সমালোচনা সাহিত্য কিরকম হ’তে পারে?
ফাল্গুনী ঘোষ
একটি শিল্পকর্ম। কলম কালি মনন চিন্তন আবেগ অভিজ্ঞতা নির্মাণ চরিত্র চিত্রণ ঘটনা প্রবাহ রাইজিং অ্যাকশন ক্লাইম্যাক্স, ফলিং অ্যাকশন নির্বাচিত শব্দ অর্থ বাক্য নিয়ে কবি নাট্যকার গল্পকার উপন্যাসিক প্রাবন্ধিক একটা লেখাকে আমাদের সামনে তুলে ধরলেন। সমালোচনা অর্থাৎ সমান আলোচনা। ‘সম’ অর্থাৎ সমান তুল্যমূল্য একইরকম। ‘আলোচনা’ অর্থাৎ ‘আ’ + ‘লোচন’ + ‘আ’। ‘আ’= পর্যন্ত, ‘লোচন’ = চোখ। অন্ত ‘আ’ বোঝাচ্ছে ‘আলোচন’কে সার্থকতা দিতে। সবশেষে দাঁড়ালো যতদূর চোখ যায় ততদূর একটি শিল্পকর্মে যা লিখিত ফর্মে আছে তাতে আলো ফেলা। চোখ হল মনের আয়না আবার চোখ মনকে মেসেজ পাঠায়।যেটা দেখা হল, পড়া হল, সেটা পড়ে কী বোধ হল! যেকোনো টেক্সট পড়ে একটা অনুভূতি হয়। এই অনুভব করার ক্ষমতা আমাদের বৌদ্ধিক ধর্মকে নাড়িয়ে দ্যায়। অনুভূতি ও বুদ্ধিমত্তার মিলনে আমাদের একটা গভীর বোধ তৈরী হয় মনের মধ্যে।এই মনই বলে দেয় শিল্পকর্মটির দার্শনিক সত্য।দর্শন হল ভিতরের সত্য। যেটিকে আবিষ্কার করতে হয় যিনি সমালোচনা করতে চলেছেন অর্থাৎ সমালোচককে।
উচ্চমানের ভালো সমালোচক হতে গেলে প্রচুর পড়াশোনার দরকার।ইতিহাস, ভূগোল, মিথ,ধর্ম, রাজনীতি,দর্শন, কাব্য, সাহিত্য প্রভৃতি। সমালোচককে হতে হবে ভূয়োদর্শী ও নিরপেক্ষ। আবেগের ঘনঘটা তার মধ্যে যেমন অনুপস্থিত থাকবে তেমনি ঠিক শুধুমাত্র শুকনো নিরস বুদ্ধির পাথুরে খটখটে কলম নিয়ে তিনি লিখবেন তাও না। ভাষার ব্যাবহারে তাকে সংবেদনশীল হতে হবে অবশ্যই।বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু এই তিনজন বেশ বড় মাপের সমালোচক। বঙ্কিম বাবুর পান্ডিত্য, রবীন্দ্রনাথের রসসিক্ততা, ও বুদ্ধদেব বাবুর ব্যালান্সিং এ্যাক্ট খুব ভালো লাগে। সত্যিকারের ভালো সমালোচনার কাজ তথ্যনিষ্ঠ হোক। বেশী বেশী তাত্ত্বিকতা ও পূর্ববর্তী কবি সমালোচকদের উদ্ধৃতি ব্যাবহার অনেক সময়ই সমালোচকের নিজের স্বাধীন অভিমতকে প্রতিবন্ধী করে তোলে।
ঠিক সেইজন্য গভীর সমালোচনাকে কোটেশন বা উদ্ধৃতি সীমায়িত করার প্রয়োজন পড়ে। আজকালকার অনেক অনেক পণ্ডিত অ্যাকাডেমিককে দেখি তাঁরা একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে এত এত অপরের কোটেশন ব্যবহার করেন যে মনে হয় তাঁর নিজের অভিমত কি?কোথায় তাঁর স্বাধীন কন্ঠ? ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে, শিল্প নিয়ে যাঁরা গবেষণামূলক কাজ করেন বা করছেন তাঁদের একটা বড় বিষয় হল সার্চিং। রিসার্চিং করা কোন্ সমালোচক কোন্ পণ্ডিত, কোন্ লেখক উক্ত শিল্পকর্মটিকে নিয়ে আগে কী কী কথা বলে গেছেন। এই পড়াশোনা করতে করতে জানতে জানতে গবেষকের মনে ঘাত প্রতিঘাত হয়। অবশেষে একটি অভিঘাত প্রতিষ্ঠা পায় নিজের মেধা ও চিন্তনের ঘরটিতে।