You are currently viewing আলী সিদ্দিকী’র কবিতাগুচ্ছ

আলী সিদ্দিকী’র কবিতাগুচ্ছ

 

আলী সিদ্দিকী’র কবিতাগুচ্ছ

 

বিচ্ছিন্ন বিষাদ

 

ঘষে দিলেই সব পাথরে হয় না আগুন

কৃষ্ণচূড়া সব হৃদয়ে রাঙায় না ফাগুন।

 

এখন-

সূর্যের ছায়ার ভেতর নিগূঢ় অন্ধকার

ফুলে ফুলে উঠছে

ফোঁস ফোঁস করছে সমুদ্রের হৃদপিন্ডের

ভেতর গহীন গর্জন

মাটির গভীরের মানব শেকড়ে উঠেছে

কম্পনের মোচড়—

কালান্তরের কোন মোহনা জেগে উঠছে

প্রাণের কলতান মুখর প্রিয় পৃথিবীর

দিগন্তরেখায়?

ভাবনার ভাঁজে গিঁট দিয়ে বসে বিশ্বজন।

 

পানশালার নুড়ি গুণে গুণে তুমি হয়েছো

নিরুত্তাপ কাদাপোকা

মরা চাঁদের বিবর্ণ মুখে খুঁজে ফেরো কোনো

উষ্ণ মুখের শ্যামলছায়া

ঢ্যামনা সাপের মতো চুকচুক করো দিনরাত

নির্বিষ আস্ফালনে—

প্রতাপখেকো খুনে মাকড়সা চুষে নিচ্ছে রস

মন মগজ আর মজ্জার সমূহ বিভাস

বিরামহীন বাধাহীন।

 

নেই দ্রোহ নেই ফাগুনের যৌবনময় চৈরিবৈতি

তোমার নিস্ফল নিরাসক্তি এনেছে দাহ দুর্গতি।

 

মানুষ ও মেঘ, বৃষ্টিদিনে

 

তোমার পাখা নেই, মানুষের থাকে না-

হাওয়া তবু তোমার উপর ভর করে উড়ে।

কান কথা-কানে দেয়া কথামৃত-

নড়ে যায় কলকব্জা

মগজ আর মননের

আলগোছে হয়ে যাও সব বিস্মৃত।

 

ঘরবাড়ি নেই মেঘের, মানুষের আছে-

মেঘের সন্তান বৃষ্টিরা ভূখন্ডে ঝরঝর ঝরে।

বৃষ্টির গান-জীবনমহিমা বন্দনা-

উষ্ণীষ কোমল মন

প্রণয়ে আর বিরহে

বৃষ্টিদিনে মানুষ ও মেঘ আনমনা।

 

পাখা নেই মানুষের, মেঘের আছে উড়ালভঙ্গি

মানুষের মন হয় ছুটন্ত মেঘেদের অচেনা সঙ্গি।

 

সজারু সময়

 

দিনের কার্ণিশে গাওয়া অচেনা পাখির গান

খেয়ে যায়

সজারু রোদ

মহানন্দে শকুনেরাও মানুষের করোটি খুলে

খুঁটে খায়

মনন ও বোধ।

 

মাটির চিতায় পোড়ে বুকের ভেতরের গোর

প্রেমাংশুর হাঁড় মজ্জাতে হয়েছে ভূমি উর্বর।

 

করতলে নৃত্যরত নন্দন গোলকের কপালে

জ্বলে বৈধব্য

রাক্ষুসে ঘৃণা

ছুঁয়েছে মানুষ অসুন্দর সব বীভৎস ভয়াল

ক্ষয়-অবক্ষয়

শীর্ষ বেদনা।

 

সময় চাতালে তুমি আমি নিছক কল্পতরু

মায়া আর মোহের আদলে বিভ্রম সজারু।

                    

কথাগুলো ফিরিয়ে দিও

 

কথাগুলো ধার দিয়েছিলাম বড় বেহিসেবি-

যাবার কালে ফিরিয়ে দিও।

দিয়েছিলাম গল্প দিয়ে তৈরি নানারকম ছবি

কানফাটানো ঠোঁটের শিস ও সরস খুনসুটি

দিয়েছি কতো কতো রাঙতায় রাঙানো প্রহর

বাচালবৃষ্টিতে উল্লাসে উচ্চকিত হঠাৎ কদম

ফাগুনের আগুনজ্বলা উত্তরীয়।

 

স্বপ্নগুলো ছড়িয়েছি বড়ই ছেলেমানুষিপনায়-

যাবার কালে কুড়িয়ে দিও তাদের।

ছড়িয়েছি ছন্নছাড়া আশালতা আনাচকানাচ

অক্ষরে বর্ণমালায় দিয়েছি কতোই না ব্যঞ্জনা

কতো কতো ভয়ের বাঘ মেরে টাঙিয়েছি রোদে

জুজুবুড়ির ছানাবড়া চোখ দিয়েছি কতো গ’লে

পাঁচমিশেলি পরশ দিয়েছি স্বাদের।

 

ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই আমাকে গুছিয়ে দিও

নেবার যদি থাকে কিছু ষোলআনা তার নিয়ো।

 

আড়ালের ছায়াছবি

 

আড়াল তুমি,

মুক্তো লুকাও সুকৌশলে

অভিনব আড়ম্বরে-

সাগরেরও অজানা জলের পরকীয়া।

ভাঙনের খোলসে গোপনে চলে

কতো মাখামাখি-

প্রেমানুরাগ জ্বলে চৌকষ আলোয়

তোমার তুমুল নিপুণতায়।

 

আড়াল তুমি,

জীবনঘাতী জীবাণু অস্ত্র করোনা

নিতান্তই বাদুড়ের দায়-

বহুজাতিক বেলেল্লাপনার নামান্তর।

ঘাতক নখর লুকিয়ে চলে প্রেমের চাষ

বহুগামী শাণিত করাত-

নীরবতা পূজোয় তুমি বৈদেহী ধ্যানী

বাগাড়ম্বর চলে টেবিলে আর ধোঁয়ায়।

 

 

আলী সিদ্দিকী

মূলত কবি ও লেখক। জন্ম সূর্যসেনের দেশ  ও বন্দর কর্ণফুলীর শহর চট্টগ্রামে, ১৯৬১ সালে। শিক্ষাজীবন কেটেছে চট্রগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে মাষ্টার্স। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ডেভরাই ইউনিভার্সিটি থেকে হিউম্যান রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্টের উপর মাষ্টার্স অব বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়ায় বসবাস করছেন এবং বেসরকারী সংস্থায় কর্মরত আছেন।

নব্বইয়ের দশকে সামরিক শাসনপীড়িত সময়ে এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের আবহে মূলধারার সম্পৃক্ততায় কবিতা ও কথাশিল্পের ভুবনে বিচরণ শুরু। শেকড়ঘনিষ্টতা, জাগৃতি, বোধ আর মননের নিগূঢ়তায় গড়ে তোলেন কাব্যবোধের জীবনসম্পৃক্ততা। মানবজীবনের বিভিন্ন স্তরের মানুষের বিচিত্র সম্পর্কের গ্রন্থি- আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক, ব্যক্তি ও সমাজকেন্দ্রিক মানবিক মূল্যবোধ, প্রাত্যহিক জীবনের দ্বান্ধিকতা তার লেখনীর প্রতিপাদ্য বিষয়। সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জটিল ও দুঃখময় জীবন সংগ্রাম তার গদ্যের জীয়নকাঠি। ধর্মীয় কুপমুন্ডকতা, অন্ধত্ব আর অমানবিকতার বিরুদ্ধে এবং প্রগতিশীল মানবিক মুক্তচিন্তার স্বপক্ষে সোচ্চার তার লেখনী। সুদীর্ঘ সময় মুক্তবুদ্ধির র্চ্চায় সম্পৃক্ত থাকলেও প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে তিনি বরাবরই প্রচারবিমুখ।

বর্তমানে ‘ মন-মানচিত্র’ সম্পাদনায় যুক্ত।

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ হলোঃ

১.         শঙ্খসোহাগ (গল্প-শৈলী প্রকাশন, ২০০০)

২.        নীলমনি (গল্প-পূর্বা প্রকাশন ২০০২)

৩.        আসুন, সত্যবাদীদের অভিনন্দন জানাই (প্রবন্ধ-সন্দেশ প্রকাশন ২০০৪)

৪.         প্রলম্বিত আঁধার (উপন্যাস-সন্দেশ প্রকাশন ২০০৫)

৫.        রাজেশ্বরীর দায় (গল্প-বলাকা প্রকাশন ২০০৬)

৬.        তিমিরানন্দে বাংলাদেশ (প্রবন্ধ-বলাকা প্রকাশন ২০০৬)

৭.         পলিমাটির পাঁচালী (প্রবন্ধ-বলাকা প্রকাশন ২০০৯)

৮.        মেঘদ্রোহী সূর্যসখা (কবিতা-বলাকা প্রকাশন ২০১০)

৯.        প্রতিপক্ষকাল (উপন্যাস-বেহুলাবাংলা ২০১৭)

১০.       মনোময় (কবিতা- বেহুলাবাংলা ২০১৯)

১১.       ঘোরবন্দী (গল্প-শুদ্ধপ্রকাশ ২০১৯)

১২.      অন্ধশিকার (গল্প- পাঞ্জেরী ২০২০)

১৩.      ষষ্ঠশরের গীত (কাব্যগ্রন্থ-খড়িমাটি ২০২১), এবং

১৪.       মায়াকাঞ্চন মালীর পৌরাণিক উনুন (কাব্যগ্রন্থ- আপন আলো ২০২১)