁদে নিজেকে স্বান্ত্বণা দেবেন ! কাঁদলে নাকি বুকের কষ্ট হালকা হয়ে যায় । কে জানে !
কাল রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন টিকেনের সাথে এক বিচনায় শুয়ে আছেন। হঠাত করে এখন মনে পড়ে গেল তার। অদ্ভুদ এক শিরশির করা অনুভূতি ছিল সেইটা। সারা শরীরজুড়ে যেন অসংখ্য লামখুনু ( ঘুঘু) বৃষ্টি পড়ার ছন্দে নাচতে লাগল। কিন্তু পূর্ণ রাগমোচনের সময় তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পরপরই তিনি টিকেনের সাথে এক বিচনায় দেখেছেন বলে নিজেকে এক প্রস্থ গালি দেন। স্বপ্ন যখন দেখব তখন ভালো সুপুরুষ একটাকে দেখা উচিত। শরিলে বাংগর ভইষের বোটকা গন্ধ করা টিকেনকে দেখতে হবে কেন , এত পুরুষ থাকতে ! এখন এই সন্ধ্যাবেলা কাল রাতের এই স্বপ্নের কথা মনে আসলেও তার এক বিন্দু উত্তেজনা হলো না। সারদা দেবীর গানের ঘোর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি বের হতে পারেন নি।
টিকেন আজ বেশ উত্তেজনা নিয়ে কুঞ্জবতী দেবীর কাছে এসেছিল। সে এখন থেকে আবিষ্কার করেছে, বুড়ি কুঞ্জবতীকে হাতে রাখতে গেলে তার কথামতোই চলতে হবে । সে যতবার তার বউর কথা তোলেছে ততবারই কুঞ্জবতী দেবী তাকে তার বোন প্রেমদার কথা তোলে নাজেহাল করেছে। টিকেন খেয়াল করে দেখেছে, বুড়ি প্রেমদার আলাপ ছাড়া আর কারো কোন কথা শুনতেই রাজি না। যেহেতু তার আর যাবার আর কোথাও জায়গা নাই, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বুড়ির কথাই থাকুক। কল্পনার পৃথিবীতে কে জানবে আর কে এসে খুঁজবে ! বুড়ি তাকে প্রেমদার সাথে শোয়ার তাগদা দিলেও সে শোবে নাকি ! বাস্তবে এইসব কি আর সম্ভব ! নিজের নিষঙ্গতা ঢাকতে এইসব করতে সে বাধ্য হচ্ছে। শুধু বুড়ি আর সে ই জানবে । আর কেউ জানতে পারলেতো !
টিকেন এসে দেখে বুড়ি তার ঘরের বারান্দায় মুখ ভার করে বসে আছে। এমন গম্ভীর অবস্থায় টিকেন বুড়িকে দেখতে পাবে বলে কল্পনা করে নি। কুঞ্জবতী দেবী এমনিতেই গম্ভীর মানুষ। কিন্তু আজকের মতোন অমন দৃশ্য টিকেন এর আগে কখনো দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। যেন চৌদ্দ বছর বয়সী কোন কিশোরীর প্রেমিক ধোঁকা দিয়ে চলে গেছে। কুমারী মেয়েমানুষতো ! যখন তখন প্রেমের সাগরে ভেসে বেড়ানো খুবই স্বাভাবিক। টিকেন আজ মালটাল খায় নি। সে ধীরে ধীরে বুড়ির সামনে চাটাইতে বসে পড়ে। বুড়ি নাহয় একটুক্ষণ নিজের চিন্তায় ঘোরের মধ্যে থাকুক। ততক্ষণ টিকেন একটু বসবে, হালকা চালে গপসপ শুরু করবে। এত তারাহুড়ারতো দরকার নাই কোন। ঠিক না ! বুড়ি কুমারী অভিজ্ঞতা না থাকা মেয়েমানুষ হলেও সেতো আবিয়াতি ব্যাটামানুষ নয়। তার কি এখন ছটফট করা সাজে !
আজ চন্নি নাই। আশ্বিনের শুক্লপক্ষ। বৃষ্টি দেয় নি প্রায় সপ্তা দুয়েক হবে। গরম পড়েছে খুব। বুড়ি এই গরমে হাতপাখা একটা কাছে নাই , ভিতরে যেয়ে ফ্যানের নীচে বসতে পারতো, যেহেতু কারেন্ট আছে , এই উদাম বারান্দায় বসে আছে কিভাবে ভগবান জানেন ! বুড়ির দু চোখ বাহিরে উঠানের কোণে শিউলিগাছের তলায় – কী অমন রাজপুত্রকে দেখছে কে জানে !
“ নং চখ্রো টিকেন। এই মামন নুঙাইতে “
( চলে যা টিকেন। মনটা ভালো নাই )
টিকেন শুনল, এক কিশোরী যেন বলছে, চিৎকার দিতে দিতে , “চখ্রো চখ্রো” (চলে যাও চলে যাও)। কুঞ্জবতী দেবীর অমন ধীর গম্ভীর গলা শুনে টিকেন কিছু বলার আর সাহস পেল না। মেয়েমানুষ , চৌদ্দ হোক অথবা চুয়াত্তর –তাদের মতিগতি বুঝা মুশকিল।
=====================