অভিঘাত অর্থাৎ অভিজ্ঞতা লব্ধ ঘাত। ধরা যাক্ একটি টেক্সটকে নিয়ে বঙ্কিম বাবু কী বললেন, রবীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব কী বলে গেছেন। জীবনানন্দ, শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র মুখোপাধ্যায় কিম্বা বিনয় মজুমদার কী বললেন, কিম্বা উজ্জ্বল কুমার মজুমদার ,সুমিতা চক্রবর্তী কী বললেন, একজন গবেষক সবগুলিই পড়লেন। শেষে তাঁর মননন ও মেধা কোন্ কোন্ দিকগুলিকে গ্রহণ করবেন ও করলেন সেটা তাঁর ব্যক্তিগত মন ও মেধার অবস্থান ও গভীরতার উপর নির্ভরশীল।
ইংরেজীতে সমালোচনার কাজটিকে বা সমালোচনা সাহিত্যকে বলে ‘critique’, আর সমালোচককে বলা হয় ‘critic’। এই ‘critique’ কথাটি criticism এর সঙ্গে সংযুক্ত। একটি লিখিত শিল্পকর্মের criticism অর্থাৎ সমালোচনার কাজটি দ্বিমুখী হতে হবে।’cretos’ এই গ্রীক শব্দটি থেকে criticism কথাটি এলো। ‘cretos’ কথাটির মানে হলো ‘to judge’ ——- to judge the merit and the demerit of the text . একটি সমালোচনার কাজ হওয়া উচিত গৃহীত লিখিত শিল্পকর্মের তো সে কবিতা নাটক গল্প প্রবন্ধ উপন্যাস যাই হোক মেরিট ও ডিমেরিটকে বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে। অবশ্যই তা হবে লজিকাল।যুক্তিগ্রাহ্যতা হলো সমালোচনা সাহিত্যের মেরিট বা মেধা চর্চার অন্যতম শক্তি। ধরুন আমি বললাম কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর কবিতায় মেধা কম আবেগ বেশী। কেন মেধা কম আবেগ বেশী তা মননশীল যুক্তির মধ্য দিয়ে গ্রহণযোগ্য করতে হবে পাঠকের কাছে। ঠিক সেইজন্যই পাঠককে বই সমালোচনা সাহিত্য পড়ার জন্য দীক্ষিত হতে হয়।
একটি লিখিত শিল্পকর্মের সবটাই যদি মধুমাখা বুলিতে ভরিয়ে তোলা হয় (যেটা বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলি করে তাদের প্রোডাক্ট বিক্রি করার জন্য) তাহলে সেখানে সমালোচনা সাহিত্য আর বেঁচে থাকে না। Critical appreciation যদি হয় তাহলে সেখানে critic বা সমালোচকের প্রশংসা পেতে পেতেই পেট ভরে যায়। মহান রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ ভক্তেরা যুগে যুগান্তরে তাই করেছেন।এইভাবে রবীন্দ্রনাথকে তারা দেবতা বানিয়ে দিয়েছেন। কবি ও সাহিত্যিক হিসাবে রবীন্দ্রনাথ-ই আমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অনেক শিল্পকর্ম not up to the mark.
