You are currently viewing কোথা গেলে তারে পাই ।।মোস্তফা অভি

কোথা গেলে তারে পাই ।।মোস্তফা অভি

কোথা গেলে তারে পাই
মোস্তফা অভি

স্বপ্নের ভেতর সৈকত স্যার এসে আমাকে বললেন ‘ভালোবাসি।’
আমি জানতাম, এটা আমার স্বপ্ন। আমি মাথার নিচের বালিসটা ঘুরিয়ে অন্যপ্রান্তে দিয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম। স্যার, স্বপ্নের ভেতর আবারও এসে বললেন, ‘ভালোবাসি।’ ঘুম ভাঙার পর আমার বহু বছর আগের সৈকত স্যারের কথা মনে পড়ল। যখন আমি ক্লাস ফাইভের ছাত্রী, প্রতিদিন আমরা সৈকত স্যারের ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করতাম। তিনি ছিলেন যথেষ্ট সুদর্শন, মৃদুস্বরে কথা বলতেন আর প্রতিটি কথায় ছিল হাসিহাসি ভাব। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তিনি এমনসব শিশুতোষ গল্প বলতেন, আমরা হাসতে হাসতে প্রায় মাটিতে গড়িয়ে পড়তাম। যেদিন আমরা কেউ অসুস্থ বোধ করতাম, বিষয়টা পরিবারের কাছে চেপে যেতাম। কেননা, আমরা মনে করতাম, অসুখের কথা জানাজানি হলে পরিবার থেকে কিছুতেই আমাদের স্কুলে যেতে দেওয়া হবেনা। অথচ আমরা একদিনের জন্যও সৈকত স্যারের ক্লাস মিস করতে চাইতাম না। প্রতিদিন আমরা স্কুলে তৃতীয় ঘণ্টা বাজার জন্য অপেক্ষা করতাম। আর আমাদের মনে হত, একজন সুদর্শন যুবক যে কোনো সময় হাসিহাসি মুখে আমাদের ক্লাসের ভেতর ঢুকে পড়বে। খানিক সময় পর ঢুকেও পড়ত সে। আমরা তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে তার মধু নিসৃত কথাগুলো শোনার জন্য অপেক্ষা করতাম। আমাদের পড়ানোর তালে তালে অদ্ভুত সব কথা বলতেন সৈকত স্যার। আর আমরা তার কথাগুলো শুনতে শুনতে অচেনা এক অনুভূতির ভেতরে হারিয়ে যেতাম। তখন আমাদের অসুখগুলো ঠিক কোথায় যেনো হারিয়ে যেত, আমাদের কোনো খেয়ালই থাকতনা। স্যার পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ শুরু করতেন। আর তখন আমাদের মনে হত, শহস্র মাইল দূরের কোনো অচেনা সুর ধীরে ধীরে আমাদের মর্মে গেঁথে যাচ্ছে। আমরা নির্বাক মুখে স্যারের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
সেই বয়সে আমার মনে ভালো লাগা বলতে যা কিছু ছিল, সেটা অন্যরকম। প্রতিদিন আমরা একজন সুদর্শন তরুণকে দেখতাম, তার হাসিটা ছিল রৌদ্র কিরণের মত উজ্জ্বল। যখন তিনি হেসে হেসে কথা বলতেন, তার চোয়ালের বামপাশের উপরের পাটিতে দাঁতহীন একটু ফাঁকা জায়গা বেরিয়ে পড়ত। সেই ফাঁকা অংশটুকুতে হাসির ওঠানামা দেখতে আমাদের কাছে দারুণ লাগত। তার গল্প কথায় আমাদের ভেতর অদ্ভুত এক স্বপ্নের জগত তৈরি হত। শিশু মনে আমরা তার গল্পটাকে কল্পনায় নিজেদের মত সাজিয়ে নিতাম।
আমার দাড়ির নিচে ঢেউ খেলানো যে জায়গাটুকু আছে, সৈকত স্যার সেখানে চার আঙুল জড়ো করে হাত রাখতেন। অথচ তার সেই স্পর্শ আমার মোটেও ভালো লাগত না। আমি তার হাতের নাগাল থেকে সরে যেতাম, কখনো স্যার কাছাকাছি এলে মাথা নিচু করে বসে থাকতাম। ভালো লাগার মধ্যে ছিল তার সেই অদ্ভুত হাসি। সেই অভিজ্ঞতা এতটাই সুন্দর ছিল, যা এখন আর পুরোপুরি প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
দুপুরের বিরতির সময় আমরা সবাই একসঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম। আমাদের ছিল ডানপিটে স্বভাব আর আমরা দুষ্টুমির ক্ষেত্রে এতটাই বেপরোয়া ছিলাম, সৈকত স্যার ছাড়া অন্যকেউ আমাদের থামাতে পারতেন না। তিনি একটা লাঠি উঁচু করে যখন আলাদা আলাদাভাবে আমাদের মুখের দিকে তাকাতেন, গলে যাওয়া মোমের মত আমরা নরম হয়ে পড়তাম। বাড়িতে আমাদের যে কাজগুলো দেওয়া হত, সেগুলো কখনোই আমরা মিস করতাম না। এমনকি প্রতিদিন সৈকত স্যারের ক্লাসে আমাদের প্রতিযোগীতা লেগে যেত, কার খাতার ওপরে কে খাতা রাখবে। তবে কারো যদি বাড়ির কাজ ঠিকঠাক না হত, স্যার একটা চিকন বেত নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতেন। স্যারের ছোট ছোট বাড়ির আঘাতে আমাদের নরম, ফরসা হাতগুলো জবা ফুলের মত লাল হয়ে থাকত। স্যারের পড়ানোর ফাঁকে আমরা সেই লালচে হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। স্যারের সাথে ঘটে যাওয়া স্মৃতিগুলো আজ, এত বছর পর আর কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়।
এক অক্টোবর মাসের ভোরের দিকে, আমারা মনিংসান স্কুলের মাঠের ওপর পিটির জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। আমরা অপেক্ষা করছিলাম, যে কোনো সময় সৈকত স্যার এসে একটা বাঁশি হাতে করে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়বেন। আমরা দৃঢ়চিত্তে শফতবাক্য পাঠ করতে করতে তার হাসিহাসি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকব। ভোরে সূর্যটা আমাদের মুখের ওপর এমনভাবে ওর তেজ ঢেলে দিচ্ছিল, আমরা কিছুতেই আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। তখন পর্যন্ত সৈকত স্যার না আসায় স্কুলের সিনিয়র একজন ম্যাডাম আমাদের পিটি ক্লাসের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ফেললেন। আর আমরা মাঠের ভেতর দাঁড়িয়েই পরস্পর ফিসফিস করে একে অপরের কাছে সৈকত স্যারের ব্যাপারে জানতে চাইলাম। যেহেতু সেটা ছিল একটা প্রাইভেট স্কুল, সরকারি স্কুলগুলো থেকে নিয়মকানুন আলাদা। ফলে, সৈকত স্যার কেন সেদিন স্কুলে আসেনি, সে ব্যাপারে কিছুই জানতে পারলাম না।

স্যার পরদিনও আর স্কুলে এলেন না, তার পরের দিনও না। আমরা এখানে সেখানে ফিসফিস আওয়াজে শুনতে পেলাম, স্যার চাকুরি থেকে ইস্তফা দিয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেছেন। কেন চলে গেছেন সেই ভেতরের খবরটা কারো জানা নেই। তবে আমরা দিনকয়েক সেই গোপন খবরটা জানার জন্য অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকলাম। তবে আমারা কিছুতেই আর সফল হলাম না।

সাতদিন অপেক্ষার পর, আমরা তিনজন মেয়ে মিলে তার মেস বাসায় গেলাম। যেহেতু আমাদের সঙ্গে কোনো ছেলে ছিলনা তাই খুব ভয়ে ভয়ে মেস বাড়িটার পুরনো গেটের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। মেসবাসার পাচিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে হল, কথাবার্তা বলা কিংবা জিগ্যাসাবাদের জন্য আমাদের সঙ্গে একজন ছেলে থাকা খুব প্রয়োজন ছিল। অথচ মেসবাসায় যাওয়ার আগে সেই বিষয়টা আমাদের মাথায়ই আসেনি। আমরা গেটের লোহার দরজার কড়া নাড়লাম। ভেতর থেকে একজন মধ্য বয়সী দুরুস্ত লোক এসে জানতে চাইলেন, কি চাই?
আমরা মর্ণিং সান স্কুলে পড়ি। সৈকত স্যারের খবর নিতে আসলাম। আমি তাকে বললাম।
– ও তোমরা ঠিক সময় এসেছ। আরেকটু পর আমি বেরিয়ে যেতাম। সৈকত কিশোরগঞ্জ চলে গেছে।
– উনি কবে আসবেন আবার?
– সে আর ফিরে আসবেনা।
– কেন আসবেননা? আমি অনেকটা মুখ ভার করে কথাটা বললাম। তবে সেটা বলার সময় আমার গলার স্বর এতটাই নিচু হয়ে গেলো, সেটা আর কিছুতেই উঁচুতে উঠাতে পারলাম না।
– সে জানিনা। তবে সে মেসের পাওনা মিটিয়ে, মিলের হিসাব চুকিয়ে একেবারে চলে গেছে। আমরা তার কাছে কোনো কারণ জানতে চাইলামনা।

উত্তরদাতা লোকটা ছিল বেঢপ মোটা, তার দুটো বড় বড় চোখের ওপর মোটা কাঁচের চশমা। আর লোকটা খুব সাধারণভাবেই আমাদের কথাগুলোর উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল। আমরা তাকে ভরসার লোক মনে করে সৈকত স্যারের ফোন নাম্বারটা চাইলাম।
তিনি ভেতর থেকে একটা টুকরো কাগজে নাম্বারটা টুকে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমরা অপেক্ষা না করে মেসবাড়ি থেকে দ্রুত স্কুলের দিকে ফিরে আসলাম। সেদিন তো নয়ই, তারপর বহুদিন, বহুবার আমরা সেই নাম্বারটাতে ফোন করতে থাকলাম অথচ আমরা সেই নাম্বার আর কোনোদিন সচল পাইনি।