অর্থাৎ মেরিটলেস ও মেধাহীন।একজন রবীন্দ্র সমালোচক যদি শুধুমাত্র তার মেরিটের কথাগুলোই উচ্চভাবে বলে যান তবে সেখানে বুঝতে হবে সমালোচক হিসাবে তার খামতির কথা। পরিপক্কহীনতার কথা।ঠিক এইভাবে কবি নজরুলের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রমী নয়।
“Ripeness is all”— মহান শেক্সপীয়র বলে গেলেন। অর্থাৎ সমালোচনার কাজটি উচ্চিংড়ি লেখকের কম্ম নয়। প্রাজ্ঞতা দাবী করে নিশ্চয়ই।সমালোচনার কাজ কঠোর ও নির্মোহ। কবি কোলরিজ তাঁর বন্ধু কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর সমালোচনা করেছেন কবিতা নিয়ে।কিন্তু তাঁরা একে অপরের বন্ধু। আজকের দিনে আমি যদি কোনো বন্ধুর কবিতার সমালোচনা করি অর্থাৎ তার কবিতার মেরিটের সাথে ডিমেরিট-ও ধরিয়ে দিই তাহলে সে রেগে যেতে পারে, আবার কেউ কেউ খুব কম জনই সমালোচনাকে আমন্ত্রণ করে। সমালোচনা মানে গালাগালি করা নয়। অন্ধকার দিকটিকে তুলে ধরা নয়, আলোর দিকটিও বিশ্লেষণ করা। এবং আঁধারকে আলোময় কীভাবে করা যায় তাও বলা। এ এক জ্যোৎস্নার চাঁদের মত। আলোময়। তবুও সেই আলোকিত চাঁদে ছোপ ছোপ কিছু কালো আছে।সেই কালোকে দূর করে লেখকের পরের লেখাটি আরো বেশী আলোময় হয়ে উঠবে সেইটাই প্রণিধান যোগ্য।
এইভাবে একটি সমালোচনার কাজ টেক্সটির লেখক ও পাঠকের মধ্যে একটি সেতুবন্ধ হয়ে দাঁড়ায়। সত্যিকারের সার্থক ও উত্তীর্ণ সমালোচনা সাহিত্য যুগে যুগে বেঁচে থাকে। আমরা যারা সাহিত্যের মগ্ন পাঠক ও সমালোচনা লিখি তারা নিশ্চয়ই বুঝি একটা সিরিয়াস সমালোচনার কাজ কীভাবে গঠনমূলক হ’তে পারে।
গঠনমূলক সমালোচনা পাঠককে আকৃষ্ট করে।শুধুই নেগেটিভ ক্রিটিসিজম যেমন একটা ঠান্ডা মেঘলা বৃষ্টি বিঘ্নিত দিনের মত, ঠিক অন্যদিকে পজিটিভ বা কনস্ট্রাকটিভ ক্রিটিসিজম একটি সূর্যকরোজ্জ্বল দিনের সাথে হালকা হালকা মেঘের ছায়াঘন মৌতাতে মিষ্টি হয়ে ওঠে। এইজন্য সমালোচনা সাহিত্য হয়ে উঠুক balanced and poised according to the text.
সবশেষে বলি একটা লিখিত শিল্পকর্মকে তার structure ও content অর্থাৎ গঠনশৈলী ও বিষয়বস্তু এই দ্বিমুখী দিক থেকে সাধারণতঃ বিচার করা হয়। গত একশ বছর ধরে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আগে ও পরে সমালোচনা সাহিত্যে বিশ্ব জুড়ে New criticism, Historical criticism ,Psychoanalytic criticism , Marxist criticism, Feministic criticism , Cultural — Materialism , Archetypal criticism, Dialogical criticism — Structuralism — Post structuralism , Deconstruction এইসব থিওরিকে কেন্দ্র করে টেক্সট অনুযায়ী বিশ্লেষিত হচ্ছে। স্কলাররা বলছেন নতুন দিক উন্মোচনের কথা। তাতে করে একটি টেক্সট ব্লু আত্মাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে ডাক্তারি ছাত্রের মত অ্যানাটমি, ভিভিসেকশন, পোস্টমর্টেম করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে টেক্সটি তার ফুলেল সৌন্দর্যকে হারিয়ে, নান্দনিক আবগকে হারিয়ে, বিষয়ের গভীরতা, অপার বিস্ময় ও আবেগকে হারিয়ে, রহস্যময়তার ইন্দ্রজালকে নস্যাৎ করে, জ্যোৎস্না রাতের আধো আলো ছায়াকে হারিয়ে, বৌদ্ধিক ক্যাননের ( মাপকাঠি) হাজার ওয়াট ফ্লাড লাইটের সামনে দাঁড়াতে গিয়ে সাহিত্যের নিগূঢ়তম রসবোধকে বিঘ্নিত করছে। তবে পণ্ডিতদের কথা বাদ দিয়েও বলি সুসাহিত্যের সমালোচনা কাজ এক বিস্ময়কর্ম তো বটেই সাহিত্য শিল্পকর্মটির অন্তর আত্মাকে খুঁজে নিতে। যা একজন প্রকৃত সাহিত্য সমালোচকের দ্বারাই সম্ভব। এই কাজ একজন সাধকের, সবার নয়।
****************************************
ফাল্গুনী ঘোষঃ কবি, অনুবাদক ও সম্পাদক
****************************************