সময়ের সাথে সাথে আমাদের মন থেকে সৈকত স্যার প্রায় বিশ্রুত হয়ে গেলেন।

তারপর আমরা স্কুল ছেড়ে কলেজ, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলাম। ধীরে ধীরে জীবন থেকে স্কুল জীবনের বন্ধুদের থেকে দূরত্ব বেড়ে যেতে লাগল। একের পর এক নতুন বন্ধু হতে লাগল। বেশ কয়েকটা প্রেমও করলাম। আমার কি ভাগ্য, প্রতিটি প্রেম শারীরিক সম্পর্কে গড়াতে গড়াতে কীভাবে যেনো ভেঙে যায়। তবে কেন জানিনা, শেষ সম্পর্কটা আমাকে এখনোঅব্দি চুম্বক আর লোহার মত আটকে রেখেছে। ঠিক কতদিনে এই প্রেমটা ভেঙে যায়, ঠিকঠাক সেই সময়টার জন্য আমি অপেক্ষা করছি। ইতোমধ্যে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হতে চলেছে, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ধীরে ধীরে দূরত্বটা বেড়ে যাচ্ছে। মেয়ে বন্ধুগুলো বিয়ে করে সংসারী হয়ে উঠছে, কেউ কেউ মা হয়ে বাচ্চাদের নিয়ে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়, দেখো বাবা- ওই যে আন্টি। আর আমি এটা খুব ভালো করে অনুমান করতে পারি, বান্ধবীটি আমাকে তার সুখের সংসারের কথা মনে করিয়ে দিয়ে ভেতরে ভেতরে আগুন উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অথচ আমার মনে হয়, জগতে বিয়ে আর সংসার থেকে আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। আর আমি সেই বিষয়গুলো ঠিক কী কী সেসব নিয়ে চিন্তা করে যাচ্ছি। এক কথায় বলা যায়, এখন আমি পুরোপুরি একজন নিভৃতচারী মানুষ।
আমি ঠিক জানিনা, কোন অজানা কারণে এত বছর পর সৈকত স্যারকে মনে পড়ল! আর আমার এটাও মনে হয়, স্যার দেখতে এখনো সেই আগের মতই আছেন। বয়সের পাথর্ক্য যা ই হোক, সে ই একমাত্র আমার বিয়ের উপযুক্ত পাত্র হতে পারে। আর এটা ঠিক কেন আমার মনে হয়, সেটাই আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় বিস্ময়!

স্কুল থেকে আমাদের বাড়িটা খুব একটা দূরে নয়। আমি প্রতিদিন বিকালবেলা স্কুলের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দূরের দিকে চলে যাই। যেখানে কিছু ঘাস আর লতাপাতার ঝোপের পর বিশাল একটা পুরনো জলাশয়। সেখানে একা একা দাঁড়িয়ে আমি সৈকত স্যারের হাসিহাসি মুখটা কল্পনা করতে থাকি। অথচ কোনো ভাবেই আমি তার চিন্তাটা মাথা থেকে সরাতে পারিনা। দুপুরের দিকে আমি যখন স্কুলটার সামনে দিয়ে কোনো কাজের উদ্দেশে হেঁটে যাই, স্কুলের বাচ্চাগুলো তখন জানালার শিক ধরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখন আমার মনে হয়, এই পৃথিবীতে বহু বহু সুন্দর দৃশ্য আছে, তাদের ভেতর স্কুল গমনরত বাচ্চাদের বহরের দৃশ্যটা অন্যরকম সুন্দর। যখন ওরা ইউনিফর্ম পরে পিটিতে দাঁড়িয়ে যায়, সমস্বরে জাতীয় সংগীত গায়, দৃশ্যটা আমার কাছে অভূতপূর্ব লাগে। আর এভাবে কয়েকদিন বাচ্চাগুলোকে দেখতে দেখতে কী ভেবে যেনো একদিন মর্ণিং সান স্কুলের ভেতর চলে গেলাম।

স্কুলে পুরনো শিক্ষকদের এখন আর একজনও নেই। প্রাইভেট স্কুল হওয়ার কারণে সেখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন শিক্ষক আসে। আবার যখন তারা ভালো কোনো চাকরি পেয়ে যায়, একদিন চলেও যায় সেখান থেকে। যেভাবে একদিন সৈকত স্যার কোনো কিছু না বলেই আমাদের থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। আমি অফিস সহকারীর কাছে অনুরোধ করলাম, যাতে সে আমাকে পনেরো বছর আগের খাতাপত্র দেখার সুযোগ করে দেয়। যাতে করে স্কুলের রেকর্ড থেকে আমি সৈকত স্যারের ঠিকানাটা উদ্ধার করতে পারি। লোকটা মধ্য বয়সী আর বাচাল। সে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল, যেনো আমি পুরনো রেকর্ড দেখতে চেয়ে গুরুতরো কোনো অপরাধ করে ফেলেছি। শেষমেশ হতাশ হয়ে যখন বাড়ি ফিরে আসি, আমাদের সময়ের পিয়ন সুলতানকে দেখে মনের ভেতর সাহস খুঁজে পেলাম। বিস্তারিত খুলে বললাম তাকে। অথচ লোকটা আমাকে সাফ জানিয়ে দিল, সৈকত স্যারের কথা তার মনে আছে সত্যি তবে এই বিষয়ে সে আমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবে না। আমি তাকে আমার প্রয়োজনটা বোঝানোর চেষ্টা করলাম, সামান্য কিছু টাকাও দিতে চাইলাম কিন্তু সে কিছুতেই আর রাজি হলনা। শেষমেশ একবুক হতাশা নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম।

তারপর থেকে প্রতিটি রাত আমার কাছে অমাবস্যার রাতের মত মনে হতে লাগল। যখন আমি সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হই, স্যারের হাসি হাসি মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কোনো কিছুতেই মন থেকে আমি তাকে তাড়াতে পারিনা। যখন-তখন, যার-তার ওপর রেগে যাই, হয়ে পড়ি মানসিকভাবে বিরক্ত আর যে কাউকে আমি কষ্ট দিয়ে ফেলি। ভাবনার ভেতর মনে হয়, কোনো একটা জাল আমাকে চারপাশ থেকে পেচিয়ে ধরে বসে আছে। আর সেই জালের চিকন সুতাগুলো ছিন্ন করে আমি সেখান থেকে কিছুতেই বের হতে পারিনা।

যে ছেলেটার সঙ্গে আমার প্রেম, সে দিনকয়েক ধরে শারীরিক সম্পর্কের জন্য খুব ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। সে ছিল আমার চেয়ে বয়সে তিন বছরের বড়। নারীদের চোখে ছেলেরা যে যে বৈশিষ্ট্য থাকলে সুদর্শন বলা হয়, সমস্ত সমস্ত গুনাবলীই ছেলেটার ভেতর ছিল। তার আব্দার একের পর এক আমি এড়িয়ে যাওয়ার পর সে একদিন আশ্চর্য একটা তথ্য জানিয়ে আমাকে চমকে দেয়, আমার বয়সী মেয়েদের শরীরিক সম্পর্ক না করার ফলে চেহারায় দ্রুত বার্ধক্য চলে আসে। কথাটা আগেও একবার কেউ একজন বলেছিল আমাকে। হয়ত সে সময় এটা নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি, কিবাং আমার মনে হয়নি আদৌ এই কথার কোনো সত্যিকারের ভিত্তি আছে। অথচ ছেলেটা এবার তার বক্তব্য অত্যন্ত যুক্তিসহকারে আমাকে বুঝিতে দিতে সক্ষম হল। সে জানায়, একটা নির্ধারিত বয়সের পর, যখন নারীদের পুরুষ সান্নিধ্যের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ক্রমশই সহনীয় পর্যায় চলে যায়, তারা মধ্যরাতে ঘুম ভাঙার পর আর ঘুমাতে পারেনা। তাদের শরীর, মন দারুণভাবে বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে আর তারা দিনের পর দিন এভাবে নিঘুর্ম কাটিয়ে দেয়। ফলে, তাদের চেহারার লাবন্য ভেঙে যায়, সারাক্ষণ ডুবে থাকে হতাশার ভেতর। যেনো মত্যুচিন্তায় বিভোর কোনো বৃদ্ধের মত একটা দুশ্চিন্তা তারা সাথে নিয়েই চলাফেরা করে। কেননা, দেশের সমাজব্যবস্থা তার বিয়ে না হওয়া নিয়ে তার চেয়ে বেশি মাথা ঘামাতে থাকে। আমি ঠিক জানিনা, ছেলেটার যুক্তির ভেতর আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। হয়তবা এমনও হতে পারে, ছেলেদের আব্দার মেটাতে না গিয়ে বারবার আমি প্রেমের সম্পর্কের ইতি টেনেছি। হয়ত এবারের সম্পর্কটা আর আগের মত আর শেষ করতে চাইনা। ফলে আমি ছেলেটার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। তিন চারদিন আমার ভেতরে দারুণ এক তোলপাড় খেলা করছিল। আমি সারাক্ষণ ভাবতাম, তার প্রথম আলিঙ্গন ঠিক কতটা মধুর হতে পারে, ঠিক যখন আমার শরীরের কাপড়গুলো সে একের পর এক অনাবৃত করে করে ফেলবে। আমার অধর, স্তন, উরু আর পেটের দিকে সে তার হাত আর ঠোঁট দিয়ে আদর করতে থাকবে, আমি ঠিক কতটা সুখ অনুভব করব। সেই তিন চারদিন ঠিক আমার ভেতরে আমি ছিলামনা। কাঙ্ক্ষিত সেই দিনটা আমাদের সত্যিই চলে আসে। আমরা খুব কাছাকাছি হই। প্রথমে সে আমার কাছে উন্মুক্ত হয়, তারপর সে আমাকে উন্মুক্ত করে। মনে মনে আমি তার থেকে যা যা প্রত্যাশা করেছিলাম, ঠিক আমার মনের মতই একের পর এক সমস্ত ধাপ সে অতিক্রম করে ফেলে। অথচ চরম মুহূর্তে তার পতন হয়ে যায়। ফলে আমরা একজন আরেকজনের ভেতরে আর প্রবেশ করতে পারলাম না। ধীরে ধীরে আমাদের ভেতর দূরত্ব বাড়তে শুরু করে আর পরে আমি জানতে পারলাম, ছেলেটা আমার থেকেও আরো বেশি বয়সী একজন বিবাহিতা মহিলার সাথে নতুন করে প্রেমে জড়িয়েছে। আর সেই মেয়েলোকটা আমার প্রেমিককে পেয়ে অত্যন্ত খুশি। ইতোমধ্যেই তারা বহুবার শারীরিক সম্পর্ক করে ফেলেছে। আর এভাবেই আমি সর্বশেষ প্রেমটাকেও হারিয়ে ফেললাম।

একদিন সন্ধ্যার পর বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে গুড়িম গুড়িম মেঘেদের সঙ্ঘাত। দখিনা শীতল হাওয়া ঘরের মেঝের ওপর দারুণভাবে খেলা করছে। আমি বিছানা ছেড়ে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে অনেক্ষণধরে বসে রইলাম। চট করে আমার মাথার ভেতর সৈকত স্যারের ঠিকানা যোগাড় করার দারুণ একটা বুদ্ধি খেলা করল। আমি ভাবলাম, মর্ণিং সান স্কুলে আমাকে শিক্ষকতার চাকরি নিতে হবে। তারপর পুরনো কাগজপত্র ঘেটে আমি তার গ্রামের বাড়ির ঠিকানা যোগাড় করব। ফলে পরদিন কোনো কিছু না ভেবেই সেই স্কুলের প্রভাতী শাখার শিক্ষক পদে দরখাস্ত করলাম। অল্প সময়ের ভেতরেই আমাকে কতৃর্পক্ষ ইন্টারভিউর জন্য আমন্ত্রণ জানালো। আর আমি স্বপ্ন দেখার মত অতি দ্রুতই সেখানকার শিক্ষক হয়ে গেলাম।
দেখতে দেখতে মর্ণি সান স্কুলে আমার একমাস কেটে যায়। এই সময়ের ভেতরেই আমি বাচ্চাদের সাথে পুরোপুরি মিশে যেতে পারলাম। যখন ওরা পাখির ছানার মত ছোট ছোট বাক্যে কথা বলে, আমি গলে একেবারে জল হয়ে যাই। আমার মনে হয়, পৃথিবীতে বাচ্চারাই সবচেয়ে আনন্দদায়ক আর সুন্দর। ওদের নাচের ট্রেনিং দিই, গলা ছেড়ে কী করে গান গাইতে হয় সেসব ভঙ্গি শেখাই। কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলি আর ওদের টিফিন খাওয়ার দৃশ্যের দিকে বিস্ময়ভরে তাকিয়ে থাকি।

একমাস উনিশ দিন কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলা করল। আমি স্কুলের পুরনো রেকর্ডপত্র চুরি করব। কেননা, অফিস সহকারি আমাকে এ বিষয়ে কোনো সাহায্য করছিল না। তাছাড়া একবার প্রধান শিক্ষিকার কাছে সাহায্য চেয়ে বললাম, পুরনো একজন শিক্ষকের ঠিকানা দরকার। কেননা, শৈশবে আমি সেই শিক্ষককে খুবই পছন্দ করতাম। তিনি ঠিক কোথায়, কেমন আছেন, এটুকুই জানার কৌতুহল। অথচ প্রধান শিক্ষিকা আমাকে এ ব্যাপারে কোনোরকম সাহায্য করলেন না। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে, আমাকে দিয়ে তিনি তার বাচ্চাদের পড়ানোর আব্দার করলেন। আমি তাকে ছাফ ছাফ না শব্দ জানিয়ে দিলাম।

এক বৃষ্টির দিনে মনে মনে আমি ছুটির সময়ের অপেক্ষা করলাম। বাইরে বড় বড় বাজ পড়ছে, আকাশটা হয়ে পড়েছে মিচমিচে কালো। চারপাশটা এত বেশি আঁধার হয়ে আসে, মনে হয় দুপুর তিনটার সময়ই রাতের প্রথম প্রহর শুরু হয়ে গেছে। অবিভাবকরা একের পর এক বাচ্চাগুলোকে নিয়ে বাড়িতে চলে গেলো। প্রধান শিক্ষিকাও চলে গেছে বৃষ্টির আগে আর ধীরে ধীরে পুরো স্কুলটা মানুষজন শূন্য হয়ে পড়ল। আমি কী ভেবে, দ্বিতীয় তলার টয়লেটের ভেতর ঢুকে সেখান থেকে আর বের হলাম না। অনেক্ষণ পর যখন বের হয়ে আসি, আমি জানালার ধারে গিয়ে দেখলাম, স্কুলের শেষ মানুষ হিসেবে পিয়ন সুলতান স্কুলের মেইনগেটে তালা লাগিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে। সৈকত স্যারকে আবিস্কার করার জন্য আমি একটা স্বাধীন সময় পেয়ে মনে মনে খোদাকে ধন্যবাদ জানালাম।

অন্ধকার, নিস্তব্ধতা আর গভীর আতঙ্কে আমার বুকের রক্ত হীম হয়ে আসে। অনুভূতিতে টের পেতে থাকি, আমার চুলের গোড়াগুলো খাড়া হয়ে যাচ্ছে। তবু মনের সবটুকু ক্ষমতা জড়ো করে স্কুলের দ্বিতীয় তলার মেঝের ওপর আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি বিকেল চারটার পর থেকে পুরনো কাঠের আলমিরা থেকে খোঁজা শুরু করলাম। প্রথমে কয়েকটা পুরনো ফাইল ঘেটে দেখলাম, সেখানে বহু পুরাতন কিছু নথিপত্র সংরক্ষিত আছে। তা অন্তত বিশ বছরের কম নয়। তারপর আরো কতগুলো পুরনো ফাইল নাড়াচাড়া করলাম, যা প্লাস্টিকের রেকের ভেতর ধুলায় মলিন। সেগুলো নেড়ে ধুলাগুলো ঝেরে ফেললাম। তারপর ধীরে ধীরে সুতাগুলো খুলে একটা একটা করে কাগজ চোখের সামনে মেলে ধরে পড়তে শুরু করলাম। কোথাও সৈকত স্যারের নাম নিশানা পর্যন্ত খুঁজে পেলাম না। এবার যদি আরো কিছু খোঁজাখুঁজি করতে হয়, তবে স্কুলের আলমাড়ির তালা ভাঙা দরকার। যা আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিলনা। তবে আমি আলমারিটার ওপর বহু বছরের পুরনো কাগজপত্তরে ভরা দুটো বস্তা পেয়ে গেলাম। সেগুলো খুলে একের পর এক কাগজপত্র ঘাটা শুরু করলাম। আমি মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম, হয়ত শিগগিরই আমি আমিার লক্ষ্যস্থানে পৌঁছে যেতে সক্ষম হব।

ধীরে ধীরে প্রকৃতিতে সন্ধ্যা নেমে এল। জানালার কাচগুলো দিয়ে বাইরের দিকে তাকালে দেখা যায়, পাশের বাড়িগুলো থেকে ক্ষীণভাবে আলোগুলো বাইরের দিকে বেরিয়ে আসছে। শোনা যায় পোঁকাগুলোর অক্লান্ত গুঞ্জন। আমি রুমের ভেতর আলো জ্বালানোর জন্য সুইচ অন করে দেখি বিদ্যুত নেই। সম্ভবত সুলতান নিচতলার মেইন সুঁইচ বন্ধ করে চলে গেছে। তারপর আমি মোবাইলের আলো জ্বেলেই সৈকত স্যারের ঠিকানা য়োগাড় করার কাজটা চালিয়ে যেতে থাকলাম।

আমার কাছে এটা এক অদ্ভুত অনুভূতি, সৈকত স্যারের সিভি খুঁজতে খুঁজতে নিজেকেই তার মাঝে লীন করে ফেললাম। যদি ঠিকানাটা পেয়ে যাই তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে, সেসব নিয়ে কিছুক্ষণ ধরে ভাবলাম। আর এই ভাবনার ভেতরই এক তৃতীয়াংশ ছেঁড়া আর জরাজীর্ণ একটা সিভি পেয়ে গেলাম। কাগজের ওপরের ডান কোনে জংধরা পিনে সৈকত স্যারের ছবি লাগানো। আমি আঙুলে টোকা দিয়ে কাগজটা থেকে ধূলাগুলো ঝেড়ে ফেললাম। তারপর কাগজটা মোবাইলের আলোর সামনে ধরে দেখলাম, সিভির উপরিভাগে গোটা গোটা অক্ষরে লেখাঃ

Curriculum Vitae
Abdur Rahonan Saikot
Vill: Pulerghat
Post: Murapara
Thana: Hossenpur
Dist: Keshorganj

সিভিতে যে ফোন নাম্বারটা দেওয়া আছে, সেটা আমার মোবাইলে প্রেস করে কানের কাছে ধরলাম। কয়েক সেকেন্ড পর ফোনটা কেটে গিয়ে ডিসপ্লেতে আমার ছবিটা ভেসে উঠল। আমি বুঝে গেলাম, নাম্বারটার এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। এক টুকরো পুরনো কাগজ হাতে নিয়ে ঠিক কতক্ষণ যে অন্ধকারে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম, কিছুই জানিনা। দরদর করে আমার চোখ থেকে জলের ধারা নিচের দিচকে গড়িয়ে পড়ছে। বাইরে আবার মুষলধরে বৃষ্টির সাথে শুরু হয়েছে বাতাসের আস্ফালন। সেই অন্ধকার ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে আমার মনে হল, আমি পৃথিবীর সমস্ত মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো অজানা মরু প্রান্তরের ভেতর একা দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করার মত কেউ নেই।

ফাইলগুলো আগের মতই সাজিয়ে আবার বস্তার ভেতরে ভরে ফেললাম। ওগুলো আগের জায়গায় এমনভাবে রেখে দিলাম, যেনো কোনোকিছুই হয়নি এখানে। সুলতান কেন, অন্য কারো পক্ষেই আমার গোয়েন্দাগীরির কোনো আলামত বুঝে ফেলা সম্ভব নয়। হঠাৎ জানালার একটা কাঁচের ভাঙা অংশ দিয়ে বাইরের শীতল বাতাস এসে আমার গায়ে লাগল। সড়কের শেষ মাথা থেকে ভেসে আসতে লাগল কুকুরেরে আর্তচিৎকার। আর সেই বিলাপগুলো দূর থেকে আমার কাছে মৃত্যুপুরীর শব্দের মত মনে হতে লাগল।

দ্বিতীয় তলায় খুব ভয় করার কারণে আমি দ্রুত নিচের তলায় নেমে গেলাম। সিঁড়ির গোড়াটার কাছে দাঁড়াতেই মনে হল, কে যেন আমাকে পেছন থেকে ডাকছে। শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠল আর মনে হল, কেউ যেন আমার সঙ্গে ফিসফাস করে কথা বলতে চাইছে।
আমি দ্রুত গিয়ে শিক্ষক মিলনায়তনে নিজের চেয়ারটায় গিয়ে বসে পড়লাম। বাইরে যে বাড়িগুলো দেখা যায়, সেখানকার আলোগুলোর দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে সাহস সঞ্চার করার চেষ্টা করলাম। বস্তুত : এই নিস্তব্ধ স্কুলটিতে আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। শরীরটা ধীরে ধীরে শীতল হয়ে এল, ঠিক কখন যে চেয়ারের ওপারেই ঘুমিয়ে পড়লাম, সেসবের কিছুই মনে নেই। পরদিন আমার চোখের ওপর ভোরের আলো পড়ার পর খোদাকে ধন্যবাদ জানালাম। আমি যখন দেখলাম, সুলতান বরাবরের মতই পুরনো একটা ব্যাগ নিয়ে স্কুলের দিকে আসছে, আমি আগের দিনের মত আবারো টয়লেটের ভেতরে নিজেকে লুকিয়ে ফেললাম। তারপর যখন বাচ্চারা পিটি ক্লাসের জন্য বাইরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে, আমি টয়লেট থেকে বের হয়ে সেখানে চলে গেলাম। আমার ভাবটা ঠিক এমন, যেনো অন্য যে কোনো দিনের তুলনায় আমি আগে এসে স্কুলের ভেতরে অপেক্ষা করছিলাম। স্কুলের একজন সিনিয়র আমাকে বাচ্চাদের শফতবাক্য পাঠ করানোর অনুরোধ করলেন। যখন আমি জাতীয় সংগীতে সুর টানার চেষ্টা করলাম, অনুভব করলাম, আমার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বা সুর স্পষ্ট বের হওয়ার মত এতটুকু শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই। ফলে দু’টো ঘণ্টা বাজার পর স্কুল থেকে সেই যে আমি বেরিয়ে গেলাম, আর কোনোদিন আমি মর্ণিং সান স্কুলে যাইনি। যেভাবে আমাদের কালে স্কুলের শিক্ষকরা হঠাৎ করে লাপাত্তা হয়ে যেত।

একদিন সূর্যটা চড়চড় করে আকাশের অনেকটা উপরে উঠে গেছে। ঠিক তখনই আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড গিয়ে হোসেনপুরের বাস ধরলাম। আমার গন্তব্য কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলার পুলেরঘাট গ্রাম। হোসেনপুর যেতে যেতে দুপুর গড়িয়ে যায়, রাস্তার দুধারের গাছের পাতাগুলো হালকা হাওয়ায় দুলছে, আকাশে দেখা দিয়েছে বৈকালিন রেখা। কিছুক্ষণ পরই আমাকে একটা আধমরা বাস স্টপেজে নামিয়ে দেওয়া হয়। আমি এক স্থানীয় লোকের দিকে ছেঁড়া কাগজটা বাড়িয়ে ধরলাম। প্রায়বৃদ্ধ লোকটা সৈকত স্যারের পনেরো বছর আগেকার ফটোটা চোখের সামনে তুলে ধরলেন। তারপর তার নিজের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, কিতা কইবাম, তারে দেখছি বইলা তো মনে অয় না।

আমি লোকটাকে পাশ কাটিয়ে আরো একটু সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাচা রাস্তাটা ধরে কিছুদূর হাঁটতেই বিরাট প্রান্তর। একপাশে কলাগাছের বাগান আর অন্যপাশে পাতলা ঝোপ জঙ্গল। প্রান্তরটা বহুদূর পর্যন্ত ফাঁকা পড়ে আছে। সুদূর থেকে বাতাস এসে আমার চুলগুলো নাড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে, ওড়নাটা খানিক ঠিকঠাক করে আরো সামনের দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকলাম। তারপর অন্তত আধা মাইল উত্তরে হাঁটার পর পুলের ঘাট বাজারের কাছে পৌঁছে গেলাম।

পশ্চিমদিকের আকাশ ক্রমশ ফ্যাকাশে হতে শুরু করল। ঝুলে থাকা মেঘেদের লেজের কাছে সূর্যের কুসুম আবির। প্রান্তরের এক জায়গায় গোরুর বিষ্ঠা, ছাগলের নাদি আর পশুদের বিচরণের চিহ্ন। মনে হল, এইমাত্র কৃষক তার পশুগুলোকে খোয়াড়ে নিয়ে গেছে। দিনের আলো নিভে যেতে আর খুব একটা সময় বাকি নেই। আমি বাজারের লোকদের ধরে ধরে সৈকত স্যারের ছবি দেখাতে থাকলাম। ওদের ভেতর একজন বলল, যদি আপনি গ্রামের লোকদের কাছে তার নাম বলেন, তবে সে আবদুর রহমান। তবে সৈকত নামে তাকে অনেকে চিনলেও চিনতেও পারে। আপনি আরেকটু এগিয়ে গেলে আপনার সামনে একটা বদ্ধ, সরুখাল পড়বে। সেখানকার কাঠের পুল পেরিয়ে পুরনো একটা বাড়ি। দক্ষিণদিকে সাদা রংয়ের মসজিদের পাশেই পুরনো একটা কবরখলা। যদি পশ্চিমে তাকান, দুটো ছেলের উচ্চকিত কণ্ঠধ্বনিও শুনতে পাবেন। অথবা পুরো বাড়িটাই নিস্তব্ধ, নীরব। সেখানেই আপনার গন্তব্য।

আমি লোকটার কথামত সেদিকেই এগিয়ে গেলাম।

পুরনো কাঠের পুল পেরিয়ে বড় বড় গাছে আচ্ছাদিত বাড়ির সরু রাস্তা। তারপর সেই সাদা মসজিদ। আমি দূর থেকে ঝোপ জঙ্গলে আচ্ছাদিত গোরস্তানের দিকে নিশ্চল পাথরের মত তাকিয়ে রইলাম। গোরস্তানের শেষে মেহগিনি বাগান, তারপর জাংরাঘাসে ভরা মানুষের পদচিহ্নহীন একটা উঠান। সেখানে দুটো পেয়ারা আর একটা আধমরা ডালিমগাছ জড়াজড়ি করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। উঠানের প্রান্তের দিকে দোচালা গোরুর খোয়াড় আর শেষে পা ভাঙা মানুষের মত একটা চৌচালা মাটির ঘর। তবে আমার মনে হল, সামনের দিকের গোরস্তানের মত পুরো বাড়িতেই দারুণ এক নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে।

এক বৃদ্ধা আমার উপস্থিতি জেনে ভেতর থেকে লাঠি ঠুকঠুক করে বেরিয়ে এলেন। তার দুপাশে দাঁড়ানো পুষ্টিহীন দুটো শিশু। বাচ্চাদুটো আমার মুখের দিকে ধ্যান ধরে তাকিয়ে রইল। ঘরের ভেতর থেকে মাথায় আঁচল টানতে টানতে উঁকি দিল আমার চেয়ে সামান্য বেশি বয়সী এক গৃহবধূ। আমি বৃদ্ধার কাছে আবদুর রহমানের ব্যাপারে জানতে চাইলাম। বৃদ্ধা তার হাতের লাঠিটা ফেলে দিয়ে গোরস্তানের দিকে ইশারা করল। শিশুরা বৃদ্ধার আঁচল ধরে জড়াজড়ি করে দাঁড়াল। ওদের কোটরাগত চোখগুলো জ্বলজ্বল করতে থাকে। গাল বেয়ে দরদর করে অশ্রু নামে গৃহবধূর।

ফাগুনের বিকেলটা বড় বিষণ্ন। গোরস্তান থেকে বাতাবিলেবু ফুলের গন্ধে বাতাস ভুরভুর করে ওঠে। হঠাৎ আমার মনের ভেতর এক চরম সত্যের প্রতিক্রিয়া জাগে—নিরর্থক পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই অসহনীয় বঞ্চনা। মিথ্যে আশাগুলো জমতে জমতে কখনো পাহাড়ের মত ভারী হয়ে যায়। আবেগ হল বহুরৈখিক এক মায়া। কিন্তু গন্তব্যের যাত্রাপথে মানুষগুলো স্বার্থপরের মত একা একাই চলে যায়।

======================